Post Editorial

রুখে দাও নৈরাজ্য, রক্ষা করো সাধারণের বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা

উত্তর সম্পাদকীয়​

সুকুমার পাইন
 

আগামী ২৬-২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ পশ্চিম মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির একাদশ ত্রি বার্ষিক  সম্মেলন। বিপ্লব, বিদ্রোহের ক্ষেত্রভূমি এই মেদিনীপুর শহর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই মাটি। বাংলার নারী শিক্ষা আর সমাজ সংস্কারের অগ্নি পুরুষ, আমাদের বর্ণপরিচয়ের মহান স্রষ্টা ,স্বপ্ন পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি এই মেদিনীপুর। মাতঙ্গিনী, সতীশ সামন্ত, ক্ষুদিরামের পদচারণায় গরবিনী এই মাটিতেই এক কঠিন, জটিল পরিস্থিতিতে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিরোধী নীতির ফলে সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত— ঠিক সেই সময় বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য নতুন করে শপথ নেবার মঞ্চ এবারের সম্মেলন। 
 

তছনছ বাংলার বিদ্যালয় শিক্ষা
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সারা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পরিবেশকে পুরোপুরি  ধ্বংস করেছে রাজ্য সরকার। বিদ্যালয় পরিচালন সমিতিতে অভিভাবক অভিভাবিকাকে যুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের যে নজির তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, স্পন্সরড বিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থায় তা রাতারাতি তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতিতে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে বদল করে এই শিক্ষা নিয়ামক সংস্থাকে দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হিসাবে তৈরি করা হয়েছে। সর্বত্র দলতন্ত্র, আধিপত্যবাদ আর নির্লজ্জ দাম্ভিকতার নজির তৈরি করছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। স্পন্সরড বিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থায় শিক্ষায় আগ্রহী নন, চূড়ান্ত দলবাজিতে অভ্যস্ত কিছু মানুষকে শাসকদলের পক্ষ থেকে  পরিচালন সমিতির পদাধিকারী ও সদস্য হিসাবে মনোনয়ন করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্কুলগুলিতে। তাদের মূল লক্ষ্য স্কুলে স্কুলে নৈরাজ্য তৈরি করা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করা, উন্নয়ন খাতের ছিটেফোঁটা যেটুকু বরাদ্দ সেটাও আত্মসাৎ করা, মিড ডে মিলের টাকা তছনছ করা। সারা রাজ্যজুড়ে এটাই এখনকার পরিচিত দৃশ্য।  

পাঠশালা বন্ধের নীল নকশা
সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশ' এর পুনরাভিনয় চলছে এ রাজ্যে। চলচ্চিত্রে হীরক রাজ নিদেন দিয়েছিলেন, ‘আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ’, আর তার কথায় বন্ধ হয়েছিল হীরক রাজ্যের সব  পাঠশালা। আমাদের রাজ্যে নতুন করে বহু সংখ্যায় পানশালা খোলা হলেও, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক পাঠশালা। বিগত ১৫ বছরে আমাদের রাজ্যে ৮ হাজারেরও বেশি স্কুল বন্ধ হবার মুখে। এটিকে একটি সরল, সাধারণ ঘটনা মনে করলে ভুল হবে। আসলে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রের মতো বড় ক্ষেত্রকে বেসরকারি পুঁজির হাতে ছেড়ে দেবার একটি বড় চক্রান্ত এবং তার  নীল নকশা তৈরি হয়েছে। বামফ্রন্ট আমলের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী  এসএসসি’র মাধ্যমে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পদ্ধতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি, অযোগ্যদের বাঁকা পথে শিক্ষকতায় আনা, শূন্য পদ পূরণে উদাসীনতা, পরিকাঠামোগত উন্নয়নে বরাদ্দ তলানিতে নিয়ে যাওয়া, যেখানে প্রয়োজন সেখানে অতিরিক্ত শিক্ষক পদ তৈরি না করা, অযৌক্তিক বদলি নীতি, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পঠন পাঠন থেকে সরিয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে যুক্ত করা, কারণে-অকারণে স্কুল বন্ধ রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণি পাঠ থেকে বঞ্চিত করা— সবটাই করা হয়েছে বাংলার শিক্ষাকে ধ্বংস করে বেসরকারি বেনিয়াদের হাতে শিক্ষার ভার তুলে দেওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
আলো-আঁধারিতে  বাংলার শিক্ষা
এ রাজ্যের সরকার সব ক্ষেত্রে 'এগিয়ে বাংলার' স্লোগান তুললেও  বাস্তবে গত ১৫ বছরে কয়েক যোজন পিছনে চলে গেছে বাংলা। বিগত শতাব্দীর সাতের দশকের অন্ধকার, কালো দিন অতিক্রম করে  ১৯৭৭ সালে উঠেছিল নতুন সূর্য। এলাকায় এলাকায় গণ উদ্যোগে গড়ে উঠছিল অসংখ্য বিদ্যালয়। আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবার জন্য গঠিত বিদ্যালয়গুলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু সরকার। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৪১,৬৫৯ টি। ২০১১ সালে সরকারি আনুকূল্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪,৭১৭ টি। অর্থাৎ ৩৪ বছরে রাজ্যে প্রায় ৩৩ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।  অথচ পরিতাপের বিষয়, এ রাজ্যের বর্তমান সরকারের শিক্ষা বিরোধী নীতির ফলে বর্তমানে রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৭,৬৯৯ টি। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৩৭৬২ টি, ২০১১ সালে তার সংখ্যা হয় ১০,০২৭ টি। মাধ্যমিক শিক্ষায় এই মাত্রায় ছাত্র-ছাত্রীর অন্তর্ভুক্তিকরণ সারা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। আজ তা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত হতাশাজনক। বাড়ছে স্কুলছুট, কমছে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। সব মিলিয়ে এক দমবন্ধ করা পরিবেশে বিরাজ করছে বাংলার শিক্ষা। সরকারি শিক্ষায় অব্যবস্থার ফলে উৎসাহিত হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলি। ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সরকারি বিদ্যালয়ে ৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কম ভর্তি হয়েছে, সেখানে বেসরকারি স্কুলে ছাত্র ভর্তির সংখ্যা ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। আগস্ট, ২০২৫ শিক্ষা দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ রাজ্যে ২২১৫ টি স্কুলে মাত্র একজন করে শিক্ষক রয়েছেন। পরিসংখ্যানে আরও পাওয়া যাচ্ছে, ২০০৮ সালে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ছিল ১:৩৫  আজ সেই অনুপাত হয়েছে ১:৭৩।

অনুরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিতে পরিচালিত হতো। রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় মাদ্রাসা বিদ্যালয়ের বৃদ্ধি, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন এর মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সিলেবাস প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসা ছাত্র-ছাত্রীদের যুগপোযোগী করে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। আজকের দিনে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হলেও বাস্তবে নিয়োগ দুর্নীতি, দীর্ঘদিন শূন্য পদ পূরণ না করা,পরিকাঠামো উন্নয়নে উদাসীনতা মাদ্রাসা ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছে। 
স্কুলছুট, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে তারা?
বিগত কয়েক বছরে এ রাজ্যে স্কুলছুটের পরিমাণ রীতিমত আশঙ্কাজনক। রাজ্য সরকার বিজ্ঞাপনে যতই ঢক্কানিনাদ করুক না কেন, সীমাহীন বেকারি, জীবন ও জীবিকার সঙ্কটে অভিভাবক সমাজ তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। ফলে বাংলা শিক্ষা পোর্টাল দিয়ে পরিসংখ্যানের কারচুপি করলেও বাস্তব চিত্রটি ক্রমশ বেআব্রু হচ্ছে। তথ্য বলছে, ২০০৮ সালে এ রাজ্যে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ২৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৫৯ জন ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু ২০১৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষা দেয় ১১, ২৯,৯২১ জন। মাঝ পর্বে ১৩ লক্ষ ছেলেমেয়ে পড়া ছেড়ে দিতে  বাধ্য হয়েছে। এই মুহূর্তে মাধ্যমিক স্তরে রাজ্যে স্কুলছুটের পরিমাণ ১৫ শতাংশ অথচ জাতীয় স্তরে এটি ১৪ শতাংশ। 'জার্নাল অব ইমার্জিং টেকনোলজিস অ্যা ন্ড ইনোভেটিভ রিসার্চ'-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় পঞ্চম থেকে অষ্টম পর্যন্ত মোট ছাত্র-ছাত্রীর পরিমাণ ছিল ৬ লক্ষ ৭১ হাজার ২৫৫ জন। এদের মধ্যে  ৯০.৪ শতাংশ সরকারি স্কুলে পড়তো। ২০১৫ সালে অর্থাৎ চার বছরের মধ্যে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫,০৫,৭৯২ জন, যার মধ্যে ৮০.৫৬ শতাংশ  সরকারি স্কুলে পাঠরত। অর্থাৎ এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম পাঁচ বছরে এই জেলায় একদিকে যেমন স্কুলছুটের পরিমাণ বেড়েছে, পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলে ভর্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী প্রায় ১১ লক্ষ ছিল। ২০২২ সালে এই সংখ্যা কমে হয়েছে ৯,৬৯,৪২৫ জন, অথচ এই সময়কালে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৩৮৫। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে অথবা বাড়ির সাহায্যের জন্য কোনও না কোনও কাজে যুক্ত হচ্ছে। সরকারি নীতির ফলে এভাবেই ক্লাসরুমগুলো ফাঁকা হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজে কিশোর কিশোরীদের একটা বড় অংশ।
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে– কন্যাশ্রী’র প্রকৃত চিত্র
কন্যাশ্রী প্রকল্পটিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর 'স্বপ্নের প্রকল্প' হিসাবে বিজ্ঞাপিত করা হয়ে থাকে। মূলত মেয়েদের পঠন-পাঠনের জন্য এই অনুদান দেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এবং চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। গত বছর এ রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্পে এককালীন ২৫ হাজার টাকা পাবার যোগ্য ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ আবেদনই করেননি। আসলে ‘কন্যাশ্রী’র বাংলায় সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত আছে আমাদের কন্যারা। ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিকারে প্রশাসনিকভাবে পুরোপুরি ব্যর্থ রাজ্য সরকারের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না এ রাজ্যে অভিভাবকেরা। নিরাপত্তাহীন কন্যাদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চাইছেন। সারাদেশে ১৮ বছরের নিচে নাবালিকা বিবাহের গড় যখন ২৩.৩ শতাংশ আর এই রাজ্যে ৪২ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়সের নিচে।  আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, ১৫ থেকে ১৮ বছরে সন্তানের জননী হয়েছে এদেশে ৯ শতাংশ কিশোরী। অথচ কন্যাশ্রীর বাংলায় নাবালিকা অবস্থায় সন্তানের জননী হয়েছে ১৬ শতাংশ কিশোরী। বিজ্ঞাপনের ঢাক যতই সরবে বাজানো হোক না কেন, কন্যাশ্রীর বাংলায় আমাদের ছাত্রীদের বিশ্রী অবস্থা আর কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না!
জোড়া আক্রমণে এলোমেলো শিক্ষাঙ্গন
কেন্দ্র ও রাজ্যের জোড়া আক্রমণে এলোমেলো হয়ে গেছে সারা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষাবিরোধী নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক এ রাজ্যের সরকার। প্রতিটি কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ক্রমশ কমছে। বিগত এক দশক ধরে পরিকাঠামো, বিশেষত পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন স্কলারশিপ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, আধুনিক প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দের অর্থ তলানিতে ঠেকেছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিষয় শিক্ষক ও উপযুক্ত পরিকাঠামো ব্যতিরেকে হঠাৎ করে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করায় পুরো বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী ছাত্র-ছাত্রীরা। পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা গড়ে ছয় থেকে সাত মাস সময় পাচ্ছে। এর ফলে গবেষণামূলক বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী ছেলেমেয়েদের ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের  দিশাহীন সিদ্ধান্তের বলি হচ্ছে বাংলার লক্ষ লক্ষ সম্ভবনাময় ছাত্রছাত্রীরা। দুই সরকারের লক্ষ্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দেওয়া। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া তফসিলী জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা। 
দুর্নীতি - ভূলুণ্ঠিত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মর্যাদা
বিগত ১৫ বছরে রাজ্যে মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগে যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে তা ভারতবর্ষের মধ্যেও বিরলতম। আইনি জটিলতায় বারবার স্তব্ধ হয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। টাকার বিনিময়ে চাকরি কেনা শিক্ষক-শিক্ষিকারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণে যুক্ত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা। আবার সাত আট বছর চাকরি করার পর রাজ্য সরকার এবং তার অধীনস্ত সংস্থাগুলির দুর্নীতির কারণে কর্মহারা হয়েছেন ২০১৬ এর এসএসসি প্যানেলের অনেক যোগ্য, মেধাবী শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী। সমাজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা মাটিতে মিশে যাচ্ছে। সমাজ তাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। শিক্ষক দুর্নীতিতে ২৮টি সংস্থা এবং ৫৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা শুরু হলেও এক রহস্যময় কারণে তা স্তিমিত হয়ে গেছে। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার প্রায় সব কুশীলবেরা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কোনও বিষয় হতে পারে না। 
আমাদের শপথ
শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের জীবন-জীবিকা ও শিক্ষকতা পেশাকে মহনীয় করে তোলবার জন্য আজ থেকে ১০৫ বছর আগে বাংলাদেশের রংপুর জেলার গাইবান্ধায় করতোয়া নদীর তীরে যে সংগঠনের জন্ম, ক্রমশ সামন্ততান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে সবার জন্য শিক্ষার দাবিতে সোচ্চার নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি আজও লড়াইয়ের ময়দানে আছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুকৌশলে ধ্বংস করার বহুমাত্রিক আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা রাজ্য জুড়ে লাগাতার লড়াই আন্দোলনে আছেন আমাদের হাজার হাজার সংগ্রামী সাথিরা। আজকের অতিক্রান্তিকালীন মুহূর্তে বীরপ্রসবিনী মেদিনীপুর শহরে আমরা সমবেত হচ্ছি প্রান্তিক সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সন্তানদের শিক্ষা পাবার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার লড়াই আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করার জন্য। সমাজের সব স্তরে প্রতিক্রিয়াশীল, মনগড়া তত্ত্ব ও বিভাজনের নীতিকে পরাজিত করার একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। তাই আগামী প্রজন্মের স্বার্থে, দেশ ও জাতির স্বার্থে নৈরাজ্যের শক্তিকে পরাজিত করে সাধারণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বজায় রাখার জন্য আমাদের জান কবুল লড়াই করতেই হবে। এটাই সময়ের ডাক। অভিভাবক সমাজকে যুক্ত করেই আমরা সেই আহ্বান জানাতে মিলিত হতে চলেছি এই সম্মেলনে।

Comments :0

Login to leave a comment