শ্যামল কুমার মিত্র
৭টি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত যথাক্রমে ১৪, ৮৬৮ কিলোমিটার ও ৭,০০০ কিলোমিটার (সর্বমোট ২১,৮৬৮ কিলোমিটার)৷ শুধু বাংলাদেশের সাথেই ৪০২৬ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত যার বড় অংশে না আছে কোনও বেড়া, না আছে কোন বিএসএফ প্রহরা। পাকিস্তানের সাথে ৩,৩২৩ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সুসম্পর্ক এখন অতীত। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় কোনও দেশ নেই, যে দেশ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরাসরি ভারতের পাশে থাকবে। দেশের অভ্যন্তরে সেনার ব্যবহার বাড়ছে। শুধু তাই নয়,একসাথে ৩টি ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছু নয়। এই পরিস্থিতে সেনা দুর্বল হয়, এমন যে কোনও সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, একই সাথে বিপজ্জনক।
ভারতীয় সেনা বিশ্বের দ্বিতীয় বড় সেনা বাহিনী যার সদস্যসংখ্যা ১২ লক্ষ। বছরে ৫৫ হাজার সেনাকর্মী অবসর নেন, বছরে গড়ে ৬০ হাজার নিয়োগ হয় সেনায়। দেশের সর্ববৃহৎ নিয়োগকারী সংস্থা সেনা। ভারতীয় সেনা জওয়ানদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি, পেশাগত নৈপুণ্য, শৃঙ্খলাবদ্ধতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ সারা বিশ্বে উচ্চ প্রশংশিত। এর কারণ উন্নত মানের দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য সেনা প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। সেনায় ১ জন জওয়ানকে ৭বছর ধরে চূড়ান্ত শেশাদার এবং ভয়ঙ্কর কঠিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, জওয়ানরা প্রশিক্ষণে সফল হলে তাদের যুদ্ধক্ষেত্র সৈনিকদের সহায়ক হিসাবে নিয়োগ করা হয়।
সৈনিকদের সহায়কের ভূমিকায় নিয়োগ করা হয় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য৷ তারপর তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে। এত দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ খুব দেশের সেনায় হয়। একজন সেনা জওয়ান ১৫ বছর চাকরি করার পর যখন অবসর নেন, একজন সেনা জওয়ানের ৭ বছরের প্রশিক্ষণ সমৃদ্ধ ১৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা হারায় সেনাবাহিনী। একজন সেনা জওয়ান নিয়মিত কঠোর অনুশীলন, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, পুষ্টিকর ও সুষম আহার, কর্মোপযোগী পরিবেশ, সার্বিক একাত্মবোধ এবং দেশের জন্য কাজ করার আবেগ— সব মিলিয়ে অবসরের সময় সমবয়সি অসামরিক ব্যাক্তিদের থেকে অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিকভাবে তাজা ও কর্মতৎপর থাকেন।
দেশের প্রয়াত প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত সেনা জওয়ানদের ৩২ থেকে ৩৬ বছরে অবসর দেওয়ার নিয়মের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন ,এই জওয়ানদের মতো দক্ষ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ মানব সম্পদকে সেনা আরও ১৫ বছর ব্যবহার করলে সেনারই লাভ। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ৬২ বছর বয়সে যদি একজন সেনা অফিসার সেনা প্রত্যাশিত তৎপরতা, দক্ষতা, মান ও গতিতে সার্ভিস দিতে পারেন, তাহলে কোন যুক্তিতে ৩২ থেকে ৩৬ বছর বয়সের পর একজন সেনা জওয়ান তা দিতে পারবেন না? তিনি সরকারকে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেনা জওয়ানদের অবসরের বয়স ৫৮ বছর করা হোক। বিপিন রাওয়াতের মতো দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সর্বোচ্চস্তরের একজন সেনানায়ক নিশ্চয় সব দিক ভেবেচিন্তেই এমন প্রস্তাব দিয়ে থাকবেন। সেনা জওয়ানদের অবসরের বয়স এবং সেনাবাহিনীর গড় বয়স কি হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে সেনাবাহিনীতে অবশ্য নানারকম মত রয়েছে।
অন্যদিকে যুদ্ধ মানুষের ক্ষতি করে। এ বিশ্ব যুদ্ধ মুক্ত হলে সব থেকে ভালো হতো। বিশ্বে যুদ্ধ ও সামরিক ক্ষেত্রে যে বিপুল ব্যয় হয়, সেই অর্থ জনকল্যাণে ব্যবহৃত হলে বিশ্বের চেহারাটাই বদলে যেত। কিন্তু আক্রমণ, আগ্রাসন, যুদ্ধ যখন বাস্তব, তখন কোনও দেশই সামরিক ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দে কোনোরকম কার্পণ্য করে না দেশের স্বার্থে। কিন্তু ২০২২ সালে সেনায় গড় বয়স হ্রাস এবং সেনার জন্য ব্যয় হ্রাস এর কারণ দেখিয়ে মোদী সরকার ২০২২ থেকে ‘লেফটেন্যান্ট’ স্তরের নিচে সমস্ত স্থায়ী পদে নিয়োগ বন্ধ করে, একমাত্র 'অগ্নিপথ' প্রকল্পের মাধ্যমে সেনায় নিয়োগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে সে সময় (২৬ ফেব্রুয়ারি) বলেন, "এই ব্যবস্থা অমানবিক, সেনার মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে, সেনার জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেবে।"
বাস্তব হলো সেনা ও দেশের স্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প প্রত্যাহার ও সেনায় বিপুল শূন্যপদ পূরণের দাবিতে কোনও অ-বিজেপি দল একক/যৌথভাবে কোনও গণআন্দোলন, গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়নি। এই প্রকল্পে ১৭ থেকে ২১ বছরের যুবদের সেনায় ৪ বছরের জন্য ‘অগ্নিবীর প্রকল্প’-এর অধীনে নিয়োগ দেওয়া হবে। বছরে ৪৬ হাজার অগ্নিবীর নিয়োগ হবে, এর ৭৫শতাংশ (৩৪,৫০০) ৪ বছর পরে ২৫ বছর বয়সে অবসর নেবেন। বাকি ২৫শতাংশ, (১১,৫০০) ৪ বছর পরে স্থায়ী সেনাকর্মী হিসাবে নিযুক্ত হবেন। স্থায়ীপদে অন্য কোনও নিয়োগ হবে না।
এর ফল কি হতে চলেছে? প্রথমত, ১ জানুয়ারি, ২০১৯ সেনায় শূন্যপদ ছিল ১,০৪,৬৫৩। ২০১৯ থেকে ২০২৩ এই ৪ বছরে স্থায়ী পদে কোনও নিয়োগ হয়নি। ২০২৫ পর্যন্ত স্থায়ী পদে কোনও নিয়োগ হবেও না। বছরে গড়ে ৫৫ হাজার অবসরের ফলে ১ জানুয়ারি, ২০২৬-এ সেনায় শূন্যপদ হতে চলেছে (১,০৪,৬৫৩ + ৫৫,০০০x৭) ৪,৮৯,৬৫৩৷ ১২ লক্ষ সেনার কাজ ৭ লক্ষ সেনা দিয়ে কতটা সম্ভব? আপৎকালীন সময়ে সেনাকে সাহায্য করতে পারে যে কেন্দ্রীয় অসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী সেখানে ১ জানুয়ারি, ২০২২-এ শূন্যপদ ছিল ২,৫০,০০০৷ যুদ্ধ করার মো পরিস্থিতিতে পড়তেই পারে ভারত, তখন সেনা ও অসামরিক প্রতিরক্ষায় এই বিপুল সংখ্যায় শূন্যপদ ভারতকে যথেষ্ট বে-কায়দায় ফেলবে তা বলাই বাহুল্যমাত্র৷
দ্বিতীয়ত, ২০২৬ থেকে বছরে ১১,৫০০ করে অগ্নিবীর স্থায়ী পদে নিযুক্ত হবেন, অবসর নেবেন অনেক বেশি সংখ্যায় সেনা। তাই ২০২৬-এর পর থেকে ৭,১০,৩৪৭, সেনাবাহিনীর এই সংখ্যা প্রতি বছর কমতেই থাকবে।
তৃতীয়ত, ৪ বছর মেয়াদি অগ্নিবীর'দের ৬ মাসের তথাকথিত নাম-কা-ওয়াস্তে প্রশিক্ষণ দিয়ে সরাসরি যুদ্ধে পাঠানো হবে। ৭ বছরের প্রশিক্ষণ শেষে সৈনিকদের সহায়ক হিসাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের বিকল্প মাত্র ৬ মাসের প্রশিক্ষণ? যে দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধ হতে পারে ,তারা সেনা সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রশিক্ষণের সময়সীমা ও মানের নিরন্তর উত্তরণ ঘটিয়ে চলেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক প্রশিক্ষিত শত্রু সেনার সঙ্গে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ সম্বল ৪ বছর মেয়াদি ঠিকা কর্মীরা কোন জাদুমন্ত্রে পাল্লা দিয়ে লড়বেন?
চতুর্থত, ২০২৬ থেকে বছরে ৬০ হাজারের বদলে ১১,৫০০ অগ্নিবীর স্থায়ীপদে নিযুক্ত হবেন, অর্থাৎ বছরে ৪৮,৫০০ স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ কমছে। যে দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ ২৪ বছরের কম বয়সের, ৬৫ শতাংশ মানুষ ৩৫ বছরের কম বয়সের, মানুষের গড় বয়স ২৭.৫ বছর। বর্তমানে বেকারি স্বাধীনতার পরে সর্বোচ্চ, সরকারি এবং বেসরকারি নিয়োগ কার্যত শূন্য। সেই দেশে বছরে ৪৫,৫০০ নিয়োগের সুযোগ কমিয়ে কর্মপ্রার্থীদের চূড়ান্ত হতাশ করে বেকারের সংখ্যা বাড়িয়েছে সরকার।
পঞ্চমত, ৪ বছর পর অবসরপ্রাপ্ত অগ্নিবীররা কোনও পেনশন পাবেন না, পাবেন ৪ বছর চাকরি কালে প্রতিমাসে বেতন থেকে ৩০ শতাংশ হারে কেটে নেওয়া অর্থ ৫,০৪,০০০ টাকা (সুদ ছাড়া) এবং সরকারের দেওয়া ৬, ৬৭,০০০ টাকা। ৪ বছর চাকরির পর প্রতিবছর ৩৭, ৫০০ অগ্নিবীর ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সে কাজ হারিয়ে নতুন করে কাজের বাজারে ভিড় জমাবেন। কর্মহীন থাকা, আর ২৫ বছর বয়সে কর্মরত অবস্থায় নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়া, মাসিক আয় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া, এসব সমস্যা তো এর সঙ্গে যুক্ত হবেই। এই ৪ বছর কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কোনোরকম পড়াশোনা বা প্রস্তুতির সুযোগ পাবেন না তারা, ফলে ধরে নেওয়াই যায়, কর্মসংস্থানের তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে এই সব অগ্নিবীররা নতুন করে কোনও কাজ জোগাড় করতে পারবেন না। এমনিতেই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মীদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষিত পদগুলির ৯২-৯৫ শতাংশ সর্বদা শূন্য থাকে, নিয়োগ হয় না। সরকার সেনার জন্য সংরক্ষিত পদগুলিকে কর্ম সঙ্কোচনের 'কৌশল' হিসাবে ব্যবহার করে, তখন এই সব ৪ বছরের অগ্নিবীর নামের ঠিকাকর্মীদের অবসরের পর সরকারি দপ্তরে নিয়োগ নিতান্তই কষ্টকল্পনা। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীদের নিয়োগের কথা বাদই দিন, অবসরের সময় সেনাবাহিনী অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের যে স্নাতক ডিগ্রি দিয়ে থাকেন, সেটিরই কোনও মান্যতা দেয় না কোনও সরকার।
ষষ্ঠত, বছরে সাড়ে ৩৭ হাজার করে অস্ত্র চালানোয় সক্ষম অগ্নিবীররা কর্মসংস্থানহীনতার রূঢ় বাস্তবে, স্রেফ পেটের দায়ে, রাষ্ট্রের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তা কি ভেবে দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী? এই বিপুল সংখ্যায় কর্মহীন যুব বাহিনী সরকারি বঞ্চনার প্রতিবাদে কোনও উগ্র অতিবাম বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে নাম লেখালে কি অবস্থা তৈরি হতে পারে তা কি ভেবেছেন মোদীজী? সেনার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে অবিলম্বে এই প্রকল্প প্রত্যাহার এবং সেনা ও অসামরিক প্রতিরক্ষায় সমস্ত শূন্যপদ আগের পদ্ধতিতে পূরণ করা প্রয়োজন। দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে ফাটকা চলে না, কোনও অবাস্তব চিন্তার অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ চলে না।
Comments :0