তদন্তের গতি নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার পরেই প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শিক্ষকদেরও এবার জেরার জন্য নিজাম প্যালেসে ডাকছে সিবিআই।
শিক্ষকদের নামের তালিকা দিয়ে জেলা স্কুল শিক্ষা দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে সিবিআই। সেই চিঠিতে শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে প্রাথমিক বিদ্যালয় কাউন্সিলকে তদন্তকারী সংস্থা জেরার সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা জানিয়ে দিচ্ছে। সিবিআই থেকে চিঠি আসার পর জেলা বিদ্যালয় কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সিবিআই’র নিজাম প্যালেসে কোন দিন, কোন সময়ে উপস্থিত হয়ে জেরার সামনে দাঁড়াতে হবে তা চিঠি দিয়ে জানিয়েও দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জেলা থেকে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশ খতিয়ে দেখতে জেরার মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষকদেরও। দু’দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ভুল ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে ৩২ হাজার শিক্ষকের ‘চাকরি ফেরতের’ জন্য দেশের শীর্ষ আদালতকে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। এখন বেনিয়মের সব তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষকদের নিজাম প্যালেসে জেরায় ডাকছে সিবিআই।
রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘এরআগে জেলা স্কুল শিক্ষা দপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে একাধিক নথি সিবিআই’র তরফ থেকে চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদেরও সিবিআই জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। এবারই প্রথম নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে সরাসরি শিক্ষকদের ডাকতে শুরু করল সিবিআই।’’ তদন্তের জন্য শিক্ষকদের জেলা ভিত্তিতে ডেকে জেরার ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মানছেন শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা। জেলা প্রাথমিক কাউন্সিলকে জেরার জন্য যে তালিকা সিবিআই তুলে দিয়েছে ঘটনাচক্রে তাঁরা অনেকেই নিয়োগের পরপরই স্কুল পরিবর্তন করে নেয়।
দু’দিন আগেই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই ও ইডি’র ভূমিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা। তদন্তকারী সংস্থাকে ভুয়ো শিক্ষকদের তালিকা প্রসঙ্গে বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন, ‘‘ ভুয়ো শিক্ষকদের খুঁজে বের করার জন্য তদন্তকারী সংস্থা কী উদ্যোগ নিয়েছে তা জানাতে হবে। ওই শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করে আদালতের সামনে আনতে হবে।’’ তারপরেই যেভাবে শিক্ষকদের জেরার জন্য এই প্রথমবার ডাকার ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করেছেন শিক্ষা দপ্তরের শীর্ষ আধিকারিকরা। বিকাশ ভবন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কাউন্সিলের কাছে শিক্ষকদের তালিকা সহ চিঠি সিবিআই পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই তালিকা ধরে জেলা প্রাথমিক কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে চিঠি দিয়ে সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার জন্য জানিয়েও দিতে শুরু করেছে।
গত শনিবারই নিজাম প্যালেসে দক্ষিণবঙ্গের এক জেলার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষককে নিজাম প্যালেসে ডেকে একপ্রস্ত জেরা করেছেন সিবিআই আধিকারিকরা। জেরায় আসার আগে ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড, অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট, নিয়োগপত্র এবং পরীক্ষা ও নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত জরুরি কাগজপত্র (অরিজিনাল) নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। জেরার পর থেকে ওই শিক্ষকের মোবাইল ফোন সুইচড অফ। রাজ্য প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে ২৬৯জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছিল। ওই সময় অভিযোগ ছিল, বেআইনিভাবে এক নম্বর করে বাড়িয়ে দিয়ে নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে। সূত্রের খবর, এখন ২৬৯জনের তালিকা নিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের জেরার সামনে হাজির করাতে চাইছে সিবিআই।
এর আগে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার নিয়োগের যাবতীয় নথি সিবিআই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কাউন্সিলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়েছিল। রাজ্যে ৪২হাজার ৯৪৯টি শূন্যপদের জন্যে ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার অনলাইন আবেদন গ্রহণ করে। ২০১৬সালের সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যে নিয়োগের নোটিস জারি হয়েছিল সেই সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল এখন সিবিআই’র কাছে। সিবিআই ২০১৪ সালের টেটের জন্য স্ক্রুটিনি, ভেরিফিকেশান, ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিটিউড টেস্ট সংক্রান্ত ফাইল যেগুলি জেলা কাউন্সিলে সংরক্ষিত আছে তা গত ৩ জুলাই নিজাম প্যালেসে গিয়ে জমা দিয়ে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষা কাউন্সিলগুলি। ওই সময় সিবিআই ১০টি তথ্য নির্দিষ্টভাবে চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তারমধ্যে মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ২০১৪ সালের টেটের বিজ্ঞপ্তিতে চাকরি প্রাপকদের নিয়োগপত্র। আশ্চর্যের ঘটনা এটাই যে জেলা প্রাথমিক কাউন্সিলের কাছে নিয়োগপত্রের কোনও ফাইল বা নথি নেই। এখন তালিকা ধরে জেরায় ডাকা শিক্ষকদের নিয়োগপত্র নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
২০১৪ সালের টেট বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে তিন দফায় ২০১৭, ২০২০ ও ২০২১ সালে নিয়োগ করে মানিক ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বের রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড। টেট উত্তীর্ণদের মধ্যে থেকে ৪২ হাজার ৯৪৯জনকে নিয়োগ করে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড। ওই নিয়োগ নিয়ে পরবর্তীকালে নিয়োগ দুর্নীতির জল বহুদূর গড়িয়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে ৩২ হাজার প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকের চাকরি চলে যায়। এছাড়াও বহু বেনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এখন সেই সব তথ্য হাতে নিয়ে সিবিআই আধিকারিকরা জেরার জন্য শিক্ষকদের ডাকা শুরু করল।
Comments :0