Mental Health

বর্তমান সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য

ফিচার পাতা

ডাঃ সৌম্য চ্যাটার্জি

রবিবারের সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে, অনেক কিছু নিয়ে কথা হচ্ছে, একেন বাবু থেকে বিরাট কোহলির আকস্মিক রিটায়ারমেন্ট।
হঠাৎ একজন পরিচিত কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ভাই কি সকালের খবর পড়বো বলতো? চারিদিকে যত খুন খারাপির গল্প, এখন আবার শুরু হয়েছে পরিবারের বাকিদের মেরে নিজেকে শেষ করে দেওয়া।’
ভেবে দেখলাম কথাটা সত্যি,— স্বামী স্ত্রী একা থাকেন, দেনার দায়ে জর্জরিত, আত্মহত্যাকে শেষ পথ বলে বেছে নিলেন। এরকম খবর এখন প্রায়শই সংবাদপত্রের তৃতীয় বা চতুর্থ পৃষ্ঠায় ছোট করে প্রকাশিত হয়ে থাকে।
সঙ্গে থাকা আরেকজন বলে উঠলেন যত নষ্টের মূলে কোভিড, সেই যে অর্থনীতিকে টেনে নিচে নিয়ে গেল, বহু মানুষ কর্মহীন হলো সেই ধাক্কা আজও কাটিয়ে উঠতে পারলাম না আমরা।
এটা বাস্তব, একের পর এক আঘাতে (প্রথমে নোটবন্দি, তারপর কর্মহীনতা এবং নিত্য অনিশ্চয়তা) মানুষ আজ দিশাহারা। Depression (মানসিক অবসাদ), anxiety (টেনশন) আজ মহামারীর আকার ধারণ করেছে, বলা হচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতি দু’জন ব্যক্তির মধ্যে একজন depression -এ আক্রান্ত হবেন।
আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষায় ছাত্রাবস্থা থেকে শিখে আসা তত্ত্ব অনুসারে যে কোনও রোগের জন্যে bio- psycho- social model কার্যকরী থাকে। অর্থাৎ রোগের সঙ্গে আপনার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কেবল বংশগত জিন নয়, তার সাথে পরিবেশ এবং মানসিক স্বাস্থ্যও নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে থাকে। এতে ক্রমশ psycho- social কারণটা যেন খুবই প্রকট হয়ে উঠছে।
আচ্ছা কর্নাটকের যে মেয়েটা তার কাছে স্মার্ট ফোন ছিল না বলে, সে অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না বলে হতাশায় গায়ে আগুন দেয়, তার জন্যে কে দায়ী? তার বাবা মা? না  আজকের সমাজ, পরিস্থিতি?
তার বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গন্ডগোল তো আছেই, কারণ বাবা মা তাঁদের মেয়েকে এই শিক্ষা দিতে পারেননি যে কোনও কিছুর জন্যই জীবন বাজি রাখা উচিত নয়, তুমি চাইলেই সবকিছু  নাও পেতে পারো। তোমার অক্ষমতা যেন তোমার মানহানির কারণ না হয়। কিন্তু চারিদিকে যে  কেবল সামাজিক এবং আর্থিক বৈষম্য সেটাও উপেক্ষা করার মতো নয়। কেউ অবশ্যই বলতে পারেন যে আপনি সেইরকম স্কুলে ভর্তি করেছেন কেন আপনার মেয়েকে যার বন্ধুর বাবা মা সবাই বিত্তবান, নিদেনপক্ষে তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ছাড়াও মেয়ের পড়াশোনার জন্যে একটা স্মার্ট ফোন কেনার ক্ষমতা রাখে?
সেই, সাধ আর সাধ্যের দ্বন্দ্ব...বহু হতাশার মূলে।
এটা কি কেবল ইদানীংকালের সমস্যা যেখানে আর্থিক অনিশ্চয়তা প্রবল, মানুষের জীবন আজ মূল্যহীন? 
উত্তরটা সম্ভবত না, অষ্টদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর যখন থেকে বিজ্ঞান আর পেছন ফিরে তাকায়নি, সেই সময়েই পাওয়া যাচ্ছে এক নতুন শ্রমিক মানুষের পরিচয়। তারা ভোর ছটায় কারখানার অ্যালার্ম এর আওয়াজে নিজেদের প্রস্তুত করে, এক ফালি অন্ধকার আলোবাতাসহীন ঘর থেকে থেকে বেরিয়ে আসে যান্ত্রিকরূপী শ্রমিকরা, এবার সংগ্রাম রোজকার ঠিকা কাজ জোটানো (পুরানো চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলো দেখলে বোঝা যায়)। সন্ধ্যার পরে যখন ফেরে কাজ থেকে ( সেটাও সামান্য মজুরিতে) তখন আর সেই অন্ধকার ঘরে ফেরার ইচ্ছা নেই, কারণ সেখানে অপেক্ষা করছে অভাব এবং ক্ষুধার্ত কিছু মানুষের হাহাকার। তারচেয়ে সুরিখানাগুলো ভালো, আকণ্ঠ মাদ্যপন করে সব কিছু সাময়িক সময়ের জন্যে ভুলে কোনোক্রমে বিছানায় নিজের শরীরটা ফেলে দেওয়া। মাঝে মাঝে তার মধ্যেই চলত গার্হস্থ্য হিংসা।
একই কাজ রোজ করে যাওয়া, একদম ঘড়ি ধরে। নেই কোনও বৈচিত্র, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ (ইচ্ছা থাকলেও সেটা দমিত হতো, কারণ ইচ্ছাটা মুখ্য নয়, কারখানার মুনাফাটাই মুখ্য)। শুরু হলো alienation বা বিচ্ছিন্নতা। যে সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের আত্মপ্রকাশ সেই মানুষই এখন অন্যদের সঙ্গে কেবল একই সমাজে থাকে, অথচ প্রত্যেকে যেন আলাদা, মানসিক আত্মিক দূরত্ব যেন কয়েকশো যোজন। আজকের যুগে কর্মক্ষেত্রের নতুন পরিভাষায় ওয়ার্ক ফ্রম হোম। 
হবে নাই বা কেন, এখন যে শক্তি পরীক্ষার যুগ, সবক্ষেত্রে আসন সংখ্যা সীমিত, অতএব প্রবল প্রতিযোগিতা। অপরকে হারিয়ে তোমাকে জায়গা ছিনিয়ে নিতে হবে। তাই তো গ্রুপ ডি পরীক্ষার জন্যে আবেদনপত্র আসে পিএইচডি পাশ করা ক্যান্ডিডেট এর থেকে। কোথাও নেই কোনো স্থায়ী নিয়োগ, সবই সঙ্কুচিত (অনেকটাই পরিকল্পিত বা ইচ্ছাকৃত)। তাই আমি আপনি প্রতিটি মানুষই দিন কাটাচ্ছে সর্বদা অনিশ্চয়তায়।
" আজ তো কোনোভাবে কাটলো, কাল সকাল থেকে কি হবে?" - এই চিন্তা আপনার আমার চেতনাকে সারাক্ষণ গ্রাস করলে তখন বিকল্প চিন্তা না আসাটাই দস্তুর, মানসিক এই দ্বন্দ্বে হেরে যাওয়ার সম্ভবানা প্রবল।
তাই আজ চতুর্দিকে এত মানসিক রোগের প্রকোপ, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সেমিনার সর্বত্র চলছে mental health awareness (মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্কীকরণ)। কিন্তু সত্যি কি আখেরে লাভ হচ্ছে?
যার মাথার উপর ঝুলছে বিশাল দেনা (হয়তো সেটা একটা সামান্য কাজকে নিশ্চিত করার জন্যই করতে হয়েছে যেটা তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অধরা ছিল), যার মুখাপেক্ষী বেশ কিছু অভুক্ত পেট, তিনি যদি হঠাৎ জানতে পারেন যে তাঁর সবেধন নীলমনি চাকরিটা খোয়া গেছে, তাঁকে কতটা কাউন্সেলিং করে বা কটা lithium দিলে তিনি মানসিকভাবে স্টেবল হতে পারবেন বলতে পারবেন?
পারা সম্ভব নয়, উত্তরটা আমাদের সকলের জানা কিন্তু আমাদের হাতে যে কিছুই নেই। এটা অনেকটা learned helplessness এর মতো (আপনি জানেন প্রতিকারটা কীসে হবে কিন্তু কিছু করার নেই দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া)। কারণ রোগের শিকড় যে অনেক গভীরে। প্রতিকারের জন্য চাই অনেক কিছুর পরিবর্তন। তার জন্য সমাজের মূল ধরে টানাটানি করতে হবে।
কিন্তু তা বলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাও অনুচিত। আসুন না, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেষ্টা করি একবার, আমাদের evolutionary process এ প্রাপ্ত মানবিক গুণগুলো (যার জন্যে সমস্ত জীবকুলে আমরা নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গর্ব করি) নিয়ে একে ওপরের বিপদে পাশে দাঁড়াই। কোভিড আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিলেও বেশ কিছু জিনিস শিখিয়েও দিয়েছে। Maintain physical distance but stay emotionally connected— এটাই এখন খুব দরকার। তাহলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়তে পারে।

Comments :0

Login to leave a comment