Hate Speech

ঘৃণাভাষণ আর চলছে না

উত্তর সম্পাদকীয়​

অর্ধেন্দু সেন

সিএসডিএস দিল্লির এক খ্যাতনামা গবেষক সংস্থা। এই সংস্থা রাজনীতি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে এবং সমীক্ষা চালায়। এদের প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষার যথেষ্ট সুনাম আছে। এবছরের সমীক্ষায় এরা ১০,০০০ জন ভোটারকে শামিল করেছেন। তাদের সবাইকে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন করা হয়— ভারত দেশটা কি শুধু হিন্দুদের না ভারতে সব ধর্মাবলম্বীদের সমান অধিকার? শতকরা পঞ্চাশ জনের উপর উত্তরে বলে ভারত হিন্দুদের একার নয়। এ দেশে সব নাগরিকের সমান অধিকার। শুনে অবাক হয়েছিলাম। থাকি পিএম মোদীর প্রতিধ্বনি-চেম্বারে। পড়াশোনা করি হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই নিশ্চিত ছিলাম বেশিরভাগ মানুষ হিন্দুদের অগ্রাধিকার মেনে নেবে। রাম মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে ছ’মাসও হয়নি। অমৃতধারা বহিছে ভুবনে। তারই মাঝে এই অঘটন!

মনকে শান্ত করলাম ইংরেজি প্রবাদবাক্য স্মরণ করে— একটি পরিযায়ী পাখি দেখে বলা যায় না যে সিজন বদলেছে। কিন্তু হঠাৎ দেখি আরেকটি পাখি। ঘৃণা ভাষণের তারকা প্রচারক হিসাবে যিনি সর্বজনের শ্রদ্ধার পাত্র সেই পিএম মোদী বলেছেন তিনি কোনোদিন তাঁর কথায় বা কাজে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ করেননি। তার ঠিক আগের জনসভায় তাঁর বক্তব্য ছিল মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বলেছিলেন যে দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার মুসলমানদের। (একথা মনমোহন বলেননি। তিনি বলেছিলেন গরিব মানুষের অধিকারের কথা।) তাই দেশকে সাবধান থাকতে হবে। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সব সম্পদ বিলি করে দেবে কাদের মধ্যে? ঐ যাদের বেশি বাচ্চা হয়!

প্রশ্ন উঠবে কাদের বেশি বাচ্চা হয়? জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকার সচেষ্ট হয় সত্তরের দশকে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে যান হেলসিঙ্কিতে জনসংখ্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। ফিরে এসে ফ্যামিলি প্ল্যানিং সংক্রান্ত একগুচ্ছ প্রকল্প চালু করেন। সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল উন্নয়নই হলো শ্রেষ্ঠ গর্ভ নিরোধক। যারা দরিদ্র যারা উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত তাদের আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে হবে যাতে সন্তানের উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে।                
এছাড়া দারিদ্র মানে শিক্ষার সুযোগ কম। মেয়েদের শিক্ষা বাড়লে এবং তারা সচেতন হলেও সন্তানের সংখ্যা কমে। মোদী তখন আরএসএস’র প্রচারক। তাঁর পক্ষে এই তত্ত্ব মেনে নেওয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিল। তিনি এবং তাঁর দল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে উপার্জন যাই হোক শিক্ষার মান যাই হোক মুসলমানদের বাচ্চা হবে বেশি।

এই সেদিনও মোদী সেকথাই বলেছেন। কিন্তু আজকে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর তত্ত্বে। বলতে হচ্ছে বাচ্চা বেশি হয় গরিব লোকের। 'ঐ যাদের বেশি বাচ্চা হয়' তারা মুসলমান নয় গরিব লোক! কিন্তু কথাটা তো জমল না। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদ চলে যাবে গরিব লোকের হাতে? কংগ্রেস কাজ করবে রবিনহুডের মতো? একথা বললে তো কংগ্রেসেরই জনপ্রিয়তা বাড়বে! শুধুই মুসলিম বিরোধিতার কথা বলে হাততালি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বোধহয় পিএম মোদী তাঁর প্রিয় রেলমন্ত্রীর মতো মাঝেমধ্যেই লাইনচ্যুত হচ্ছেন।

গরিব মানুষের কথা পিএম মোদীর মুখে বড় একটা শোনা যায় না। সরকারের বক্তব্য দশ বছরের লাগাতার চেষ্টার ফলে তাদের জীবনযাত্রা উন্নত হয়েছে। তারা এখন মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে। আর তাদের সংখ্যাও তো বেশি নয়। গত দশ বছরে মোদী ১৪ কোটি মানুষকে দারিদ্র সীমার উপরে নিয়ে যাওয়াতে প্রকৃত দরিদ্র এখন মাত্র ৫ পারসেন্ট। কোন কারণে তাদের বেশি সন্তান দরকার? পাঁচ বছর বয়সের আগেই সন্তানের মৃত্যু হচ্ছে? যেটা বেঁচে যাচ্ছে সেটা রুগ্‌ণ? বয়সের তুলনায় বা ওজনের তুলনায় উচ্চতা কম? কর্ম ক্ষমতা কম? সরকারি হাসপাতাল দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে? বেসরকারি হাসপাতালে যাবার পয়সা নেই? মোদী জমানার বিজ্ঞাপনগুলো একত্র করলেই দেখা যাবে এর কোনোটাই সত্যি হতে পারে না। তাহলে? বেশি বাচ্চার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। টোটাল ফারটিলিটি রেট যা সত্তরের দশকে ছিল ৬ তা কমে হয়েছে ২.১। হোয়াটসঅ্যাপে প্রায়ই দেখি চিন তার 'এক সন্তান' পলিসির জেরে এখন যুদ্ধ করার জন্য সৈনিক পাচ্ছে না। মোদীজী সেই পাঁকে না পড়ে যান।                      

পিএম মোদী তাঁর উপদেষ্টাদের কথা শোনেন না ভালোই করেন। কিন্তু উপদেষ্টারা তাঁর কথা শুনবে না? মোদীর ব্যাখ্যার দু’দিনের মধ্যে উপদেষ্টা মণ্ডলী অঙ্ক কষে প্রমাণ করল মুসলমানদের সংখ্যা ১৯৫০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। ছিল ১০ পারসেন্ট হয়েছে ১৪ পারসেন্ট। কতোটা বেড়েছে? আমরা বলব ৪ পারসেন্ট। মণ্ডলী বললে ১০-এর মধ্যে ৪ অর্থাৎ ৪০ পারসেন্ট। অতিমারির পরে আমরা কয়েকবার দেখেছি অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হার ১০ পারসেন্টের উপরে। সে ছিল বৃদ্ধির হারে বৃদ্ধি! তারই দৌলতে আমরা বিশ্বগুরু!            

যদি প্রমাণ হয় যে মোদী সত্যিই মুসলমান নয় গরিব লোকের কথা বলেছিলেন? তাহলে কি তাঁর ভাষণকে ঘৃণাভাষণ বলা যাবে না? তিনি কি গরিবকে ঘৃণা করেন না? তিনি আমাদের পাঁচ ট্রিলিয়নের স্বপ্ন দেখান। কিভাবে আমরা পৌঁছাবো সেই লক্ষ্যে? যে পথ তিনি বেছে নিয়েছেন তা হলো অস্ত্র শস্ত্র তৈরি করে রপ্তানি করা। এখনই ভারত ৫০০ কোটি ডলারের সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। এই পলিসিতে গরিব আরও গরিব হবে। এখনই দেশের ৪০ পারসেন্ট সম্পদ কুক্ষিগত করেছে ১ পারসেন্ট ধনী মানুষ। দরিদ্র পঞ্চাশ পারসেন্টের হাতে আছে মাত্র ১৫ পারসেন্ট। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলছেন এই অসাম্য সহ্য করা যায় না। পিএম’র উপদেষ্টা বলছেন অসাম্য নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অসাম্য আমাদের দরকার। অসাম্য না থাকলে বৃদ্ধি হবে কি করে?

আচ্ছে দিন তো কারও চিরকাল থাকে না। পিএম মোদীর আচ্ছে দিনও কি শেষ হয়ে এল? সকালে উঠে স্নানাদি সম্পন্ন করে সূচি মনে মুসলিম বিরোধিতা করলে আর চলছে না। মানুষ জানতে চাইছে মূল্যবৃদ্ধি কবে কমবে, কবে চাকরি হবে? এনডিএ’র সদস্য দলের তরুণ নেতা চিরাগ পাসোয়ান বলেছেন মোদী বক্তৃতায় যেসব কথা বলছেন তার দরকার ছিল না। অন্য নেতা চন্দ্রবাবু বলছেন অন্ধ্র প্রদেশে মুসলিমদের জন্য ৪ পারসেন্ট আরক্ষণ করবেন! ঘৃণা ভাষণ আইনি অপরাধ। তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার কথা নির্বাচন কমিশনের। কমিশন সে সাহস দেখালো না। সাধারণ মানুষ কিন্তু সাধ্যমতো প্রতিরোধ করেছেন। তারই ফল দেখা যাচ্ছে একটু কষ্ট করে দেখলে। 
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব)   

Comments :0

Login to leave a comment