রুহুল আমিন গাজী
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে উন্নত জাতির সঙ্গে পিছিয়ে পড়া এবং সেইসঙ্গে ভাষাগত ধর্মগত, বর্ণগতভাবে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পতনের পর সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়। এর মোকাবিলা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা উন্নত পুঁজিবাদী দেশে জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করে জনগণের স্বার্থে বহুমুখী উন্নয়ন সহ তাদের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল-বলেছিলেন" সংখ্যালঘুদের যদি কেবল সংখ্যার জোরে দমিয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রভুত্ব করতে চায় তবে তা হবে মানব সভ্যতার পক্ষে অপমান"। এটা এই মুহূর্তে ভারতের ক্ষেত্রে সমানভাবে সত্য।
ভারতের পার্লামেন্টে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীদের দেওয়া সব সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল করে এবং সংসদীয় কমিটির কাছে ১ কোটি ২০ লক্ষ নাগরিকের পাঠানো চিঠিকে কোনও আমল না দিয়ে অগ্রাহ্য করে স্বৈরতান্ত্রিক পথে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পার্লামেন্টে এবং রাজ্যসভায় সংশোধিত আইন পাশ করিয়ে নিয়েছেন।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে কতটা ভালো-মন্দ এবং সংবিধানসম্মত হয়েছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে দেশজুড়ে সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংঘটিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে সংশোধিত আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে ৭০ টি বেশি মামলার শুনানিতে বুধবার সুপ্রিমকোর্ট তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন- ১) আপাতত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে নতুন কোনও নিয়োগ নয় ২) যেসব সম্পত্তি ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে চিহ্নিত তা ওয়াকফের তালিকায় থাকবে ৩) বিরোধী ও ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে জেলাশাসক প্রক্রিয়া চালাতে পারবে তবে, তা কার্যকর হবে না। আগামী ৫ মে সুপ্রিম কোর্টে আবার শুনানি হবে।
সারাদদেশ জুড়ে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উত্তাপ কিছুটা বুঝে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছেন ওয়াকফ বোর্ড অমুসলিমদের নিয়োগ এবং ওয়াকফ বলে চিহ্নিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ধরার প্রয়োগ আপাতত কার্যকরী হবে না।
মোদী সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্বাধীনতার পর ১০৫০ সালের সংবিধানে বিভিন্ন ধারায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট কিছু অধিকার প্রদান করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্যের কারণে বারে বারে তা লঙ্ঘিত হয়েছে এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে অবজ্ঞা অবহেলা করে ঠান্ডা করে তা ফেলে রাখা হয়েছিল। সংবিধানের ১৫ (৪),১৬(৪) ধারায় আর্থিক সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার বহু বছর কার্যকরী করা হয়নি। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নম্বর ধারায় "ধর্মের স্বাধীনতা অনুসারে ভারতের প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ধর্মাচরণ অনুশীলন এবং প্রচার করার অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে রাষ্ট্র বা অধীনস্ত কোনও সংস্থ্য এই প্রশ্নে কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাত শূন্যতার মনোভাব অবলম্বন করতে হবে। রাষ্ট্র সব ধর্মের প্রতি সমমনোভাব গ্রহণ করবে কোন কোন ধর্মকে পছন্দের ভিত্তিতে কাছে দূরে, কোলে পিঠে পক্ষপাতমূলক আচরণ করা যাবে না, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো চলবে না।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দুত্ববাদের উত্থান থেকে সাম্প্রদায়িকতা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা, গুজরাটের গণহত্যা, গোহত্যা বন্ধ, অনুপ্রবেশ নিয়ে সংশোধিত নাগরিক আইন, ১৯৯১ সালে পার্লামেন্টে পাশ হওয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের পরিবর্তন করা যাবে না সংক্রান্ত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বর্তমান বিজেপি সরকারের বদান্যতায় ১৮টি মসজিদের তলায় মন্দির খোঁজার হিড়িক এবং তা নিয়ে আবার সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ। পার্লামেন্টে মোদী এবং অমিত শাহের উপস্থিতিতে বিএসপি সংখ্যালঘু এমপি দানেস-কে কুৎসিত ভাষার গালাগালি করা, অপমানসূচক কথাবার্তা বলা, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি সংখ্যাগরিষ্ঠের দাম্ভিকতা প্রকাশ করে সংখ্যালঘু সম্পর্কে অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রকাশ করে মন্তব্য এবং সামান্য ডায়েরি করে রাজ্য বিজেপি সরকার বুলডোজার দিয়ে নির্বিচারে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় যা কোন সভ্য দেশে হয় না। এসব আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এপ্রিলে পার্লামেন্ট ও রাজ্যসভায় ওয়াকফ সংশোধনী আইন স্বৈরতান্ত্রিক পথে পাশ করিয়ে নিয়ে কার্য করার চেষ্টা কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়, দেশে তাদেরকে দ্বিতীয় নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করে বেঁচে থাকা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া ও রক্ষা করার ব্যাপারে প্রশাসন শুধু নির্বিকার নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ আক্রমণকারীর পক্ষ নিয়েছে।
হজরত মুহাম্মদের আমল থেকে ১৪০০ বছর ধরে জ্ঞানীগুণী, অর্থবান মুসলিমরা ফেরত না নেওয়ার মানসিকতা থেকে চিরতরে সম্পদ দান করে গরিব দুঃস্থ নারী-পুরুষদের আর্থিক সহায়তা দান, সব ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মাজার, মাদ্রাসা ইত্যাদির উন্নয়ন এবং সাধারণ জনগণের শিক্ষা স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বহুমুখী উন্নয়নে ওয়াকফের অর্থ ব্যয় হবে। এটাই তো দানের আসল লক্ষ্য। সেখানে দান করার জন্য কতগুলো ধর্মীয় শর্ত পালনের কথা বলা হচ্ছে। ধর্ম পালনের সার্টিফিকেট নিতে হবে এসব চূড়ান্ত অপমান ও অমর্যাদা। অ-মুসলিমরা মনে করলে দান করতে পারবে না। এই বিল পাশের আসল লক্ষ্য হলো ধর্মীয় বিভাজন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে ধ্বংস করে কেন্দ্র সরকারকে সামনে রেখে হিন্দু রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড চাপিয়ে দেওয়া। বিজেপি সরকারের মুসলিম প্রীতি দরদ নিয়ে মুসলিম মহল্লায় হাসি ঠাট্টা মশকরা ও ঘৃণা উগরে দেওয়া হয়। কেন? দিল্লিতে রাস্তায় জোহরের নামাজের লাইনে দাঁড়ানো নামাজিকে পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, ধর্মপ্রাণ মুসলমান আজমীর শরিফে যাওয়ার পথে মাঠে নামাজ পড়ার করার সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এসে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে, মোজাফফরনগরের একটি স্কুলে দিদিমণি একজন মুসলিম ছাত্রকে লঘু অপরাধে দাঁড় করিয়ে অন্যান্য ছাত্রদের দিয়ে চড় মারাচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর ঘৃণার ভাষণ এইসব নিকৃষ্টমানের সামাজিক অত্যাচারকে উৎসাহ দিচ্ছে। সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকর সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমত শাহের নিকৃষ্ট কুৎসিত মন্তব্য, হরিয়ানায় দুই দলিত শিশু পুত্রকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা নিয়ে বিদেশ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ও প্রাক্তন সেনাপ্রধান ডি কে সিং-এর বিস্ফোরক মন্তব্য ‘কেউ কুকুরকে চিল ছুড়ে মারলে সেটা কি সরকারের দায়’।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে সংখ্যালঘুদের সংবিধানগত অধিকার রক্ষা করার দায় বিন্দুমাত্র স্বৈরাচারী সম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের নেই। গোরু মরলে শকুন খুশি হয় তেমনই দেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে বিজেপি’র ভোট বাড়ে ক্ষমতা আসা সহজ হয়। মানবতাহীন পৈশাচিক বর্বরোচিত ঘটনা হলো বিজেপি সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব রাজনৈতিক প্রকল্প।
রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের কাজকর্ম সমালোচনার উর্ধ্বে নয় খুবই বিতর্কিত। ওয়াকফ বোর্ডের কাজকর্ম আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট। ওয়াকফ বোর্ড কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। ওয়াক বোর্ড হলও ধর্মনিরপেক্ষ একটি আইনি সংস্থা যার দায়িত্ব আইন দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য চিফ এসকিউটিভ অফিসার থাকেন। যিনি রাজ্য সরকারের দ্বারা নিযুক্ত প্রথম শ্রেণির অফিসার। তিনি ওয়াকফ বোর্ডের কাজকর্ম পরিচালনার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের নিচের স্তরে মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন ধরনের ও চরিত্রের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে মূলত মোতায়ালী বা পরিচালন কমিটি বা ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এই কমিটিকে প্রতি বছর রাজা ওয়াকফ বোর্ডের কাছে আয়ব্যয়ের হিসাব প্রদান করতে হয়। জনস্বার্থে ওয়াকফ সম্পত্তি দিয়ে সার্বিক উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সংঘটিত করার ব্যাপারে বেনিফিসিয়ারিদের বা ভুক্তভোগীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামো নেই বললেই চলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনোনীত। এই সমস্ত মোতায়ালীরা নিদিষ্ট মেয়াদের বাইরে বহু বছর ধরে একটি স্থানে থাকে মৌরসিপাট্রাদার হিসাবে। এই সমস্ত কর্তৃপক্ষর ট্রাইবুনাল বা কোর্টে মামলা করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে অন্যায়ভাবে সম্পত্তির ভোগ দখল করে। বোর্ড নিয়োজিত বেশিরভাগ মোতায়ালীগণ সম্পত্তি থেকে যা প্রকৃত আয় হয় তা গোপন করে কম দেখায়। রাজা ওয়াকফ বোর্ডের হতক্ষেপ যথেষ্ট শিথিল ও দুর্বল। বোর্ডের কর্মচারীদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের জন্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সঠিক সময়ে হস্তক্ষেপ হয় না। ওয়াকফ বোর্ডের সঠিক নজরদারির অভাবে বহু ম্যানেজমেন্ট কমিটি ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে বেশিরভাগ সম্পত্তি বেআইনি দখল হয়ে আছে। ওয়াকফ সম্পত্তি জবর দখল আত্মসাৎ ও বিলোপ সাধন গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বহু স্থানে অসৎ মোতায়ালী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের সাহায্যে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে ও জালিয়াতি করে লুটপাট করে খাচ্ছে। ভূমি আধিকারিকের সাহায্য নিয়ে বহু সম্পত্তির অনেক মোতোয়ালী হয় নিজের পরিবারের নামে রেকর্ড করে নিয়েছে বা বিক্রি করে দিয়েছে বা সেখানে কোনও নির্মাণ কাঠামো করে ভাড়া দিয়ে লুটপাট করে খাচ্ছে। রক্ষক যথার্থ ভক্ষক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওয়াকফের খুবই ক্ষতি করেছে। তাই ওয়াকফের ইচ্ছা অনুসারে মুসলিম সমাজের উন্নয়নের কাজ সফল হয়নি। সম্পত্তির লোভ, আইনের জটিলতা, আদালতের দীর্ঘসূত্রতা মুসলিম জনগণের অজ্ঞতা, প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং সমাজের দুর্নীতিপরায়ণতা এসব ওয়াকফের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে বাধ্য সৃষ্টি করে। দুঃখের হলেও সত্য কিছু মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মুসলিম ব্যক্তি মহৎ সৎ ধার্মিক নিষ্ঠাবান মুসলিমদের দান করা সম্পত্তি আপন স্বার্যে কাজে লাগিয়ে বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক উন্নয়নকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
রাজ্য সরকার ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড একযোগে জনস্বার্থে উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা যদি না থাকে তবে বোর্ডের মদতে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা স্বার্থান্বেষী ও জনবিরোধী কাজকর্ম হতেই থাকবে। গত ১৩ বছরে এ রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময়ে রাজ্যের ভূমি সংস্কার মন্ত্রী আব্দুল রেজ্জাক মোল্লা থাকাকালীন গুরুত্ব দিয়ে জমির জরিপ ও সমীক্ষা করে এবং সঠিকভাবে জবরদখল উচ্ছেদ করে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে এনে চিহ্নিতকরণের কাজ করেছিল। ২০১০-১১ সালে রাজ্যে মোট ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল ৮০,৪৮০ টি। গত ১০ বছরে যুক্ত হয়েছে মাত্র ২০৯ টি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলির আয় লাগাতারভাবে বেড়ে হয়েছিল ৪ কোটি টাকার বেশি। আর ২০২৩-২৪ সালে সেই আয় কমে হয় ১০ লক্ষ টাকার মতো। বেআইনিভাবে দখল হয়ে আছে ৩৩৬৫ টি। শাসক শ্রেণির লোকেরা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্থানীয়ভাবে মোতায়ালীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক বজায় রেখে চূড়ান্তভাবে লুট করে খাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওয়াকফ সম্পত্তি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মোতায়ালীরা কোনও হিসাব বোর্ডের কাছে ঠিকমত দেয় না। বোর্ডের প্রাপ্য ৭ শতাংশ টাকা ঠিকমত বোর্ডের কাছে জমা পড়ে না। তাহলে ওয়াকফ সম্পত্তির আয়ের টাকা কোথায় গেল? মূলত শাসক শ্রেণির লোকেরা মোতায়ালীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক বজায় রেখে ভাগবাটোয়ারা করে খাচ্ছে। ইমাম পরিষদের সচিব রইচ উদ্দিন বলেন মুসলমানদের জন্য এত দরদের কথা বলে। কিন্তু কোটি কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে। আর মুসলমানদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে”।
মাথায় ব্যথা ও যন্ত্রণা হচ্ছে বলে কেটে ফেলাটা সমাধান নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। দেশ জুড়ে বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি হচ্ছে। মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মানুষ সর্বত্র শাসক শ্রেণির প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছে এই ব্যবস্থার বিহিত হওয়া দরকার। কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতি রোধে সঠিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকারি আধিপত্য কায়েম করে বিভাজনের ও মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছে। এসব না করে ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের যা করা উচিত।
১) দেশজুড়ে ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা বিকাশ ও প্রগতির জন্য এবং জনস্বার্থে উন্নয়নের পরিকল্পিত ভাবনাকে কার্যকর করার জন্য সচেতন মুসলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
২) ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহারের পদ্ধতিগত সংস্কার চাই।
৩) রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড ও স্থানীয় স্তরে মোতাওয়ালী নয়, পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
৪) ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে ও সমীক্ষার কাজ জনগণের সাহায্য নিয়ে নিয়মিত হওয়ার দরকার।
৫) ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য পরিকল্পিতভাবে জনগণের সাহায্য নিয়ে অভিযান চালাতে হবে।
৬) ওয়াকফ সম্পত্তিতে এমনভাবে উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতিগত মানের বিকাশ ঘটে এবং সমাজকল্যাণের একটা গণতান্ত্রিক মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে।
৭) দেশে একটা NAtional wakf Development Bank স্থাপন করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
৮) যে সব সম্পত্তি ওয়াকফের নামে আছে কিন্তু সুদীর্ঘ বছর ধরে জনস্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট ইত্যাদি হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে তার অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা দরকার।
Comments :0