Gita path Sahoj path

গীতাপাঠের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সহজপাঠ

উত্তর সম্পাদকীয়​

শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
আরামবাগের শেখ রিয়াজুল কে চিনি তো আমরা। ওই যে নিরীহ ছেলেটা, পেটের দায়ে প্যাটিস বিক্রি করতে ময়দানে গিয়েছিল। আরএসএস’র উন্মত্ত গুন্ডা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়েও বরাত জোরে বেঁচে গেছে ও। শুধু রিয়াজুল কেন, সারা বছর ময়দান  চত্বরে সকাল সন্ধ্যা রিয়াজুলের মতো আরও অনেকেই আসেন তাদের পশরা নিয়ে। কেউ পেয়ারা, কেউ শসা, কেউ কাঠি ভাজা ছোলা-বাদাম ভাজা লজেন্স, আবার কেউবা সেঁকা পাঁপড় নিয়ে বসেন। তাছাড়া হরেক কিসিমের গরম চা আর রকমারি জিনিসের পশরা তো আছেই। ময়দানে জনসভার ভিড় থাকলে ওদের বিক্রি বাট্টা একটু ভালো হয়, সংসারে বাকি লোকগুলোর মুখে হাসি ফোটে। শুধু ময়দান কেন, পাড়ার অন্য কোনও জায়গাতেও কোনোদিন প্রকাশ্য কোনও অনুষ্ঠানে (খেলা মেলা সভা সমাবেশ সে যাই হোক) একটু বেশি মানুষের সমাগম হবে এমন খবর পেলে পশরা নিয়ে হাজির হয় ওরা। এভাবেই সামান্য বিক্রিবাট্টা করে দিন গুজরান করতে হয় ওদের। গ্রামে তো বিকল্প কোনও কাজের সুযোগ নেই। গতানুগতিক পরিযায়ী শ্রমিকদেরর ভিড়ে নাম না লেখানো এই মানুষগুলো তাই নিত্যদিন পেটের তাগিদে এইভাবে হকারি করে উপার্জনের চেষ্টা করে, যাতে সংসারের বাকি মানুষগুলো বাঁচে। কখনো কেউ জানতে চায়নি ওদের জাত কি ধর্ম কি বা কোথা থেকে আসছে ওরা। গরিব খেটে খাওয়া মানুষ— এই পরিচয়ে বছরভর এভাবেই লড়াই চালিয়ে যায় ওরা।
আসলে জীবন-জীবিকার যন্ত্রণায় জেরবার রিয়াজুলদের কাছে গীতা-কোরানের কোনও ভেদ নেই। আছে শুধু দু’বেলা দু’মুঠো ঠিকমতো খেতে না পাওয়ার যন্ত্রণা, ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে না পারার যন্ত্রণা, বাড়ির অসুস্থ মানুষগুলোর ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পারার যন্ত্রণা, মাথার উপর ছাদ না থাকার যন্ত্রণা, কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা, চাষ থেকে আসা সামান্য ফসলেরও ন্যায্য দাম না পাওয়ার যন্ত্রণা। ধর্মের কারবারে যে ওদের পেট ভরবে না, ওরা তা বোঝে। যন্ত্রণাকাতর এই মানুষগুলো তাই বিকল্প উপার্জনের পথ খোঁজে। রিয়াজুলও ঐদিন অনেক মানুষের ভিড় দেখে ওটাই করতে চেয়েছিল। ওখানকার মানুষগুলো গীতা পাঠ করছে না কোরান পাঠ করছে তা দেখা বা বোঝার ফুরসত ওর ছিল না। সেই কারণে ওর বাক্সে চিকেন প্যাটিস নেবে নাকি ফুল বেল পাতা তুলসী পাতা আর দুব্বো ঘাস দিয়ে বানানো প্যাটিস নেবে-- অত সাত পাঁচ ভাবার সুযোগ ওর ছিল না। থাকবার কথাও নয়। চিকেন প্যাটিসে লাভ বেশি, বিক্রিও ভালো হয়। ব্যবসার কারণেই ও অন্য প্যাটিসের সাথে চিকেন প্যাটিসও নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। তাছাড়া কলকাতার ওই ময়দানটা তো কোনও মন্দির বা মসজিদ বা কারো বাপের সম্পত্তি নয়। সেনাবাহিনীর তদারকিতে থাকা ওই মাঠ শুধু মিটিং নয়, সাধারণ মানুষ সারা বছর নানাভাবে ব্যবহার করে। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলো সভা সমাবেশ করে ওই মাঠে। বছরভর ময়দানে আসা এই মানুষগুলোর সাথে রিয়াজুলদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাই এতো চেনা ওরা। স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো, আমজনতার পছন্দের খাবার বেচতে গিয়ে এভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে একদিন সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে ওকে।
হ্যাঁ, এ রাজ্যে এটাই এখন সবচাইতে বড় আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যে উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র হিন্দুত্ববাদীদের দাপাদাপি বেড়েছে। এতদিন উত্তর প্রদেশ হরিয়ানা রাজস্থান মধ্য প্রদেশ এমন কি বিহারেও এই কাণ্ড হতে দেখেছি আমরা। বিজেপি’র শাসনে সরকারি মদতে কখনো গো-রক্ষার অজুহাতে আবার কখনো নীতি পুলিশ সেজে গরিব শ্রমজীবী সংখ্যালঘু মানুষের উপর বর্বর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। আমাদের এই পশ্চিমবাংলায় এ জিনিস হতে পারে এক-দেড় দশক আগেও এটা ভাবা যেত না। কেউ দাঙ্গা বাঁধাবার চেষ্টা করলে জ্যোতিবাবু বুদ্ধবাবুদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার "দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার" স্পর্ধা দেখাতো। দুষ্কৃতীরা জানতো অপরাধ করে রেহাই পাওয়া যাবে না। আজ সেই দুষ্কৃতীরাই সরকার তথা শাসক দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তাই অপরাধীর শাস্তি হয় না। খুনের চেষ্টার অপরাধ করলেও জামিন মেলে সহজে, ঠিক যেমনটা ঘটেছে রিয়াজুলের এই ঘটনায়। হিন্দুত্ববাদী এইসব দুষ্কৃতীদের আড়াল করতে রাজ্য পুলিশ জামিন যোগ্য ধারা দিয়ে মামলা সাজিয়েছে। আরএসএস’র 'দুর্গা' তার প্রিয় দেশপ্রেমিক সংগঠনের ভক্তদের জন্য এটুকু সেবা করবে এতো জানার কথা। গীতা পাঠের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ও তার প্রশাসনকে এর জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শুধু বিজেপি’র নেতারা দাবি করেন বলে তাই নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাও জানেন তাদের দলের জন্মের সময় লেবার রুম পাহারা দিয়েছে আরএসএস-বিজেপি। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এরাজ্যে আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদীদের দাপাদাপির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। রিয়াজুলরা আজ সেই পরিস্থিতির শিকার। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়ে রাজপথে মিছিল করেন। অথচ তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার কোন সদিচ্ছা তিনি বা তাঁর দলের নেই। শাসক দল তথা সরকার চায় বলেই মুর্শিদাবাদ সহ রাজ্যের বহু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় দাঙ্গা বাধে। আক্রান্ত হন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ। সরকার না চাইলে দাঙ্গা বাধতে পারে না।
কাব্যগ্রন্থ হিসাবে গীতার জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। এদেশে হিন্দু-ধর্মাবলম্বী মানুষের একটা বড় অংশ গীতাকে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মানেন এবং একান্তে বা পুজো মণ্ডপে তা পাঠ করেন। যদিও কোরান বা বাইবেলের মতো হিন্দুদের কোনও নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ নেই। হজরত মুহাম্মদ বা যীশুখ্রিস্টের মতো নির্দিষ্ট ধর্মগুরুও নেই। তাসত্ত্বেও এভাবে প্রকাশ্যে লক্ষকণ্ঠে গীতা পাঠের আসর বসানোর আসল মতলবটা কি, তা বুঝতে তো আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটা কোনও ধর্মাচরণের আসর নয়, গোটাটাই একটা রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীরা প্রগতিশীল চেতনায় অগ্রণী  বাংলার এই মাটিতে আঁচড় কাটতে চায়। বামপন্থী চেতনাকে দুর্বল করতে চায়। তাই নির্বাচনের আগে বিজেপি’র জমি তৈরি করতে রাজ্যজুড়ে ধর্মের আগুনে রাজনীতির রুটি সেঁকার কর্মসূচি নিয়েছে আরএসএস। তৃণমূল কংগ্রেসের পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। তাই ঘটা করে বসছে গীতা পাঠের আসর। ওদিকে নিয়ম করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সহজপাঠের স্কুলগুলো। এই বিপদ আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন বলেই জ্যোতিবাবু বারবার বলতেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সবচাইতে বড় অপরাধ হলো, এ রাজ্যে বিজেপি-কে ডেকে এনে জমি তৈরি করে দেওয়া।
সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, "গীতার জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত। এর কারণও বহু। গীতায় জনপ্রিয় সদুক্তি, সুভাষিতাবলী এগুলি সবই গীতাকারের রচনা নয়— বহুদিন ধরে সমাজে প্রচলিত সদুক্তিগুলির সমাহার মাত্র— জীবনের নানা অবস্থার থেকে সেসব উপলব্ধি উঠে আসে। কোনও কথার চিরন্তন মূল্য থাকলে মানুষ তা ভোলে না।" গীতার খ্যাতির একটি বিশেষ সূত্র হলো একটি সর্বজনপ্রিয় শ্লোক, "কর্মেই শুধু তোমার অধিকার, ফলে কখনোই নয়"। যে কাজ করবে ফল ভোগ করার ক্ষেত্রে তার অধিকার থাকবে না। আমাদের দেশে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে গীতার এই প্রবচন আজও সমান কার্যকর। সমাজের অল্প অংশের সম্পদশালী মানুষ এই ফল ভোগের সুবিধা পায়। শ্রমিক কৃষক সহ মেহনতি মানুষের এতে কোনও অধিকার নেই।  সুকুমারী ভটচার্য লিখেছেন, " বর্ণাশ্রম ধর্ম, নারীর সতীত্ব, রাজার সার্বভৌম আধিপত্য এবং শূদ্রের প্রশ্নাতীত হীনত্ব ও একনিষ্ঠ সেবা"— এইগুলির ওপর দাঁড়িয়ে আছে গীতা নির্দেশিত সমাজ।  হিন্দুরাষ্ট্রের নামে দেশজুড়ে গীতা বর্ণিত এই সমাজ ব্যবস্থাই কায়েম করতে চায় বর্তমান দেশের শাসক দল। তাই ধর্ম বর্ণ নানা অজুহাতে আক্রান্ত হয় রিয়াজুলরা। রাজস্থানের রুপ কানওয়ারের ঘটনার মতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে সতীদাহ প্রথা পুনরায় চালুর চেষ্টা হয়। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথের এই বাংলায় আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও বাড়তে পারে— ভাবলেই গা শিউরে উঠে। 
অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের তুলনায় গীতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য উদ্যোক্তাদের তরফে ঘোষণা করা হলো এবার গীতার ৫১২৬ তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে ময়দানে এই গীতা পাঠের মাধ্যমে। গীতার এই জন্ম তারিখ তারা কোথা থেকে পেলেন তার কোনও সদুত্তর নেই। কোরানের রচনাকাল আনুমানিক ১৪০০ বছরের কিছু বেশি। মনীষীদের মতে বাইবেলের রচনাকাল নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, কারণ এটি একটি একক বই নয় বরং দুই হাজার বছর ধরে লেখা ষাটটিরও বেশি বিভিন্ন ধর্মীয় লেখার সংকলন। এর প্রাচীনতম অংশগুলি ৩২০০ বছরের পুরানো বলে দাবি করা হয়। আর গীতার সম্পর্কে সাধারণভাবে মনীষীদের রচনা থেকে যা জানা যায়, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে এটি রচিত হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৮০০ বছর আগে এটি রচিত হয়েছে। তবু হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এই ধর্মগ্রন্থের বয়স আরও ৩৩০০ বছর বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের এই বিকৃতি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটেছে ভাবলে ভুল হবে। ঠিক যেভাবে স্কুল-কলেজের  পাঠ্যসূচিতে সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা অসন্তোষ তৈরির চেষ্টায় পরিকল্পনামাফিক ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, গীতার রচনাকাল বর্ণনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের পালটা অনিষ্টসাধনে উৎসাহিত করছে। প্রকাশ্যে গীতা পাঠের পালটা কোরান পাঠের তোড়জোড় চলছে। নিত্যদিনের জীবন জীবিকার ইস্যুগুলিকে আড়াল করে মন্দির মসজিদের হুজুকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে। সরকারি কোষাগরের অর্থ খরচ করে তৈরি হচ্ছে জগন্নাথ মন্দির, মহাকাল মন্দির, দুর্গা মন্দির। এবার পালটে তৈরি হচ্ছে বাবরি মসজিদ। আদতে এর কোনোটারই কি দরকার ছিল এরাজ্যে?
রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে বসেছে। প্রাথমিক উচ্চপ্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক হারে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমেছে। লাগামছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। এদিকে কারো নজর নেই। কারখানায় শ্রমিকের স্থায়ী কাজ বা মজুরি নেই। খেতে খামারে কৃষকের ফসলের দাম নেই। বেকার যুবক যুবতীদের হাতে কাজ নেই। আছে ডিয়ার লটারিতে সর্বস্বান্ত হওয়ার সুযোগ। আছে মাইক্রোফিনান্সের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা। আর আছে মন্দির মসজিদ গীতা কোরান পাঠের হিস্টিরিয়া। এর থেকে বাংলাকে বাঁচাতেই হবে। বাংলা বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আন্দোলন শক্তিশালী হবে। বামপন্থার পুনরুত্থান ছাড়া রাজ্যজুড়ে বেড়ে চলা হিন্দুত্ববাদীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসী মনোভাব রোধ করা সম্ভব নয়।

Comments :0

Login to leave a comment