COAL BLOCK DEATH

খাদানে না নামলে প্রতিমায় রঙ দিতেন এবারও

জেলা বিশেষ বিভাগ

COAL BLOCK DEATH

মলয়কান্তি মণ্ডল, রানিগঞ্জ

সুরজিৎ সেন, উজ্জ্বল গড়াইরা মাটির প্রতিমা গড়ার জোগাড়ের কাজ করতেন। সুরজিতের বাবা সবজি বিক্রি করতেন। উজ্জ্বলদের সাইকেল সারানোর দোকান ছিল। অভাবের সংসার। অভাবের সংসারে নুন-ভাতের যোগান দিতে কয়লা মাফিয়াদের চক্করে পড়ে অনিল কোড়ার সঙ্গে সুরজিত, উজ্জ্বলদের লাশও বেরিয়ে এলো নারানকুড়ি খনির কয়লার স্তর থেকে। 
রানিগঞ্জ কয়লা অঞ্চলে ধস গ্যাসের বিপন্নতার সঙ্গে কয়লা তুলতে নেমে প্রাণহানি নৈমিত্তিক। সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না। বাড়ির জোয়ান ছেলে অথবা কারো স্বামী কয়লা কাটতে গিয়ে মারা গেলে পরিবারের আপনজনেরা বুকের গভীরে জমা হওয়া দুঃখ নিয়ে কাঁদতেও পারেন না। চিৎকার করে কাঁদলে হুমকি দেয় কয়লা মাফিয়ারা। তৃণমূলের শাসনকালে কয়লা অঞ্চল মাফিয়াদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে।
ইসিএল’র নারানকুড়ি কোলিয়ারিতে কয়লা উত্তোলনের বরাত পাওয়া সংস্থার পাশাপাশি তৃণমূলের মদতে কয়েকশো ‘র্যা ট হোল’ সুরঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। সেখানে এলাকার ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরিব নিরন্ন মানুষকে কয়লা তোলার কাজে যুক্ত করা হয়েছিল। তৃণমূলের মদতে ইসিএল’র সমান্তরাল কয়লা উত্তোলন ও পাচার চলছে নির্বিবাদে। 
নারায়ণকুড়িতে প্রকাশ্য দিবালোকে ট্রাক্টর নামিয়ে কয়লা উত্তোলন হত। মানুষ দেখেছে। কিন্তু মুখ খোলার জো নেই। মুখ খুললে প্রাণনাশের হুমকি! সেই র্যা ট হোলের সুরঙ্গে ঢুকে যথেচ্ছ ভাবে কয়লা কাটার পর কয়লা স্তর চাপা পড়ে  মারা যান অসংখ্য গরিব মানুষ। 
রেগার কাজ বন্ধ। মানুষের হাতে কাজ নেই। বাধ্য হয়ে মৃত্যুমুখে শামিল হন তাঁরা। চাপা কান্নার রোল উঠে কয়লাঞ্চলের গরিব পরিবারগুলোতে। তৃণমূল বিজেপির সাংসদ বিধায়করা সেই গরিব পরিবারগুলির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়। কয়লা উত্তোলন কিন্তু বন্ধ হয় না। সমানতালে চলে মৃত্যু মিছিলও।


রানিগঞ্জে জিটি রোডের চিতাডাঙা মোড়ের বাঁদিকে দু’কিলোমিটার এগোলেই হরিশপুর গ্রাম। খনি প্রধান এলাকা। এখানের সমস্যা আরো গভীর। পুরো জনপদই মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই রাতে প্রচন্ড বিকট শব্দে ধস নামে। গ্রামের মানুষ সেদিন ঘর ছেড়ে রাত কাটান গাছ তলায়। দোতলা বাড়ির নিচের তলা চোখের সামনে মাটির তলে ঢুকে যায়। অনেকের বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। চোখের জল নিয়ে গ্রামের বহু পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ইসিএলের ফাঁকা আবাসনে কিছু পরিবারকে স্থানান্তরিত করা হয়। 
পার্শ্ববর্তী মাধবপুর, পরাশকোল হয়ে হরিপুর যাওয়ার রাস্তা জুড়েও ধসের ছোবল। ধস জামবাদ কোলিয়ারি, বহুলা গ্রামেও। ইসিএল উদাসীন। জামুড়িয়ার মিঠাপুর কোড়াপাড়া, সামডি সহ নতুন নতুন এলাকা ধসের তালিকায় নাম সংযোজিত হচ্ছে। ধস গ্যাসের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সিআইটিইউ অনুমোদিত ভারতের কোলিয়ারি মজদুর সভা (সিআইটিইউ)। 
কয়লাঞ্চলের মানুষের জীবন বাজি রেখে শাসকদল কয়লার কালো টাকার চক্রে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করছে। সেই লুটের আড়ালে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কয়লাঞ্চলের পরিবারগুলো। রানিগঞ্জের যেখানে সেখানে কয়লার স্তরে স্তরে আগুন জ্বলছে। মাটি ফুঁড়ে ধোঁয়া বেরচ্ছে। কয়লা জাতীয়করণের আগে স্লাটার মাইনিংকে দায়ী করা হচ্ছিল। যুক্তি দেখানো হয়েছিল কত কয়লা খনন উত্তোলন হয়েছে তার ম্যাপ, রিপোর্ট  ও নথিপত্র নেই তাই বালি ভরাট করে এলাকা সুস্থিত করা যায়নি। এদিকে আবাদী জমি অনাবাদি হচ্ছে। জলাশয়  শুকিয়ে যাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। 
কয়লাখনি কর্তৃপক্ষের সাফাই কয়লা জাতীয়করণের অতীতে অবৈজ্ঞানিকভাবে কয়লা উত্তোলনের ফলে ধস হচ্ছে। তার চেয়েও বড়ো কারণ অবৈধ কয়লা খনন, উত্তোলনের ও পাচার। 
হরিশপুর গ্রামে কিছু মানুষ ফিরে এসেছেন। তারা দাবি তুলেছেন পুনর্বাসন চাই। স্বচ্ছল মানুষেরা অন্যত্র বাড়ি করেছেন কিন্তু গরিব, ভূমিহীন মানুষ ভয়াবহতার মুখে বাড়ি ফিরেছেন। শুধু হরিশপুর গ্রামেই ৪৫০টি পরিবার পুনর্বাসনের  তালিকায় রয়েছেন। তৃণমূলের  নেতা মন্ত্রীরা এসে পুনর্বাসনের  প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।তিন বছর হয়ে গেল  প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। গ্রামের প্রবীণ নিমাই চন্দ্র রায় সরকারের প্রতি ক্ষোভ  উগরে দিয়ে বলেছেন, কেউ কথা রাখেনি।
সামনেই শারদোৎসব। কাশফুল দোলা দিচ্ছে। ছাতিম-শিউলির ঘ্রাণ। শহর গ্রামের পাড়ায় চলছে প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ। মাটির প্রতিমায় রঙে ফুটিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত শিল্পী। সুরজিত, উজ্জ্বল অবৈধ কয়লা খাদানে না নামলে হয়তো প্রতিমার চক্ষুদানের রঙ এগিয়ে দিতেন প্রবীণ শিল্পীর হাতে।

গ্রাফিক্স: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment