Elections Results

তেলেঙ্গানায় বিপুল জয় কংগ্রেসের তিন রাজ্যেই বিজেপি

জাতীয়

শেষ পর্যন্ত উগ্র হিন্দুত্বের প্রচারেই কি বাজিমাত করলো বিজেপি? নাহলে লোকসভা ভোটের আগে এমন কোনও ইঙ্গিত ছিল না যে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য ‘ভালোরকম’ জয় পাবে গেরুয়া শিবির। এমনকি বুথ ফেরত সমীক্ষাকেও হতাশ করে দিয়ে ছত্তিশগড়ের কুর্সি কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নিলো বিজেপি। অথচ ভূপেশ বাঘেলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস যে হারতে চলছে, তা সম্ভবত ভাবতে পারেননি বিজেপি নেতারাও। সেই ছত্তিশগড়েও কংগ্রেসকে অনেকটা পিছনে ফেলে ক্ষমতা দখল করলো বিজেপি। মধ্য প্রদেশে কিংবা রাজস্থানে জোর টক্কর দেবে কংগ্রেস, এমন আভাস থাকা সত্ত্বেও ফল হয়েছে উলটো। মধ্য প্রদেশে বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি, রাজস্থানেও কংগ্রেস কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে একমাত্র আশার কথা তেলেঙ্গানা, শাসক বিআরএস-কে কার্যত ধূলিসাৎ করে জিততে সক্ষম হয়েছে।
কী কারণে কংগ্রেসের এমন ফল হলো, কিংবা বিজেপি কোন জাদুবলে ‘বেশ ভালো’ ফল করলো, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে আগামী দিনে। তবে বেকারত্ব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির মতো দেশের জ্বলন্ত সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে উগ্র হিন্দুত্বের প্রকাশ্য কিংবা গোপন প্রচার বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতায় এলে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে রামমন্দির পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। একারণেই হারের পর সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ‘জনগণের জীবনজীবিকা এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র সুরক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দ্বিগুণ উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ কিংবা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মতাদর্শগত লড়াই জারি থাকবে।’
বস্তুত, এই চার রাজ্যের ফল আগামী লোকসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে তা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। কারণ ২০১৮ সালে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে খারাপ ফল করেও পুলওয়ামার ঘটনাকে হাতিয়ার করে শেষ পর্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ফের ক্ষমতা দখল করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আবার এই জয়কে ‘মোদীর জয়’ বলে জোর প্রচার চালানো শুরু হয়ে গিয়েছে ‘গোদি মিডিয়া’র পক্ষ থেকে। এরই পাশাপাশি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী দিনে লড়াই চালাতে হবে বলেই মনে করছেন বিরোধী নেতারা।
গেহলট ব্যর্থ
দেশের মধ্যে প্রথম কোনও রাজ্য সরকার মোদীর আমলের মহার্ঘ রান্নার গ্যাস ৫০০ টাকায় দিয়েও রাজস্থানবাসীর মন জয় করতে ব্যর্থ হলেন অশোক গেহলট। কংগ্রেস বস্তুত কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে। ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র আবহে বিজেপি পাঁচ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসতে পারে মরু রাজ্যে, এমন আভাস ছিল। তবে লড়াই হবে সমানে-সমানে বা কংগ্রেস হারলেও জোর টক্কর দেবে, এমন আভাস যদিও মিললো না। ২০০-র মধ্যে ১৯৯ আসনে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে বিজেপি জয়ী হয়েছে ১১৫ আসনে, উলটোদিকে কংগ্রেস পেয়েছে ৬৮টি। একটি আসনে প্রার্থী মারা যাওয়ায় ভোট হয়নি। এরই সঙ্গে ভারত আদিবাসী পার্টি তিনটি, বিএসপি ২টি এবং রাষ্ট্রীয় লোকদল ও রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি ১টি করে আসনে জয়ী হয়েছে। নির্দল জিতেছেন ৮ জন। বিজেপি ভোট পেয়েছে ৪১.৬৯ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৩৯.৫৩ শতাংশ। গত বিধানসভায় সিপিআই(এম)-র দুটি আসন থাকলেও এবার জোর লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট জয়ী হলেও এদিন বিকালে হার স্বীকার করে নিয়ে ইস্তফাপত্র দিয়ে আসেন রাজ্যপালের কাছে।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাজস্থানে পালাবদল ঘটে, এমন একটি প্রচার রয়েছে। মূলত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণেই ওই প্রচার চালানো হয়। তবে অধিকাংশ বুথ ফেরত সমীক্ষায় যেমন আভাস ছিল তেমনই ভোটের আগে থেকেই গেহলটের কুর্সি টলে যেতে চলেছে, এমন প্রচার ছিল রাজস্থানে। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস অশোক গেহলট-সচিন পাইলটে দ্বন্দ্ব ভুলে রাজস্থান দখলে রাখতে মরিয়া ছিল। কিন্তু গেহলট কিংবা সচিন পাইলট জিতলেও শেষক্ষা হলো না, শেষ হাসি হাসল বিজেপি। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী সহ বিধানসভার অধ্যক্ষও পরাস্ত হয়েছেন কংগ্রেসের।
উলটোদিকে, বিজেপি এবার সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জয়পুরের মসনদ দখলে। ৭ জন সাংসদকেও প্রার্থী করেছিল। তাঁদের মধ্যে ৪ জন জয়ী হয়েছেন। জয়ী সাংসদদের মধ্যে বিপুল প্রচারে থাকা দিয়া কুমারী রয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজেকে প্রার্থী করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত টিকিট পান এবং ঝালরাপাটান আসন থেকে জিতে গিয়েছেন।
২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে রাজস্থানের ২০০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল ১০০টি আসনে। বিজেপি জয়ী হয় ৭৩ আসনে। সিপিআই(এম) জয়ী হয়েছিল ভাদরা এবং দুঙ্গারগড় আসনে। এবারে ভাদরায় বলওয়ান পুনিয়া জোর লড়াই চালিয়ে ১৯ রাউণ্ড শেষে ১১০০ ভোটে পরাজিত হন বিজেপি প্রার্থীর কাছে। এবার বলওয়ান পুনিয়া এক লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছেন, সেখানে গত বছর তিনি পেয়েছিলেন ৮১ হাজারের সামান্য বেশি ভোট। দুঙ্গারগড়ে ত্রিমুখী লড়াই হয়। ৫৬ হাজারের বেশি ভোট পেয়েও বিজেপি’র কাছে ৮ হাজার ভোটে পরাস্ত হয়েছেন গিরিধারীলাল মাহিয়া। রাইসিংনগর আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থী শোপৎরাম মেঘওয়াল ৬১ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। ধোঁধ আসনে ৭২ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রেমা রাম। যদিও তিনি বিজেপি’র কাছে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। গত বছর দাঁতরামগড় আসনে অমরা রাম ৪৪ হাজার ভোট পেলেও এবার ২০ হাজার ভোট পেয়েছেন।
ভালো ফল বিজেপি’র
নির্বাচনে হেরে বিধায়ক কেনাবেচা করে নিজের সরকার গড়ে পরের বার বিপুল ভোটে ক্ষমতায় ফেরা বিজেপি’র পুরানো কৌশল। তবে এবার মধ্য প্রদেশে সেই কৌশল অন্তত এবার করতে হবে না বিজেপি-কে। কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে বিপুল জয় পেয়েছে গেরুয়া শিবির। আর জয়ের পর সবাই মোদীর নামেই জয়জয়কার করতে শুরু করে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘এমপি কি মন পে মোদী, মোদী কি মন পে এমপি।’ এই স্লোগান সামনে রেখেই লোকসভার নির্বাচনের প্রচার সেরে নিতে চাইছে মোদীর  ব্রিগেড। মধ্য প্রদেশে ২৩০ বিধানসভা আসনে বিজেপি ১৬৪, কংগ্রেস ৬৫ আসন পেয়েছে। বিএসপি’র ১টি আসন।
গত ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি হারে। বিজেপি-কে হারিয়ে কংগ্রেস পায় ১১৪টি আসন। বিজেপি পায় ১০৯ আসন। কংগ্রেস সরকার গড়লেও বিজেপি তাতে থেমে থাকেনি। কংগ্রেসের ২২বিধায়ক কিনে নিয়ে কংগ্রেসের সরকার ফেলে দিয়ে কেনা বিধায়কদের সমর্থন নিয়ে বিজেপি’র শিবরাজ সিং চৌহান সরকার গড়ে। পাঁচ বছর রাজ্য চালিয়ে রামমন্দির পরিদর্শনের ধুয়ো তুলে ভোটে ফায়দা তুলে নিল বিজেপি। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান সরকার নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল অনাস্থা থাকায় মুখ্যমন্ত্রীর তালিকায় চৌহানকে রাখা হয়নি বলে দল দাবি করলেও আসলে তা নিছক কৌশল ছিল। দলের প্রচারে বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণার ঝড় তুলেছিলেন চৌহান। কংগ্রেস তাদের ইশ্‌তেহারে দেড় হাজার টাকা মহিলা সম্মান ভাতা ঘোষণার পর চৌহান তাঁর সরকার এলে ‘লাডলি বহেনা’ প্রকল্পে মহিলাদের মাসে ভাতা বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বিজেপি’র দাবি, এতে দলের পক্ষে মহিলা ভোট বেড়েছে। এবছর ভোটের হার ছিল ৭৭.৮২ শতাংশ। তার মধ্যে মহিলা ভোটের হার ছিল ৭৬.০২ শতাংশ। চৌহান শিবিরের দাবি, তাদের মুখ্যমন্ত্রীর এই কৌশল শেষ পর্যন্ত ভোটের সব সমীকরণ বদলে দিয়েছে।
অন্যদিকে এবারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ তার প্রচারে রামমন্দির ইস্যুকে যেভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন তাতে মেরুকরণের ভোট নিজেদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে দলের শীর্ষ নেতাদের দাবি। এবারে নির্বাচনী জনসভায় অমিত শাহ জানিয়ে দেন, আগামী জানুয়ারি মাসেই সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বোধন হয়ে যাবে রামমন্দির। তিনি জানান, এরাজ্যে মানুষ বিজেপি-কে জেতালেই তাদের রাম মন্দির ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। ভোটের ফল প্রকাশের পর ফের রাজ্যের মানুষ রামমন্দির আবার এক দীপাবলী পালন করবে বলে জানান। শাহের প্রতিশ্রুতি মতোই বিজেপি’র সদর দপ্তর এদিন রামমন্দিরের দীপাবলীতে মেতে উঠেছে। কংগ্রেস অফিস ছিল শুনশান।

বাঘেলাও পারলেন না
ছত্তিশগড়ে সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। গভীর রাত অনুযায়ী ফলাফলে বিজেপি’র দখলে যাচ্ছে ৫৪টি আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস পেতে চলেছে ৩৫টি আসন। একটি আসনে জিতেছে  এই রাজ্যের ৯০ আসনের বিধানসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ৪৬টি আসন। এবারের নির্বাচনে তার থেকেও বাড়তি ৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারা। গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিজেপি ইতিমধ্যে জয়ী হয়েছে ৪৬টি আসনে। কিন্তু ৮টি আসনে তারা ভালো ব্যবধানে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৩১টি আসনে। বাকি ৪টি আসনে তাঁরা এগিয়ে রয়েছে। জিজিপি নামের একটি আঞ্চলিক দল জয়ী হয়েছে একটি আসনে। এবার ৪৬.২৮ শতাংশ ভোট বিজেপি পেয়েছে। উলটো দিকে কংগ্রেসের  পেয়েছে ৪২.১৯ শতাংশ ভোট। 
মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল জয়ী হলেও তাঁর মন্ত্রীসভার একাধিক সদস্য পরাস্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে এই রাজ্যে কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও হেরে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল পাটন কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। তিনি দুর্গের সাংসদ বিজয় বাঘেলকে পরাস্ত করেছেন। বিধানসভার বিদায়ী স্পিকার চরণদাস মহন্ত জয়ী হয়েছেন। তবে অম্বিকাপুর কেন্দ্রে উপমুখ্যমন্ত্রী টিএস সিংহদেও পরাস্ত হয়েছেন। রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দীপক বৈজ পরাস্ত হয়েছেন চিত্রকোট আসনে। এদিকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি প্রার্থী রমন সিং জয়ী রাজনন্দগাঁও আসনে। লোরমি কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছে বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি এবং বিলাসপুরের সাংসদ অরুণ সাউ। 
ভোট পরবর্তী সমীক্ষাগুলিতে এবারও কংগ্রেসই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে আভাস দিয়েছিল। কিন্তু সেই হিসাব ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পাঁচ বছর বাদে ফের এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে চলেছে বিজেপি। টানা ১৫ বছর রমন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি’র শাসনের পর গত নির্বাচনে এই রাজ্যে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস।
ইতিমধ্যে এই রাজ্যে সরকার গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে বিজেপি শিবিরে মুখ্যমন্ত্রী পদে দাবিদার হিসাবে এবারও রমন সিং অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। রাজ্যে বিজেপি’র নেতা অরুণ সাও রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে। বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসাবে সদ্য নির্বাচিত বিজেপি’র নেতাদের নামও শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।

Comments :0

Login to leave a comment