Disabled Persons Rally in Kolkata

অদম্য লড়াইয়েই অধিকার আদায়ের হুঁশিয়ারি প্রতিবন্ধী মানুষের সমাবেশে

রাজ্য

ছবি : দিলীপ সেন

প্রতিবন্ধী অর্থাৎ বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জীবন-জীবিকার ব্যাপারে আদৌ কোনও চিন্তাভাবনাই নেই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের। আইন বা সংবিধান অনুযায়ী প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের। অবিলম্বে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সমস্ত দাবি মানতে হবে উভয় সরকারকে। রবিবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর ডাকে রানি রাসমণি রোডে আয়োজিত সমাবেশে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু একথা বলেছেন। 
এদিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বহু মানুষ এই সমাবেশে অংশ নেন। জীবন-জীবিকার নানা দাবিতে তাঁরা স্লোগান তুলেছেন এদিন। হাতের সমস্যা, গলার সমস্যা, পায়ের সমস্যা রয়েছে অনেকেরই। সেই প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁদের দেখা গিয়েছে দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড ওপরে তুলে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এদিনের সমাবেশ ঘিরে গোটা রানি রাসমণি রোড পশ্চিমবঙ্গ প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর পতাকা, ব্যানার ইত্যাদিতে ছয়লাপ ছিল। চারদিকে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের নানাবিধ দাবির ফ্লেক্স, ব্যানারে সজ্জিত এই সমাবেশ নজর কেড়েছে পথচারী ও নিত্যযাত্রীদের।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মথুরাপুরের কৌতলা গ্রামের বাসিন্দা অলোক গায়েন, মুর্শিদাবাদ জেলার অখিলানন্দ মুখার্জিরা তাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিত্য লড়াই করেই সামাজিক ক্ষেত্রে কৃতিত্বের নজির তৈরি করেছেন। বর্তমানে অখিলানন্দ মুখার্জি পেশায় শিক্ষক, অন্যদিকে অলোক গায়েন প্রতিবন্ধী মানুষদের একজন দক্ষ সংগঠক বলে পরিচিত। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এদিনের সমাবেশে এসেছিলেন তাঁরা। প্রয়োজনীয় রসদের জোগান পেলে যে আর পাঁচজনের মতো প্রতিবন্ধী মানুষজনও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন তারই উদাহরণ এদিন দেখা গেল এদিন। 
কিন্তু সরকারি উদাসীনতা, বঞ্চনা এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্রাত্য করে রাখার অপচেষ্টার জাঁতাকলেও মাথা উঁচু করে লড়াই চালাচ্ছেন হাজার হাজার প্রতিবন্ধী মানুষ। দুর্দশার আগল ভেঙে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। রবিবার রানি রাসমণি রোড হাজার হাজার প্রতিবন্ধী মানুষের সেই লড়াকু মেজাজেরই সাক্ষী থাকলো।
সমাবেশে উপস্থিত প্রতিবন্ধী মানুষের বক্তব্য, আমরা চাই দ্রুত এরাজ্যে কেন্দ্রীয় প্রতিবন্ধী আইন কার্যকর করে আইন অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক। একশো দিনের কাজে প্রতিবন্ধীদের যুক্ত করা থেকে পর্যাপ্ত জব কার্ডের ব্যবস্থা করা এবং বাজার মূল্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রতিবন্ধীদের ভাতা বাড়ানোর দাবি রয়েছে আমাদের। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক পুনর্বাসন সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। 
সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, বিভিন্ন কারণে বহু মানুষই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। প্রতিবন্ধকতার কারণগুলিকে চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধকতা রোধে সরকারের যেমন ভূমিকা নেওয়া দরকার, পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও সরকারকে নিতে হবে। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার এই প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য ভাবিত নয়। এমনকি আইন, সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্যগুলি থেকেও বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে।
এদিনের সমাবেশে উপস্থিত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি তাঁর ভাষণে বলেছেন, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষজনও এই সমাজের অঙ্গ। তাঁদের ব্রাত্য করে রাখা ঠিক নয়। সঠিক সুযোগ সুবিধা পেলে তাঁরাও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিশ্বে এমন অজস্র নজির রয়েছে।
আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, রাজ্যের বর্তমান শাসকদল কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মেলা-খেলা-উৎসব করে। অথচ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যে মানুষগুলি প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের জন্য ন্যূনতম সুরাহার বন্দোবস্ত করেনা। সরকারের কাজ মানুষের ন্যূনতম অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু  এরাজ্যের মমতা ব্যানার্জির সরকার সেটা করছেন না। ভোট-রাজনীতির ফায়দা তুলতে যদিও বা কিছু প্রকল্প, ভাতার আয়োজন করা হয়, তার বিজ্ঞাপন ও প্রচারেই বিপুল খরচ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যে ভাতা বা প্রকল্পের বড়াই করছেন সেটা তো নাগরিকদের অধিকার। সেটা নিয়ে ব্যক্তি প্রচারের রমরমা কেন!
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার প্রতিবন্ধীদের দাবি আদায়ের মেজাজকে কুর্নিশ জানিয়ে বলেছেন, বর্তমানে শাসকদল নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মানুষের স্বার্থ দেখার সময় বা ইচ্ছে তাদের নেই। তাই জোরদার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই বার বার সরকারের কানে পৌঁছে দিতে হবে হকের অধিকারের কথা, দাবির কথা। 
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক কান্তি গাঙ্গুলি এদিন প্রতিবন্ধী মানুষের ওপর শোষণ ও বঞ্চনার নানা উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, প্রতিবন্ধীরাও এই পৃথিবীর মানুষ, এই দেশের মানুষ। সংবিধান তাঁদের যে যে অধিকার দিয়েছে তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষজন ২০১৬ সালে প্রতিবন্ধী আইন প্রণয়ন করতে সরকারকে বাধ্য করেছিল। সংসদের উভয় কক্ষেই সমস্ত রাজনৈতিক দলের সহমতের ভিত্তিতে পাশ হয়েছিল প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি জ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে তা আইনেও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এরাজ্যের শাসকদল তা কার্যকর করতে সমানে গড়িমসি করে চলেছে।
কান্তি গাঙ্গুলি বলেন, ওই আইনকে কার্যকর করার দাবিতে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন প্রতিবন্ধীরা। রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবছর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের মূল আহ্বান ঘোষণা করেছে ‘সুগম্য এবং সমতাময় সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নতুনতর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে’। এসব সত্ত্বেও কেন্দ্র ও রাজ্যের বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নীরব ভূমিকায় প্রতিবন্ধীদের জীবন-জীবিকার স্বার্থের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের বহু সমস্যা সঙ্কট আছে। সেগুলি নিয়ে আমাদের লড়াই জারি আছে। এদিনের সমাবেশ পরিচালনা করেন অনির্বাণ মুখার্জি। 

 

Comments :0

Login to leave a comment