গত বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গকে ভেঙে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে নিয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার জোর জল্পনা চলছে। একটার পর একটা ঘটনাক্রম থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তলায় তলায় গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাগের লক্ষ্য নিয়ে। নানা মহলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চর্চা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতারা এবং কেন্দ্রীয় সরকার ঝেড়ে কাশছে না। অদ্ভুত এক নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের আচরণে। রাজ্য বিজেপি নেতারা বোকা বোকাভাবে বলছে রাজ্য ভাগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তাদের জানা নেই। অর্থাৎ রাজ্য ভাগ নিয়ে রাজ্য নেতাদের কোনও অবস্থান বা মতামত নেই। মোদী-শাহ’রা যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই তারা মেনে নেবেন। স্পষ্ট করে বললে রাজ্য বিজেপি’র বাংলা ভাগে আপত্তি নেই। মোদীরা যদি ভাগ করে তারা মেনে নেবে। যদি নীতিগতভাবে রাজ্য বিজেপি রাজ্য ভাগের বিরোধী হতো তাহলে কারও মুখের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিত। তা না করে বাংলা জো-হুজুরে নেতারা মোদীর মরজির উপর আস্থা রেখে বসে আছে।
ফ্যাসিবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হিন্দুত্ববাদী বিজেপি চায় কেন্দ্রীভূত শাসন ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। বহুত্ববাদী ভারতকে এক চাবুকের তলায় রেখে শাসন করতে চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাদের ভীষণ অপছন্দ। রাজ্যগুলির ক্ষমতা, অধিকার যথাসম্ভব কমিয়ে কেন্দ্রের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে চায়। রাজ্য বড় হলে এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে তাদের প্রভাব বেশি থাকে। তাই রাজ্যগুলিকে নানা অজুহাতে ভেঙে ছোট ছোট করে তাদের দুর্বল ও কেন্দ্র নির্ভর করে তুলতে চায়। পাশাপাশি রাজ্যগুলির একাংশ ছেঁটে নিয়ে পৃথক রাজ্য না করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বানিয়ে সরাসরি কেন্দ্রের শাসনাধীন করতে চায়। যেকোনো অতি দক্ষিণপন্থী উগ্রজাতীয়তাবাদী দলই এমন আদর্শ অনুসরণ করে। বিজেপি’ও সেটাই করছে।
রাজ্য বিজেপি’র একাংশ ঢাক-ঢাক, গুরু-গুরু মনোভাব প্রদর্শন করলেও অন্য অংশ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নেতারা সরাসরি বাংলাভাগের পক্ষে সওয়াল করছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ অধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা ভাগের অন্যতম প্রবক্তা গ্রেটার কোচবিহার নেতা অনন্ত মহারাজ বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনশালের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে এসে বলেছেন খুব শীঘ্রই বাংলা ভাগ করে গ্রেটার কোচবিহার হতে চলেছে। তিনি এমনটাও জানান এব্যাপারে নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন। অনন্ত মহারাজের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনেও নিশীথ টু’শব্দটিও করেননি।
রাজ্য বিজেপি’র একাংশ উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার জোরালো দাবি দীর্ঘদিন ধরেই করছেন। অন্য অংশ স্পষ্ট করে কোনও অবস্থান জানাচ্ছে না। আর অনন্ত মহারাজ বলে চলেছেন রাজ্য ভাগ হচ্ছেই এবং খুব শীঘ্রই। অথচ রাজ্য নেতারা এর পক্ষেও বলছে না, বিরুদ্ধেও বলছে না। কিন্তু অনন্তর সঙ্গে দহরম মহরম বজায় রাখছে।
কিছুকাল আগে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল অনেকটা নীরবে উত্তরবঙ্গ সফর করে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে রাজ্য ভাগের পরিস্থিতি যাচাই করে গেছেন। এই ভদ্রলোকের পরামর্শেই কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে এবং দু’ভাগ করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে।
সেই দোভাল এখন পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করে উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই মতো কেন্দ্র এগোচ্ছে।
তৃণমূল মুখে বাংলাভাগের বিরোধিতা করলেও বাস্তবে সব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। তাই তৃণমূল বাংলা ভাগ রুখবে না বা রুখতে পারবে না। একাজ বামপন্থীদেরই। সিপিআই (এম) মনে করে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পর আর রাজ্য ভাগের প্রয়োজন নেই। রাজ্য ভাগ করে শাসকের সুবিধা হয় এবং সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের সুবিধা হয়, সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হয় না। উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, কাশ্মীর ভাগ করার পর তা প্রমাণ হয়ে গেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করার সবরকম চক্রান্ত বামপন্থীরা ব্যর্থ করে দেবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।
Comments :0