বইকথা
কলকাতার ফুটবল: ক্রান্তিকালের ইতিহাস
দেবাশিস চক্রবর্তী
নতুনপাতা
ব্রিটিশদের সেনা ব্যারাকেই চালু হয়েছিল ভারতে ফুটবল খেলা। কলকাতায় নয়, মুম্বাই ও করাচিতে। ১৮০২সালে মুম্বাইয়ে
ইংরেজ ফৌজি দলের মধ্যেই এদেশে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা হয়। কলকাতায় সেই অর্থে সংঘবদ্ধ ফুটবল
আসে দেরিতে, ১৮৫৮-র আগে তো নয়ই। পরে অবশ্য অন্য যে কোনও জায়গার থেকে কলকাতাই ফুটবলকে বেশি আপন
করে নেয়— খেলায় ও সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনযাপনের বৃহত্তর বৃত্তে।
সৌমেন মিত্রের ‘কলোনিয়াল কলকাতার ফুটবল : স্বরূপের সন্ধান’ ফুটবলকে সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করে বুঝতে
চেয়েছে। ১৯৮৮-তে এম ফিলের গবেষণাপত্র হিসাবে শুরু, ২০০৬-এ বইয়ের অবয়ব। আই পি এস অফিসার হিসাবে
সৌমেন মিত্র অতি পরিচিত, আশির দশকেই ফুটবলকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর গবেষণা অভিনবই ছিল। এ বছরে প্রকাশিত
হয়েছে বাংলা অনুবাদ। এই বইয়ে কলকাতার ফুটবলের ইতিহাস এসেছে সমকালীন সামাজিক আবর্তে সম্পৃক্ত হয়েই।
ইউরোপীয় থেকে ফুটবলের ভারতীয়ত্ব প্রাপ্তির পথে কলকাতার অভিজাত স্কুল-কলেজের দলগুলির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী নিজেও ছিলেন হেয়ার স্কুলের ছাত্র। বিস্ময়ের হলেও সত্যি যে পাড়ার ডানপিটেদের বদলে প্রেসিডেন্সি
কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের পায়েই পায়েই কলকাতার প্রথমদিকের ভারতীয়
ফুটবলের বিকাশ। এমনকি মোহনবাগানের প্রথমদিকের খেলোয়াড়দের মধ্যেও বড় অংশ ছিলো প্রেসিডেন্সির ছাত্র।
নবজাগরণের রেশ রেখেই এই বিকাশ। এও তাই স্বাভাবিকই যে উত্তর কলকাতার ‘বাবুদের’ মধ্যে এ খেলা ক্রমে জনপ্রিয়তা
পেয়েছে। শোভাবাজার রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় শোভাবাজার ক্লাব বাঙালিদের প্রথম ক্লাব, ময়দানে তারাই প্রথম তাঁবু
খুলেছিল। শহরের দক্ষিণে তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল ক্লাব, পরে সুভাষচন্দ্রও খেলেছেন এ ক্লাবে। উত্তরেই তৈরি হওয়া
‘স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ক্লাব’ ভেঙে তৈরি হলো মোহনবাগান, এরিয়ান্স। মোহনবাগানের হাত ধরেই জাতীয়তাবাদী চেতনা
মিশতে শুরু করে ফুটবলে, ১৯১১-র আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে যার চমৎকার পরিণতি।
আমাদের আলোচনার বইটিতে ১৯১১ এক পৃথক অধ্যায়ের মর্যাদা পেয়েছে। এ সংক্রান্ত বহু তথ্যই এখন বাঙালির জানা।
মোহনবাগানের বিজয়ী দলের পাঁচজন ছিলেন আদতে পূর্ববঙ্গীয়, জয়সূচক গোলদাতা অভিলাষ ঘোষও। ‘ঘটি’ পরিচিতি
তখনও মোহনবাগানের শরীরের অঙ্গ নয়। ১১জনের একজন, লেফট ব্যাক সুধীর চ্যাটার্জি ছিলেন একমাত্র বুট পরা
খেলোয়াড়। ফাইনালের দিন কলকাতা তো বটেই দূরদূরান্তের মানুষ ভেঙে পড়েছিলেন ময়দানে। কজনই বা খেলা দেখেছেন?
ঘুড়ি উড়িয়ে ফল জানানো হয়েছে- মোহনবাগান গোল দিলে সবুজ, খেলে কালো। অবিশ্বাস্য জয়ের পরে ময়দান থেকে
শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিল ও মধ্যরাত পর্যন্ত উৎসবে জাতীয়তাবাদী ধ্বনি ছিল প্রবল। কংগ্রেস যা পারেনি, মোহনবাগান যেন
তা পেরেছে— এই ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার সে-দিনের সুর। ‘বাঙালির মরা গাঙে বান এনেছে মোহনবাগান’—
লিখেছিল বসুমতী। লেখকের বিশ্লেষণ, শ্বেত জাত্যভিমানে পীড়িত ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ —যা শ্রেণি হিসেবে মিশ্র—
মোহনবাগানকে ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত করেছিলেন।
শুধু জাতীয়তাবাদই নয়, ফুটবল বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গেও মিশে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের
ভূমিকা সম্পর্কে ইতিহাসের আলো পড়বেই। তবে আমরা এও দেখেছি যে মহামেডান দ্বিতীয় ভারতীয় দল হিসাবে আই এফ
এ শিল্ড জেতে, তিরিশের দশক থেকে তাদের ময়দানে দাপট ক্রমেই বাড়তে থেকেছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই ক্লাব
সম্পর্কে অতিরিক্ত আগ্রহ যেমন ছিল, তেমনই চারের দশকে বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতাও মেরুকরণে
সহায়ক হয়েছিল। মনে হয় এ সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।
১৯২০-তে ইস্টবেঙ্গলের জন্ম পূর্ববাংলায় নয়, কলকাতায়। কিন্তু পূর্ববঙ্গীয় চেতনা যে তার জন্ম ও বিকাশের প্রধান উপাদান
ছিলো তা নামের মতোই সত্য। লেখক বলেছেন, ‘উপ আঞ্চলিকতার’ উপাদান। জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় ইস্টবেঙ্গল
কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশন খেলে, প্রথম আবির্ভাবেই মোহনবাগানকে হারিয়েও দেয়। দেশভাগের পরে ছিন্নমূল
শরণার্থীরা এপারে এসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকেও তাঁদের পরিচিতিসত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে নিয়েছিলেন। প্রাক-স্বাধীনতা
জাতীয়তাবাদ যদি মোহনবাগানের অঙ্গের ভূষণ হয়ে থাকে, উত্তর-স্বাধীনতা বাংলার সামাজিক র্যা ডিক্যালিজমে
রক্তপতাকার আন্দোলন, শরণার্থীদের বেঁচে থাকার লড়াই ও ইস্টবেঙ্গলের অভিঘাত মিলেমিশে ছিলো। আলোচ্য বইয়ে যদিও
ঠিক এই মর্মেই কোনও উপসংহার নেই। কলকাতার ফুটবল ও জাতির ভাঙা-গড়ার অন্বেষণের সমীপবর্তী ইতিহাসই এই
বইয়ের মূল সুর।
ইংরেজি বইয়ের চমৎকার অনুবাদ করেছেন দীপঙ্কর চৌধুরী।
কলোনিয়াল কলকাতার ফুটবল: স্বরূপের সন্ধানে
সৌমেন মিত্র । অনুবাদ : দীপঙ্কর চৌধুরী।
দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা। ২৫০ টাকা
Comments :0