Teesta Setalvad Supreme Court

তিস্তাকে আবার গ্রেপ্তারের ছক রাতে ভন্ডুল সুপ্রিম কোর্টে

জাতীয়

Teesta Setalvad Supreme Court


সুপরিচিত সমাজকর্মী ‘পদ্মশ্রী’ তিস্তা শেতলবাদকে ‘‘অবিলম্বে’’ গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা আপাতত ভেস্তে গেলো সুপ্রিম কোর্টে। তিস্তাকে ফের জেলে পোরার জন্য দিনভর আদালতের বিভিন্ন এজলাসে শাসকের চরম তৎপরতার পরে শেষপর্যন্ত শনিবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ তাঁর অন্তর্বর্তী সুরক্ষা মঞ্জুর করেছে। তিস্তাকে ‘‘অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ’’ দিয়ে এদিন সকালে গুজরাট হাইকোর্ট যে রায় দেয়, তার ওপর সাত দিনের স্থগিতাদেশ জারি করেছে সর্বোচ্চ আদালতের বৃহত্তর বেঞ্চ। এমনকি গুজরাট হাইকোর্টের বিচারপতি নির্জার এস দেশাইয়ের এদিনের রায়ের যথার্থতা নিয়েও সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা।

২০০২সালে গুজরাটে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের লাগাতার লড়াইয়ের সঙ্গী তিস্তা শেতলবাদকে ফের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে শনিবার দিনভর বিভিন্ন মহলের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘‘নিরীহদের দোষী প্রমাণের স্বার্থে তথ্যপ্রমাণ বিকৃত করার’’ অভিযোগে এদিন সকালে তিস্তাকে কার্যত অবিলম্বে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন গুজরাট হাইকোর্টের বিচারপতি দেশাই। এমনকি তিস্তার আইনজীবী এই আত্মসমর্পনের জন্য অন্তত ৩০ দিন সময় চাইলেও সরাসরি তা খারিজ করে দেন তিনি। এরপরে তিস্তার অন্তর্বর্তী সুরক্ষা চেয়ে প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চে আরজি জানানো হলেও বিচারপতিরা রায় নিয়ে একমত হতে পারেননি। পরে এদিন রাতেই বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি এএস বোপান্না এবং বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের উচ্চতর বেঞ্চে মামলাটি উঠলে তিস্তার অন্তর্বর্তী সুরক্ষা মঞ্জুর হয়।
এদিন সকালে যেভাবে তিস্তার আত্মসমর্পণের সময় বাড়ানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন গুজরাটের বিচারপতি দেশাই, তা নিয়ে দৃশ্যতই অসন্তোষ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। এই সুপরিচিত সমাজকর্মীকে তড়িঘড়ি গ্রেপ্তারের জন্য কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সওয়াল চালাতে থাকলে ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা তাঁকে বলেন, ‘‘অভিযুক্ত তো এতদিন জেলের বাইরেই ছিলেন। হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য তাঁকে অন্তত সাত দিন সময় দেওয়া গেলো না? তাঁকে অন্তর্বর্তী সুরক্ষা দিলে কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো? গুজরাট হাইকোর্টের কান্ডকারখানা দেখে আমরা বেশ অবাকই হচ্ছি। কি এমন জরুরি ব্যাপার হলো!’’

এর পরেই গুজরাট হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ বলে, ‘‘আত্মসমর্পণের জন্য সময় চেয়ে অভিযুক্তের আরজি যেভাবে খারিজ করা হয়েছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। সাধারণ ক্ষেত্রেও এই অনুরোধ রাখি আমরা। এর আগেও অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পরে আদালত তাঁর জন্য অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেছিলো। একজন মহিলা হিসেবে প্রাপ্য বিশেষ সুরক্ষাটুকুও এবার তাঁকে দেওয়া হয়নি! এসব বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত ছিলো গুজরাট হাইকোর্টের একক বেঞ্চের। তাই আমরা এই রায়ের ওপর এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিচ্ছি।’’
এর আগে শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিস্তার জামিন নিয়ে টানাপড়েন চলে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য তিস্তা শেতলবাদকে কি এদিনই গ্রেপ্তার করা হবে? গুজরাট সরকার এবং তাদের আইনজীবীদের অতি তৎপরতায় দিনভর এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে থাকে। এদিন সকালেই তিস্তার জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে ‘‘অবিলম্বে আত্মসমর্পণ’’ করার নির্দেশ দেন গুজরাট হাইকোর্টের বিচারপতি দেশাই। এমনকি তিস্তার আইনজীবী এই আত্মসমর্পনের জন্য অন্তত ৩০ দিন সময় চাইলেও সরাসরি তা নস্যাৎ করে দেন তিনি।

এরপরেই সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চে তিস্তার অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন নিয়ে শুনানি হয়। এই বিশেষ বেঞ্চের দুই বিচারপতি অভয় এস ওকা এবং বিচারপতি প্রশান্ত কুমার মিশ্র তিস্তার অন্তর্বর্তী সুরক্ষার ব্যাপারে ঐকমত্যের সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় মামলাটি বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠিয়ে দিতে প্রধান বিচারপতির কাছে সুপারিশ করেন। সেই মতো শনিবারই রাত সওয়া ন’টায় তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চে এই আবেদনের শুনানি শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, গুজরাটে সঙ্ঘ পরিবারের একতরফা সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম থেকেই লড়াই করছেন তিস্তা। আক্রান্ত পরিবারগুলিকে আইনি সহায়তাও দিয়ে চলেছেন তিনি। ফলে বহুদিন থেকেই তাঁকে নানাভাবে হেনস্তার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি-অনুগতরা। এর মধ্যেই গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘‘নিরীহদের দোষী প্রমাণের স্বার্থে তথ্যপ্রমাণ বিকৃত করার’’ অভিযোগ আনা হয় তিস্তার বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের ২৫ জুন তিস্তাকে গ্রেপ্তার করে গুজরাট পুলিশের সন্ত্রাস-দমন শাখা। কিন্তু তারপরেই সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টে অন্তর্বর্তী সুরক্ষা পেয়ে যান এই লড়াকু সমাজকর্মী।

এদিন গুজরাট হাইকোর্টে বিচারপতি দেশাই তিস্তার আবেদন শুধু খারিজই করেননি, রায়ে বেশ কিছু বিষ্ময়কর মন্তব্যও করেন। গুজরাটে সাম্প্রদায়িক গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো সুবিচার না পেলেও সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে এদিন সবিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায় বিচারপতি দেশাইকে। রাজ্য পুলিশের বক্তব্যে সায় দিয়ে বিচারপতির রায়ে বলা হয়, ‘‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী (মোদী)’র ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করতে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পোরার চেষ্টায় তিস্তা তাঁর ঘনিষ্ঠদের এবং ক্ষতিগ্রস্তদের কাজে লাগিয়ে মিথ্যা এবং বানানো হলফনামা পেশ করেছেন।’’ বিচারপতির আরও পর্যবেক্ষণ, ‘‘আজ যদি তিস্তাকে জামিন দেওয়া হয়, তাহলে ভুল বার্তা যাবে। আগামীকাল কোন বাইরের শক্তি একই কায়দায় কাউকে ভুল বোঝায় সেক্ষেত্রে তা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।’’
গুজরাট হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে এদিন সন্ধ্যাতেই সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চে আবেদন জানানো হলে গুজরাট সরকারের তরফে হাজির হয়ে কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা তিস্তার জামিনের মরিয়া বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘অভিযুক্ত রাজ্যের নামে কলঙ্ক ছড়িয়েছেন।’’ তবে গুজরাট হাইকোর্টের নির্দেশে দৃশ্যতই অখুশি বিচারপতি ওকাও এদিন শুনানি চলাকালীন মন্তব্য করেন, ‘‘অভিযুক্ত অন্তর্বর্তী জামিনে আছেন। তাঁকে অবিলম্বে আত্মসমর্পনের শর্ত কেন দেওয়া হলো? ক’দিন দেরি হলে কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো?’’ বিচারপতি মিশ্র অবশ্য তিস্তার অন্তর্বর্তী সুরক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন না বলেই জানা গিয়েছে। এরপরেই এদিন মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চে চলে যায়।


 

Comments :0

Login to leave a comment