Editorial

রাষ্ট্রসর্বস্বতা

সম্পাদকীয় বিভাগ

হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনায় অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবহে রাষ্ট্রকে যখন অতি শক্তিমান করে তোলার প্রয়াস চলে তখন অনিবার্যভাবেই নাগরিক আর নাগরিক থাকে না, হয়ে ওঠে অনুগত বাধ্য প্রজা। আর রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান করে গড়ে তুলতে জরুরি হয়ে পড়ে পুলিশি ব্যবস্থা, নজরদারি ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সর্বোপরি সামরিক ব্যবস্থাকেও অতিমাত্রায় শক্তিশালী করে তোলা। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যবস্থাপনা ক্রমবর্ধমান হারে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। দক্ষিণপন্থী তথা অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, বিরোধিতার পরিসরকে ছোট করতে শাসন এই পথ অনুসরণ করে থাকে। আসলে শাসক যখন সমগ্র জনসাধারণের স্বার্থ অপেক্ষা বৃহৎ পুঁজির মালিকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় তধন সেই সরকার তথা শাসকের বিরুদ্ধে জনমত বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী শাসনের স্বপ্ন খর্ব হবার আশঙ্কা থাকে। শাসক তখন ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে জনগণের অধিকার কাড়ার ব্যবস্থা করে। নাগরি‍কদের বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে থাকে। এভাবে নাগরিকদের বাধ্য করা হয় শাসকের আজ্ঞাবাহী হতে। এরজন্যই দরকার হয় উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আইন সংশোধন করে স্বৈরাচারী ও আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার উপযোগী করা। বর্তমান ভারতে সেই ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রকে মন্দির বানিয়ে তাতে সরকারকে দেবতারূপে প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকদের সেই রাষ্ট্র ও সরকারের অন্ধ ভক্ত বানানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক দে‍‌শের স্বাধীন নাগরিক সেই অন্ধ সরকার ভক্তি মানতে চায় না। তাই দরকার হয় কড়া চাবুকের। পুলিশি বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অতি কঠোরতার মাধ্যমে মানুষকে বাধ্য করা হয় প্রতিবাদ হীন হতে। মুখ খুললেই, প্রতিবাদ করলেই ভিন্নমত পোষণ করলেই কড়া সাজার ব্যবস্থা।
এইভাবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে শাসকের ক্ষমতাকে বলপূর্বক স্থায়ী করার জন্য অতি জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের মোড়কে অতি শক্তিমান রাষ্ট্রকে হাজির করে। এই কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রশক্তির দাপট, ঔদ্ধত্য, সীমাহীন শক্তি প্রদর্শন করতে হয়। পুলিশ খাতে রাষ্ট্রের ব্যয় যেমন বাড়াতে হয় তেমনি বাড়াতে হয় সামরিক খাতে। প্রতিনিয়ত জারি রাখতে হয় অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শত্রুর ভীতি। অর্থাৎ রাষ্ট্র শক্তিশালী না হলে রাষ্ট্রের জনগণ সব ত্যাগ করে না দাঁড়ালে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শত্রুর হাতে রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। এইভাবে ভীতি জাগিয়ে মানুষকে যেমন বশে রাখার চেষ্টা হয় তেমনি পু‍‌লিশ, আধাসামরিক ও সামরিক বাহিনীকে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়। অতিরিক্ত কাজের চাপ, বিশ্রাম ও ছুটিহীনতা দিনের পর দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা জওয়ানদের প্রবল হতাশা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্ম দিচ্ছে। তার পরিণতিতে বিগত কয়েক বছর ধরে হু হু করে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা, সহকর্মীকে খুন করার ঘটনা, সর্বোপরি চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসা।

Comments :0

Login to leave a comment