Land policy

শিল্প গুঁড়িয়ে নিস্কোর জমি বেচতে চায় রাজ্য সরকার

রাজ্য

অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেইল। শিল্পের পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে বিনামূল্যে অধিগ্রহণ পর্ব অনুমোদন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। 
২০১১ সালের ১ মার্চ স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সেইল)-কে নিস্কো কারখানাকে বিনামূল্যে অধিগ্রহণে সায় দিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভা। এক দশক পরে নিস্কো কারখানার জমিতে প্রোমোটারের থাবা পড়তে চলেছে।
নির্বাচনে বামফ্রন্ট পরাস্ত হওয়ার পর সেইলের অধিগ্রহণ নিয়ে আর কোনও পরিকল্পনা করেনি মমতা ব্যানার্জির সরকার। শিল্পের পুনরুজ্জীবনের প্রকল্পের কফিনে পেরেক পুঁতে এখন সরকারের নজর নিস্কোর হাতে থাকা ১২০ একর জমি। কোষাগারে সঙ্কট কাটাতে রাজ্যের সম্পত্তি, জমি বিক্রি করার দিকে এখন নজর পড়েছে নবান্নের। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে সরকার অধিগৃহীত কারখানার বিপুল জমি বিক্রি করতে তৎপর রাজ্য সরকার। 
ভূমি সংস্কার দপ্তরের হাত ঘুরে নিস্কোর জমির মালিকানা এখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের হাতে। ইতিমধ্যেই সরকারি দপ্তর ও অধিগৃহীত সংস্থার হাতে থাকা জমি রাজ্য মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিজ হোল্ড থেকে ফ্রি হোল্ড করার। আর তার ফলেই বেলুড় স্টেশন লাগোয়া নিস্কোর হাতে থাকা বিপুল জমি এখন বিক্রি করার পথ সহজ হয়েছে।
রাজ্য প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে নিস্কোর বিপুল জমি পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগম নিজের হাতে নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। ওই জমি ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের হাতে যাওয়ার পথ শুরুতেই সরকার বন্ধ করে দেয়। রাজ্যের ছোট ও মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু সংগঠনও চেয়েছিল ওই জমি সরকার ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তরের হাতে তুলে দিলে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের কাজে লাগবে। ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এক প্রতিষ্ঠানের কর্তার অভিযোগ,‘‘ আমরা খবর পাচ্ছিলাম, নিস্কোর ওই জমিতে রাজ্য সরকার টাউনশিপ করবে। আমাদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তরের সচিব থেকে শুরু করে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর আগে দেওয়া সেই চিঠির কোনও জবাব আমরা পাইনি।’’ 
যে কারখানা সেইলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অধিগ্রহণ করলে কী হতো?
২০০৬ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার অধিগৃহীত শিল্প দপ্তরের প্রধান সচিব অর্ধেন্দু সেনকে চিঠি দিয়েছিলেন সেইলের তৎকালীন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ভি শ্যামসুন্দর। নিস্কো কারখানাকে অধিগ্রহণের সম্মতি পত্রে সেইল জানিয়েছিল, অধিগ্রহণের পর ‘এফই ৫০০ টিএমটি রড’ তৈরি করার জন্য একটি রোলিং মিল তৈরি করবে। শুরুতে যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লক্ষ টন। ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্যমাত্রাকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। একইসঙ্গে নিস্কোর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত শ্রমিক কর্মচারী থেকে অস্থায়ী কর্মচারীদেরও চাকরির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে সেইলের অধিগ্রহণ নীতিতে। 
বামফ্রন্ট সরকার বিদায়ের পর নিস্কোর বর্তমান কী অবস্থা?
কারখানার রোলিং মিল, মেশিন শপ, ফাউন্ড্রি, পেটার্ন শপ, ১ টন থেকে ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে আধুনিক ল্যাবরেটরি, চারটি অফিস বিল্ডিং ও গেস্ট হাউস। নিস্কো কারখানার সীমানা পাঁচিল এখন উধাও। রীতিমতো পরিকল্পনা করে সেইলকে দিয়ে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করা হয়নি। আর এখন শিল্পের শ্মশানে ধূ ধু জমি বিক্রি করার দিকে নজর দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। নিস্কো কারখানার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আশিস রায় জানান, ‘‘সেইলের হাতে নিস্কো কারখানাকে তৃণমূল সরকার দিলে শুধু কারখানা নয় গোটা তল্লাটের অর্থনৈতিক উন্নতি হতে পারতো। সেইভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে এখন শিল্পের জমিতে প্রমোটারি করতে চাইছে রাজ্য সরকার।’’
শুরুতে বেসরকারি মালিকানায় ছিল নিস্কো। ১৯৭৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদনমূলক এই শিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উদ্যোগে নিস্কো কারখানা চালু হয়েছিল। তারও পরে ১৯৮৪ সালে আইনসিদ্ধ করে নিস্কো কারখানাকে অধিগ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। অধিগ্রহণের পর যতবার সমস্যা হয়েছে রাজ্য সরকারকে পাশে পেয়েছিল কারখানার শ্রমিক কর্মচারীরা। ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের উদ্যোগে নিস্কোর আধুনিকীকরণে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে উদ্বোধন হওয়া সেই ‘সেমি অটোমেটিক রোলিং মিল’কে পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বর্তমান রাজ্য সরকার। 
এক দশক পার করে রাজ্য সরকার অধিগৃহীত সংস্থা বেলুড়ের নিস্কো (ন্যাশানাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি)’র বিপুল জমি প্রোমোটারদের হাতে তুলে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। শিল্পের জমিতে শিল্পের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামছে এলাকার শ্রমিক, ছাত্র, যুব মহিলারা। রবিবার নাগরিক কনভেনশনে উপস্থিত থাকবেন সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। সিআইটিইউ হাওড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমীর সাহা জানিয়েছেন,‘‘ তিলে তিলে গত এক দশকে শেষ করা হয়েছে সরকারি একটি শিল্প সংস্থাকে। এখন সরকারের নজর জমিতে। আমরা তাই দাবি করেছি, শিল্পের জমিতে শিল্প ছাড়া অন্য কিছুই করা যাবে না।’’

Comments :0

Login to leave a comment