পাসপোর্ট জালিয়াতিকাণ্ডে এবার নয়া মোড়। তবে এমনটা যে ঘটতে পারে তা কারো কল্পনায় ছিল না। পাসপোর্ট প্রতারণায় যুক্ত থাকার দায়ের এবার কলকাতা পুলিশের এক প্রাক্তন আধিকারিককে গ্রেপ্তার করল বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা (সিট)। ধৃত ওই পুলিশ আধিকারিকের নাম আবদুল হাই (৬১)। কলকাতায় পাসপোর্ট তথ্য যাচাইকারী সংস্থা সিকিউরিটি কন্ট্রোলের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। এরই পাশাপাশি পাসপোর্টের আবেদনে জাল শংসাপত্র জমা দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হুগলী থেকে আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করলো বর্ধমান থানার পুলিশ।
এক বছর কলকাতা পুলিশের এসসিও দপ্তর থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে আবদুল হাই নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে ওই পুলিশ আধিকারিক তলে তলে জালিয়াতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কলকাতা পুলিশের ‘সিকিউরিটি কন্ট্রোল অফিস’-এ কাজের সুবাদে তাঁর সঙ্গে কলকাতার থানার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সেটাই সুকৌশলে কাজে লাগায় ওই আবদুল হাই। শনিবার উত্তর ২৪পরগনার হাবরা থেকে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার আবদুল হাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কলকাতা পুলিশ যে ১৫০টি ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে ৫২টি পাসপোর্টের ইনকোয়ারিং অফিসার ছিলেন কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন সাব ইনস্পেক্টর আবদুল হাই। তিনি পাসপোর্ট পিছু ২৫ হাজার করে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ। ধৃত প্রাক্তন পুলিশ অফিসার অবসরের আগে পুলিশের পাসপোর্ট সেকশনে কাজ করতেন। তাই এই জালিয়াতি বা প্রতারণা কেমন করে করতে হয় সেটা জানতেন আবদুল হাই। এই গ্রেপ্তার নিয়ে পাসপোর্ট জালিয়াতিকাণ্ডে ধৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৯। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে একাধিকবার বেআইনি কাজ করেন আবদুল বলে অভিযোগ।
পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে নথি যাচাই করতে হয়। সেই নথি যাচাই করার সময়ই বেআইনিভাবে অনেকের নানা কারণে আটকে যেত। তখন তাঁদেরকেই পাসপোর্ট পাইয়ে দিতেন তিনি জালিয়াতির পথ ধরে। পাসপোর্ট পিছু ২৫ হাজার টাকা করে নিতেন এই জালিয়াতি করার জন্য বলেও অভিযোগ। পাসপোর্টকাণ্ডের চাঁই বলে উঠে আসা সমরেশ বিশ্বাসের সঙ্গে আবদুল হাইয়ের গভীর যোগাযোগ ছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। কয়দিন আগে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তার হয় চক্রের কিংপিন মনোজ গুপ্ত। লক্ষ লক্ষ টাকার ভুয়ো নথি দিয়ে জাল পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে যে চক্র তার সঙ্গে জড়িত ছিল সে। এই সন্দেহ থেকেই তদন্তে নামে কলকাতা পুলিশ। প্রাক্তন পুলিশের এসআই এই পাসপোর্ট জালিয়াতি চক্রের সঙ্গেই কাজ করতেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
অবৈধভাবে যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বা অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে আসত এবং পাসপোর্টের জন্য আবেদন করত তারা সহজেই এই চক্রকে টাকা দিয়ে পাসপোর্ট পেয়ে যেত। অর্থের প্রলোভনে পা দিয়ে এই জালিয়াতি করে চলেছিলেন আবদুল হাই। অবসরের পরও করছিলেন বলে অভিযোগ। অন্যদিকে, পাসপোর্টের আবেদনে জাল শংসাপত্র জমা দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হুগলী থেকে আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে বর্ধমান থানার পুলিশ। ধৃতদের নাম গণেশ চক্রবর্তী ও অনির্বাণ সামন্ত। হুগলী জেলার সিঙ্গুর থানার নন্দা গ্রামে বাড়ি গণেশ চক্রবর্তীর।
সিঙ্গুর থানা এলাকাতেই অপরজনের বাড়ি। শুক্রবার রাতে সিঙ্গুর থানার পুলিশকে নিয়ে বাড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে বর্ধমান থানার পুলিশ। ধৃতদের কাছ থেকে জালিয়াতিতে ব্যবহৃত দু’টি মোবাইল, সিমকার্ড ও একটি কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। চক্রে আরও কয়েকজন জড়িত বলে পুলিসের সন্দেহ। চক্রের জাল বহু দূর বিস্তৃত বলে পুলিশের অনুমান। শনিবার ধৃতদের বর্ধমান সিজেএম আদালতে পেশ করা হয়। তদন্তের প্রয়োজনে ধৃতদের সাত দিন নিজেদের হেপাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায় পুলিশ। দু’জনকে পাঁচদিন পুলিশি হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন সিজেএম।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক মাস আগে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন বর্ধমান শহরের নতুনপল্লির বাসিন্দা রিঙ্কা দাস। পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে তিনি জন্ম শংসাপত্র জমা দেন। শংসাপত্রটি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দেওয়া বলে আবেদনের উল্লেখ করা হয়। আবেদনটি ভেরিফিকেশনের জন্য জেলা গোয়েন্দা দপ্তরে পাঠানো হয়। গোয়েন্দা দপ্তর রিঙ্কাকে সমস্ত নথিপত্র নিয়ে অফিসে ডেকে পাঠায়।
শংসাপত্রটি দেখে তদন্তকারী অফিসারের সন্দেহ হয়। শংসাপত্রটি সঠিক কি না তা জানতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয় গোয়েন্দ দপ্তরের তরফে। শংসাপত্রটি তাদের দেওয়া নয় বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়। সেটি জাল বলে জানানো হয় রিপোর্টে। এরপরই গোয়েন্দ দপ্তরের তরফে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগ পেয়ে মামলা রুজু করে ১৯ ডিসেম্বর রিঙ্কাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বর্ধমান শহরের বড়নীলপুর খেলার মাঠ এলাকার বাসিন্দা স্বরূপ রায় ওরফে রানুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে পাঁচদিন পুলিশি হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।
হেপাজতে থাকা স্বরূপকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শংসাপত্র জালিয়াতিতে গণেশের জড়িত থাকার বিষয়টি জানতে পারে পুলিশ। এরপরই গণেশের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে পাকড়াও করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, সে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা কবুল করেছে। জালিয়াতিতে ব্যবহৃত কম্পিউটারটি তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তার মোবাইলটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জালিয়াতিতে অনির্বাণ জড়িত বলে জানতে পারে পুলিশ। রাতেই অনির্বাণের হানা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
Passport fraud arrest police
পাসপোর্ট জালিয়াতিতে এবার গ্রেপ্তার কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন আধিকারিক
×
Comments :0