Editorial

ঋণের চক্রব্যূহ

সম্পাদকীয় বিভাগ

এক আত্মঘাতী চোরাপথে ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।  দু’টি বিষাক্ত মাধ্যম  ডিয়ার লটারি এবং বহু নামে মাইক্রোফিনান্স। সর্বস্বান্ত করছে সাধারণ গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষকে। নেশার মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের আর্থিক অনটনের সুযোগ নিয়ে, প্রয়োজনের সময় ঋণ দিয়ে  মাইক্রোফিনান্সের কারবারিরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। রাতারাতি অবস্থা বদলের অলীক নেশায়  প্রান্তিক মানুষের লটারি কেনার ঝোঁক অভাবী মানুষকে পথে বসাচ্ছে। রাজ্য জুড়ে এর রমরমা অবস্থা। এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? 
কেন, কিভাবে জাল বিছালো এই সর্বনাশের হাতছানি? হাতে কাজ নেই,  সরকার রোজগারের কোনও বন্দোবস্ত করতে পারছে না ,বন্ধ রয়েছে একশো দিনের কাজ,বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা,চলছে ছাঁটাই এমনকি মাঠেও হাহাকার। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার চলে যাবার পর মমতার সরকার  সমবায়গুলিকে দুর্বল করেছে। সমবায় ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হবার মুখে। নির্বাচিত বোর্ডগুলিকে ভেঙে দিয়ে সমবায়ে দখলদারি, লুটতরাজ এখন  বেলাগাম। ফলে বামফ্রন্টের সময়ে যা ছিল সহজলভ্য, সেই সমবায়ের সুযোগ সুবিধা থেকে সাধারণ প্রাপকরা এখন বঞ্চিত।  শাসকদলের পেটোয়াদের লুটতরাজের সুযোগ করে দিয়েছে মমতা ব্যনার্জির সরকার। প্রয়োজনের সময়, অভাবের দিনে সাধারণ মানুষ ছুটছেন মাইক্রোফিনান্সের  দরজায়। 
কম টাকায় ডিয়ার লটারির টিকিট বিক্রি এখন সব জেলার প্রায় প্রতিটি গঞ্জেই। ছোট বা বড় টেবিল পেতে, ছাতা লাগিয়ে টিকিট বিক্রি করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। বাইরে থেকে সাদামাটা ব্যাপার। অনেকেই লুকিয়ে টিকিট কেনে, আবার প্রকাশ্যেও কেনে। মুনাফার আশায় এই ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেনও অনেকে। আর রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার নেশায় ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছেন লটারির টিকিট কাটতে। দৈনন্দিন এই ‘ভাগ্যপরীক্ষা’য় অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ সেই দেনার দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। এই রমরমা কারবারের পোশাকি নাম ডিয়ার লটারি। আরও কিছু  লটারির টিকিটও অবশ্য বিক্রি হয়। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশের উপর থাবা বসিয়েছে এই ডিয়ার লটারি। মূলত বেকার যুবক, থেকে ভ্যান রিকশাচালক, মুটিয়া মজদুর অংশের মানুষদেরই কেনার ঝোঁক বেশি। এই ডিয়ার লটারিকে ঘিরে কালো টাকা সাদা করার চক্রও কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। যার সঙ্গে নেতা-মন্ত্রীদের সরাসরি লেনদেন।
অন্যদিকে, গরিব মানুষের প্রয়োজনে সহজে টাকা দেওয়ার কায়দায় মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির ব্যবসাও চলছে ঢালাওভাবে। কেন হচ্ছে?  আসলে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে অনেক ঝক্কি। কাগজপত্র জমা দিতে হয়, জমি-বাড়ির কাগজ জমা রাখতে হয়। চাকরিজীবী ছাড়া সহজে ব্যাঙ্ক ঋণ মেলেও না। ফলে মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের যে কোনও প্রয়োজনে শুধুমাত্র আধার কার্ডের জেরক্স আর একটি সাদা কাগজের বয়ানে সইয়ের ভিত্তিতেই ঋণ পাওয়া যায় এই মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলি থেকে। নিয়ম একটিই,  প্রতি সপ্তাহেই সুদ ও আসলের অংশ মিটিয়ে দিতে হবে। না দিতে পারলেই বিপদ।
ব্যাঙ্ক কিংবা সমবায়ে ঋণ মেলে না, কিন্তু  গরিব মানুষের দুয়ারে হাজির মাইক্রো ফিনান্স। তাই গরিব মানুষ সেটাই  আঁকড়ে ধরছে। মহিলারাই ঋণ পায় বেশি। চড়া সুদে ঋণ। ঋণ শোধ করতে না পারায়, আবারও ঋণ নিতে হয়। ফলে ঋণের চক্রব্যূহে আটকে যায় সহজেই। ঋণ আদায়ের নামে কার্যত তোলবাজি চলে বেসরকারি মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থাগুলির ‘এজেন্ট’-দের। জোরজবরদস্তি চলতে থাকে, ফলে ঋণ নেওয়া মানুষজনের অনেককেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। আত্মহত্যার ঘটনাও দেখা গেছে। অর্থনীতিবিদরা একেই ‘আর্থিক সন্ত্রাসবাদ’ বলে চিহ্নিত করছেন। এই ঋণজালের চক্রব্যূহ থেকে বাংলা বাঁচাতে চায়। বাংলা বাঁচানোর লড়াই এজন্যই এত তাৎপর্যপূর্ণ।

Comments :0

Login to leave a comment