বরাবরই দু’টি ভারত তৈরির চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদী। ধর্মের নামে তো বটেই, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পৃথক ভারত নির্মাণের চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তামিলনাডুর মাদুরাইয়ে শনিবার মোদী সরকারকে তুলোধনা করে একথা বলেছেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। মেলুরের সুবিশাল জনসভায় বিজেপি’র মুখোশ খুলে দিয়ে আরও একবার ইয়েচুরি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘দেশের মৌলিক চরিত্র আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতার পর এই এতগুলো বছরে দেশবাসী যা যা অর্জন করেছেন, স্বৈরাচারী এই সরকার তার সবই ধ্বংস করে দিয়েছে। এই নির্বাচন তাই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।’
প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জনসভায় ধর্মীয় মেরুকরণের প্ররোচনা দিয়ে চলেছেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে ইয়েচুরি কটাক্ষ করেছেন, ‘উনি ভোট প্রচারে বলছেন যে সব রাজনৈতিক দল রামমন্দির উদ্বোধন বয়কট করেছে, তারাই নাকি রামনবমীর মিছিলে পাথর ছুঁড়তে মদত জোগায়। যারা পাথর ছোঁড়ে তাদের সুরক্ষাও দেয়। দেশের সব ধর্মের প্রত্যেক নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তো প্রধানমন্ত্রীর। ধর্মবিশ্বাস নিজস্ব ব্যাপার, ব্যক্তি পছন্দের বিষয়। সেই বিশ্বাস, সেই পছন্দকে তো শ্রদ্ধা করা উচিত। সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীরই এগিয়ে আসা উচিত। অথচ উনি বিভাজনমূলক প্রচার করছেন, অন্যের ঈশ্বরের চেয়ে তাঁর ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ। একে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে না, সাম্প্রদায়িকতা বলে।’ আমিষ-নিরামিষ খাবারকে কেন্দ্র করেও দেশকে দু’ভাগে ভাঙতে চাইছেন মোদী, বলেছেন সিপিআই(এম)-র এই প্রবীণ নেতা। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘বাস্তব হলো দেশের ৭৯ শতাংশ আমিষ খাবার খান। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রীর ভারত আলাদা ভারত? অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে প্রতিটি বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী মেরুকরণের বার্তা দিয়ে চলেছেন।’ ইয়েচুরি বলেন, ‘আমাদের দেশ সব ধর্মের মানুষের দেশ। প্রত্যেকের সমঅধিকার সংবিধান স্বীকৃত। সেই সংবিধানের উপর যথেচ্ছভাবে আঘাত হানে মোদী সরকার। সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু তা কোনওভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।’ মোদী সরকার কীভাবে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, তার উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রের বিরোধিতা করলেই তাকে জেলে পুরে দেওয়া রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। কোনও বিচার প্রক্রিয়া ছাড়া, চার্জশিট ছাড়া পাঁচ-ছ’বছর ধরে জেলে আটকে রাখা হয় দেশবিরোধী তকমা দিয়ে। এটা গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবেই ব্যক্তি অধিকার, নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সংবিধানকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।’
ইয়েচুরির কথায় উঠে এসেছে কীভাবে মোদী তাঁর পুঁজিপতি বন্ধুদের হাতে দেশের সমস্ত মূলধন তুলে দিচ্ছেন, ঋণ মকুব করছেন। সিপিআই(এম) নেতা বলেছেন, ‘‘কর্পোরেট-হিন্দুত্ব আঁতাত চলছে দেশে। দেশকে লুট করে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর পুঁজিপতি বন্ধুরা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ হচ্ছে। বনাঞ্চল থেকে খনিজ— দেশের সমস্ত সম্পদ বেচে দেওয়া হচ্ছে। আর সব মুনাফা যাচ্ছে পুঁজিপতির হাতে। কর্পোরেটদের ঋণ মকুব হচ্ছে। অথচ অন্নদাতা কৃষকরা বঞ্চিত। এক নৃশংস মানসিকতা মোদী সরকারের। গরিবরা আরও গরিব হচ্ছেন। ধনীরা ফুলে ফেঁপে উঠছেন। এভাবেই মোদী দু’টি ভারত তৈরি করছেন। একটি ধনীদের, একটি বাকিদের। এই বাকি অংশই হলো ৯০ শতাংশ গরিব সাধারণ মানুষ।’ মনুবাদ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা মোদী সরকার জাতগণনা করতে চায় না, ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন ইয়েচুরি। তিনি বলেন, ‘ধনী এবং দরিদ্র ছাড়া এদেশে আর কোনও জাত নেই, এমনই প্রচার করা হয়। মোদী রাজত্বে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই নয়, তথাকথিত পিছিয়ে থাকা অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাও কিন্তু বিপদের মধ্যে পড়বেন। সামাজিক বিভাজনই মূলমন্ত্র বিজেপি’র। আদিবাসীদের বনবাসী বলে চালায় ওরা। আদি অর্থ অতি পুরানো। যদি প্রমাণ হয়ে যায়, তথাকথিত উঁচু জাতের হিন্দুদের আগে এদেশে আদিবাসীরা এসেছেন, তাহলে বিজেপি’রই মুশকিল। তাই বনাঞ্চলের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার আদিবাসীকে উৎখাত করে দেওয়া হচ্ছে।’
নির্বাচনী বন্ডের নামে যে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি বিজেপি করেছে, সেই প্রসঙ্গে ইয়েচুরি বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই সরকারই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই উলটে বিরোধীদেরই নিশানা করা হচ্ছে। বিরোধীদেরই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাঁরাই বিজেপি’র ওয়াশিং মেশিনে ঢুকে যাচ্ছেন, তাঁরাই আবার দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছেন। দেশপ্রেমী নাগরিকদের উচিত বিজেপি’কে পরাস্ত করা। গত তিন দিনে তামিলনাডুতে জনোচ্ছ্বাসে বুঝতে পারছি, গতবারের মতোই এবারও ভোটে বিজেপি’কে উচিত জবাব দেবেন তামিলনাডুবাদী। সংবিধান সর্বোপরি দেশকে রক্ষা করতে তামিলনাডু বদ্ধপরিকর।’ বিজেপি রাজত্বে মহিলাদের উপর কী পরিমাণ অত্যাচার চলছে তা-ও এদিনের বক্তব্যে তুলে ধরেন তিনি। বলেছেন, ‘এমন অত্যাচার আমরা কখনও দেখিনি। এক ঘণ্টায় অন্তত ৪৭টি যৌন হেনস্তার ঘটনা ঘটছে দেশে। তথাকথিত উঁচু জাতের লোকজন দলিত মেয়েদের ধর্ষণ করছে, রেহাইও পেয়ে যাচ্ছে। মাদুরাইয়ের সিপিআই(এম) প্রার্থী সু ভেঙ্কটেশান বিপুল ভোটে জিতবেন বলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইয়েচুরি বলেন, ‘আমরাই একমাত্র রাজনৈতিক দল যাঁরা নির্বাচনী বন্ড নিতে অস্বীকার করেছি। নির্বাচনী বন্ড সবথেকে বড় রাজনৈতিক দুর্নীতি।’
Comments :0