রাজ্যপালের ভাষণে উল্লেখ নেই আর জি করের ঘটনা!
রাজভবন এবং নবান্নের নকল যুদ্ধে আপাতত বিরতি দিয়ে সোমবার বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হলো রাজ্যপালের ভাষণের মধ্য দিয়েই। দীর্ঘদিন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসকে বিধানসভা থেকে দূরে রেখে অধিবেশন চালানোর পর তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ যেমন অধিবেশন শুরু করালেন তেমনই রাজ্যপালও রাজ্য সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণ পাঠ করে মমতা ব্যানার্জির সরকারের সাফল্যই তুলে ধরলেন। একদিকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকারের যাবতীয় বঞ্চনার অভিযোগও আপাতত উহ্য রেখে দিলেন, অন্যদিকে উল্লেখ করলেন না রাজ্য উত্তাল করে দেওয়া আর জি কর আন্দোলনের প্রসঙ্গটুকুও। ‘যুযুধান’ দুই পক্ষের আপাতত সন্ধির সব লক্ষণই ফুটে উঠল সোমবার বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণপর্বে।
রীতিমাফিক এদিন দুপুর দুটোয় রাজ্যপাল বিধানসভা ভবনে পদার্পণ করামাত্র অধ্যক্ষ বিমান ব্যানার্জি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যান বিধানসভায় আম্বেদকরের মূর্তির সামনে। সেখানে তাঁরা মাল্যদান করার পরে বিধানসভার অধিবেশন কক্ষে ঢুকে রাজ্যপাল ভাষণ পাঠ করেন। রাজ্যপালকে স্বাগত জানাতে যাওয়ার সময় বিধানসভার অলিন্দেই অধ্যক্ষ এবং মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি পড়ে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকেও সঙ্গে আসার জন্য অনুরোধ করে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেন, ‘যাবি না?’ বিব্রত শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ বজায় রাখার তাগিদে অনুরোধ এড়িয়ে গিয়ে অধ্যক্ষকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘উনি তো আছেন!’
রাজ্যপাল তাঁর ভাষণে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক ও শিল্প বিনিয়োগে সাফল্য, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের উন্নয়ন, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সাফল্য, সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর অংশের উন্নয়ন ইত্যাদির উল্লেখ করেন রাজ্য সরকারের খতিয়ান দিয়ে। রাজ্যপালের ভাষণের মধ্যেই বিজেপি বিধায়করা দুইতিনবার উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে তাঁদের আপত্তির কথা বলেছেন। কিন্তু রাজভবন-নবান্ন সমঝোতায় তাল কাটে এমন কোনও আচরণই এদিন বিধানসভায় বিরোধীরা করেননি। এমনকি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে শান্তিপূর্ণ বলে রাজ্যপালের ভাষণে দাবি করা হলেও তা নিয়ে বিরোধী বেঞ্চে উত্তাপ দেখা দেয়নি, কেবল বিজেপি’র অ্যাজেন্ডায় সরস্বতী পুজো নিয়ে তাঁদের চিৎকার করতে দেখা গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদীদের ওপরে হামলা, মিথ্যা মামলা, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একের পর এক খুন, জেলায় জেলায় বিস্ফোরণ এসব কিছু পশ্চিমবঙ্গে ঘটছে বলে বোঝাই যায়নি রাজ্যপালের ভাষণে। এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি সাফল্যের ভূরি ভূরি দাবি করা হলেও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে এই মুহূর্তে আন্দোলনরত চাকরি প্রার্থীদের সমস্যা এবং চাকরিরতদের চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কার কীভাবে সমাধান হতে পারে তা নিয়েও কিছুই বলা হয়নি।
গত আগস্ট মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গ একটানা উত্তাল হয়েছে আর জি করের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে। নাগরিক সমাজের সব অংশ শামিল হয়েছেন এই নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই ঘটনায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন, এমনকি রাজ্য সরকারও আদালতে এই আরজি নিয়ে গিয়েছিল। মুখ্য সচিবকে নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে বসে মুখ্যমন্ত্রী অভয়া খুনের পিছনে হাসপাতালগুলিতে দুর্নীতিচক্র ও থ্রেট কালচারের অভিযোগ শুনেছিলেন। কিন্তু রাজ্যপালের ভাষণে সেই আর জি করের ঘটনা নিয়ে একটি শব্দও রাখা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘আমার মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টান্তমূলক কর্মতৎপরতার ফলে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে উচ্চমানের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করেছে।’ জাল স্যালাইনে মানুষের মৃত্যুর পরেও নিছক এমন বয়ানে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাত জেগে রাস্তায় নামা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিবাদকে।
একশো দিনের কাজ এবং আবাস প্রকল্প সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে দিয়েছে মোদী সরকার। তদন্ত করে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের ফলে রাজ্যের মানুষ সাংবিধানিকভাবে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ সহ বিভিন্ন বিষয়ে মোদী সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশেই যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতি ভেঙে হস্তক্ষেপ করছে। এমনকি রাজ্য সরকারের সাফল্য বর্ণনা করেও এই বিষয়গুলিকে রাজ্যপালের ভাষণে অনায়াসেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু রাজভবনের সঙ্গে অদৃশ্য এক সমঝোতায় রাজ্যপালের ভাষণে কেন্দ্রীয় সরকারের এইসব বঞ্চনার প্রতিবাদকেও অনুক্ত রাখা হয়েছে। অবশ্য বিজেপি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, রাজভবনের সঙ্গে মতবিনিময় করেই কেন্দ্র বিরোধী বক্তব্য বাদ দেওয়া হয়েছে ভাষণ থেকে।
এদিন বিধানসভার অধিবেশনের আগে তৃণমূলের সব বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল সূত্রেই খবর, বৈঠকে মমতা ব্যানার্জিকে দুটি বিষয়ে রাশ হাতে নিতে তৎপরতা চালাতে দেখা গিয়েছে। প্রথমত, তৃণমূল থেকে হাওয়া যাতে বিজেপি’তে না চলে যায়, দল ভেঙে ফের বিজেপিমুখী স্রোত যাতে না হয় তার জন্য মমতা ব্যানার্জি টনিক দিয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন। বৈঠকে দলের বিধায়কদের তিনি বলেছেন, ‘২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের কাউকে দরকার নেই, একাই লড়বে তৃণমূল। একাই তৃণমূল দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবে।’ কংগ্রেস সম্পর্কে রীতিমতো অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিয়ে তিনি একথাও বলেছেন, ‘দিল্লি হরিয়ানাতে ওরা আপ’কে সমর্থন করেনি বলেই ভোট বিজেপি’র দিকে চলে গেছে।’
দ্বিতীয়ত, দলের ভিতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলের শীর্ষপদে মমতা ব্যানার্জির বিকল্প হিসাবে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তুলে আনা সম্পর্কে যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটাতে মমতা ব্যানার্জি মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংগঠন নিয়ে আমি একাই সিদ্ধান্ত নেবো।’ দলের নেতারাই তৃণমূলের তোলাবাজি, টাকা নিয়ে প্রার্থী হওয়া সহ নানা ঘটনা এখন প্রকাশ্যে বলছেন। এসব থামাতে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ঝগড়া বন্ধ করুন। দলের সম্মান নষ্ঠ করবেন না। যা খুশি বলে দিয়ে বারবার ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা করা হবে না।’
মন্ত্রী পদে থেকে দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখন জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল।’ মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মন্ত্রীসভায় পুনর্বাসনের ইঙ্গিত কিনা তা নিয়েও ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়েছে।
Comments :0