MUKTADHARA | STORY — ABAR ASIB | MAYARI MITRA — 4 MARCH 2024

মুক্তধারা | গল্প — আবার আসিব | ময়ূরী মিত্র — ৪ মার্চ ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  STORY  ABAR ASIB  MAYARI MITRA  4 MARCH 2024

মুক্তধারা | গল্প

আবার আসিব

ময়ূরী মিত্র

ভিখিরি হয়েই জন্মেছে বাপ ও বাপের মেয়ে। রোজ তারা ভিক্ষের চাল ডাল উনুনে ফোটায়। অনেকটা জল দেয় – শিলনোড়া কাঁচা হলুদ ও কাঁচালঙ্কা বেটে ফুটন্ত জলে দেয় এবং খিচুড়ি

হয়ে গেল বলে খুশি হয়। চাল ডালের পরিমাণ কমতো ! খিচুড়ির জলটা একটু ঝাল ঝাল হলে

বেশি খাবার ইচ্ছেটাও চলে যায়। আবার জিভেও তার আসে।

       গঞ্জের ধারে ভিখিরি হয়ে থাকতে থাকতে কম খাওয়ার এই পদ্ধতিটা মেয়ে আবিষ্কার করেছে। অবশ্য আবিষ্কারের সুখ সে পায় না। প্রচণ্ড তরল খিচুড়ি উনুন থেকে নামতেই একটা থালা আর একটা বাটির মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। থালা বাপের – থালায় ছড়িয়ে খেতে সুবিধে হবে বলে মেয়েই বাপকে থালাটা দিয়েছে। কিন্তু বাপ কি বুঝবে তা ! পুরো খিচুড়ি ঢেলে দেয় পাতে। মেয়ের বাটি ফাঁকা। যুবতী মেয়ের পেট খিদের খাপরা হয়ে থাকলে সংসারের যে অকল্যাণ হয় তা কি বোঝে বাপটা ! রাস্তায় গড়া হলেও বাপ মেয়ের মাঝের এই চারকোণা জায়গাটুকু সংসারই তো বটে। কথায় আছে – শিল উনুন যেখানে সংসার সেখানে।

       ভাদ্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে এই ছড়াটাই আওড়াচ্ছিল মেয়ে। বাপের পায়ে ব্যান্ডেজ। সাদা ব্যান্ডেজের গা বেয়ে টাটকা রক্ত। দুপুরের ঠাঠা রোদে বাপের রক্ত পা ভালো করে দেখছিল। বাপের সঙ্গে ঝগড়াটা আজ একটু বেশি হয়ে গেছেগো। আসলে ভিখিরির সংসারে চাল যেমন মাপা – ঝগড়াও পরিমিতি মেপে। ভাষা মাকড়সার রসের মতো। কিন্তু সময় বাঁধা থাকে। একটা সময় বাটি থালা গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে যায়। বাড়তি খাবার ভিখিরির সংসারে বেশি ঝামেলা পাকায়। নাখাওয়ার সু-অভ্যেস নষ্ট হয়ে যায় যে। আকাশের বদলে মন ছাদ চায়। বাটির সঙ্গে জলখাবার মাজা ঘটি লাগে।

       কদিন ধরে ওই বাড়তিতেই মজে যাচ্ছিল মেয়েটা। পাঁঠার দোকানের মেজছেলে পৈতৃক দোকান ছেড়ে নতুন লাল সিমেন্টের মেঝেতে মাংস টুকরো করে। বেশ কটা টুকরো আজ মেয়েটাকে দিয়ে বলেছিল – যা বাপ লুকিয়ে আলাদা করে চচ্চড়ি করে খা যা। গত্তি ছাড়া মেয়েমানুষের শরীর মানায় না। মেয়েটা তবু হাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কদিন ধরেই নতুন দোকান খুলে মেজোটা পাঁঠার এটা সেটা দিচ্ছে তাকে। আজ দেখল – দুটো মেটে একটা বিচিও দিয়ে দিয়েছে। মেজো কসাই তাড়া দিল – যা যা আর দাঁড়াস না। কাস্টমার আসছে। তো সেই মাংস ছোট আলুর টুকরো দিয়ে জুতিয়ে রাঁধার পর যখন খেতে যাচ্ছে চুলের মুঠি ধরে কী মার মারল বাপটা ! নিজের ভাগের খিচুড়ি পুরো খেল। তারপর মেয়ের মাংস টান দিল। ব্যস। সব মাটিতে। কুকুর চাটতে লাগল ঝোল মেটে। বাপ পা দিয়ে পিসগুলো সরাবার চেষ্টা করাতে দিল কামড়। গঞ্জের ডাক্তারের কাছে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে এই ফিরেছে বাপ মেয়ে। ডাক্তারের পয়সা বাকি। মেজো কসাই মেয়েকে মাংস দিলেও বাপের ব্যান্ডেজের টাকা কিছুতে দেবে না। চাইতে অবশ্য মেয়ে গিয়েছিল। কাস্টমারের সামনে এমন খেঁকিয়ে উঠল ! তারওতো নতুন দোকান। তাড়াতাড়ি লাভের মুখ মেজ কসাইকে দেখতেই হবে।

       ওঠ – সন্ধে হল। ওঠ রে –

ঘুম ভেঙে গেল মেয়ের। বাপরে ! না খেয়ে এত ঘুমিয়েছে সে। ওই কষা মাংস খেলে অবশ্য ঘুমোতে হত না। ঢেকুর তুলতে হত না হয় হাগতে যাও বার বার।

       আবার বলল বাপ –

       ওঠ ! ভাদ্রের দুপুরে হুট করে বন্ধ হয়ে সন্ধে নামে। গাঁয়ে আমার ঠাকুমা বলত – ভাদ্রের দুপুরে হঠাৎ তালা পড়ে যায়। দিনের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দরজা আছে কিনা। ওরেওঠ। গঞ্জের বাজারের আলোক মবে এবার। চ চ – তাড়াতাড়ি খেয়ে নি। আমি ফ্যান ভাত করেছি। বাটি নিয়ে বসে যা।

       ভাদ্রের চাঁদে খেতে বসেছে বাপ মেয়ে।

       বাপের ব্যান্ডেজের রঙ এখন পানের খয়ের।

       জলওয়ালা ভাত জলের মতো সুড়ুত করে টেনে মেয়ে বলে –

       বাপ – ও বাপ – তোমার ঠাকুমার রান্নাঘরে কী বাসন ছিল গো বাপ ? আচ্ছা বাপ সে পান খেত ?

       বাপ আর এক হাতা জোলো ভাত দিল। এহে ! শুধু জল ! ফ্যানও হতে পারেনি। এত জল ফ্যান হতে আগুন লাগে অনেক।

       মেয়ের বাটির ভাতে খেয়াল নেই। তবে মাটির সঙ্গে কথা বলে চলেছে মেয়ে – হ্যাঁ হ্যাঁ বুড়ি মানুষ যখন পান তো খাবেই। তা ওই পানের ডাব্বায় জাঁতি ছিল ? যেটা দিয়ে অল্প মাংস কুচকুচ কেটে অনেকটা কিমা বানানো যায় ? – মেটেগুলো কুচো সুপুরি করে ফেলা যায় ! ছিল বাপ ?

       বাপ দেখল – মেয়েটা দুই আঙ্গুল কাঁচির মতো করে চাঁদের নিচে ধরেছে।

       ও মেয়ে কী কাটিস ? কাটছিস কী ?

       চাঁদের আলো বাড়ছে।

       গঞ্জের আলো জ্বললেও বোঝা যাচ্ছে না।

       চাঁদের কলঙ্ক যেমন – অন্য আলো ঢেকে দেওয়ার মহিমাও তেমন।

       ও বাপ…!

     

 

 

 

 

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment