Mutia Mazdoor

বোঝা বইলেও দিনযাপনের মজুরি কই!

ফিচার পাতা


শুভ্রজ্যোতি মজুমদার

"গ্যাসের দাম করেছে হাজার টাকার কাছে। এক কামরার ঘুপচি ঘরের ভাড়া মাসে ৪০০০ টাকা। সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তেমন কিছু মেলে না বাবু। আমরা মুটিয়া, আমাদের কথা সরকার ভাবে না।" এমন করেই যন্ত্রণার কথা জানালেন শেওড়াফুলি হাটের মুটিয়া লালধারী সিং।
পাশেই শেওড়াফুলি জংশনের রেল ইয়ার্ড, মুটিয়াদের আরেক অংশ রেলের পোর্টাররা থাকেন সেখানে। ক্রমশ পৌষ মাসের শেষ যত ঘনিয়ে আসছে পারদ তত নামছে। এই ভরা শীতে রেলের পোর্টার কুলিরা কোনোরকমে নিজেদের দিন কাটাচ্ছেন তিন দিক খোলা রেলের শেডের নিচে। রাজ্যের সর্বত্র শ্রমজীবী মুটিয়াদের চিত্র এরকমই। কলকাতার বড়বাজার পোস্তা থেকে গ্রামাঞ্চলে কোল্ড স্টোরেজ বা ছোট বড় বাজার ছবিটা একই রকম। রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই এই গরিব মানুষগুলোর প্রতি। 
লালধারী সিং’এর বয়স ৩২ বছর। বাড়ি বিহারের বেগুসরাই। অনেক দিন ধরেই শেওড়াফুলি হাটে মোট বয়ে দিনগুজরান করেন। লকডাউনের আগে যেখানে আয় ছিল ৬০০ টাকা রোজ। এখন রোজ কমে হয়েছে ৩০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, বাড়ির ভাড়া, গ্যাসের দামে সিংহভাগ টাকা চলে যায়। বাড়িতে দুই ছেলেমেয়ে আছে তাদের পড়াশোনোর খরচ আছে, কি করে কি করবো? আমাদের আর কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই, মরে গেলে ক্ষতিপুরণও পাবে না পরিবার। না মরে বেঁচে আছি এই যা। 
অপর দুই মুটিয়া বিরজু কুমার ও পরমানন্দ সিং জানান, ‘বামফ্রন্ট ছিল সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সাসফাউ’তে কার্ড করিয়েছিলাম। আমরা কুড়ি টাকা দিতাম সরকার কুড়ি টাকা দিত। বয়স হলে টাকা মিলতো। ২০১১ সালের সরকার বদলে গেল এখন আর ঠিকসময় টাকা মেলে না। এখন তো সরকারে সব চোর আছে। গরিবের কথা সরকার ভাবে? এই তো টিভিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখি, বলে গরিবদের জন্য নাকি ঘুম হচ্ছে না। কই আমাদের জন্য কী করেছে? আর এখানকার সরকারে তো সব চোর আছে। আমাদের বামফ্রন্ট সরকার অনেক ভালো ছিল।’
হুগলী জেলায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ মুটিয়া হিসাবে কাজ করেন। আগে সংখ্যাটা এর দ্বিগুণের বেশি ছিল। এর মধ্যে হিমঘরের মুটিয়া, রেলের পোর্টার, গঞ্জ ও বাজারের মুটিয়ারা আছেন। রাজ্যের অন্যত্র যেমন কলকাতার পোস্তা, বড়বাজার, কাশীপুর, বড়বাজারের মুটিয়ারা যেমন আছেন হাওড়া-শিয়ালদহ রেল ইয়ার্ড, এফসিআই গোডাউন, পোর্ট ট্রাস্টের পোর্টার ও কুলিরা। রাজ্যের অন্যান্য জেলার মুটিয়াদের ধরলে বেশ কয়েকলক্ষ মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত।
এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে কোল্ড স্টোরেজের মুটিয়াদের সংখ্যাটাই বেশি। মূলত রাজ্যের সর্বত্র উত্তর থেকে দক্ষিণ কোল্ড স্টোরেজের মুটিয়াদের অধিকাংশই কনট্র্যাক্ট লেবার হিসাবে কাজ করেন। আগে এক্ষেত্রে স্থায়ী শ্রমিক থাকতো মালের লোডিং আনলোডিংয়ের কাজের জন্য। সেটা আজ কমে গিয়ে কনট্রাক্ট লেবার সিস্টেমে এসে পৌঁছেছে। এখন গ্রামাঞ্চলে কোল্ড স্টোরেজগুলোয় সর্দার থাকে। তারাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রাম, বর্ধমান, মেদিনীপুর সহ পাশের রাজ্য ওডিশা থেকে মুটিয়া এনে কাজে লাগায়। এদের মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা ব্লকের মানুষজনের সংখ্যাই বেশি। এদের না আছে সামাজিক সুরক্ষা, না আছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুবিধা। মরে গেলেও অনেক্ষেত্রে মালিকরা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এড়িয়ে যায়। সিআইটিইউ’র অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ মুটিয়া মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে রাজ্যের অনেক জায়গাতেই শ্রমিকদের স্বার্থে কিছু দাবি আদায় করা গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। 
রেলের পোর্টারেরা আরও কষ্টে রয়েছেন। রেলের পোর্টার ও কুলিরা আগে রেলের দ্বারা নথিভুক্ত ছিলেন। অনেকের হাতে বিল্লা মানে (নম্বর সহ পেতলের ব্যাজ) থাকতো। নির্দিষ্ট পোশাক থাকতো। আজ তাদের দায় আর রেল নিচ্ছে না। রেলের নথিভুক্ত মুষ্টিমেয় কিছু কুলি/পোর্টার থাকলেও বড় অংশের নথি নেই। তারা মূলত মাল বয়ে অর্থ উপার্জন করেন। ভরা শীতে রেলের শেড বা গোডাউনে শুয়ে রাত কাটান। এরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। উদাহরণ স্বরুপ আদ্রা জংশনের কথা বলা যায়, সেখানে রেলের পোর্টারেরা খুবই উপেক্ষিত। 
এছাড়া বড় অংশের যে মুটিয়ারা রয়েছেন তারা হলেন গঞ্জের মুটিয়া। রাজ্যের অনেক গঞ্জ এলাকায় পশ্চিমবঙ্গ মুটিয়া মজদুর ইউনিয়ন উদ্যোগ নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে দর কষাকষি করে মজুরি ঠিক করে দেয়। যেমন হুগলী জেলার চন্দননগরে মালিকদের সাথে ইউনিয়ন প্রতিবছর চুক্তি করে মজুরি নির্ধারিত করে। তবে অনেক হাট বা বাজার এলাকা আছে যেখানে এরকম হয় না। সেখানে মুটিয়াদের মজুরি কমেছে এই কয়েক বছরে। লকডাউনের পর থেকে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে রোজ। গঞ্জের মুটিয়াদের বড় অংশই পাশের রাজ্য বিহারের, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, ছত্তিশগড়ের মানুষ। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শ্রমমন্ত্রী থাকা অনাদি সাহু বর্তমানে সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বামফ্রন্ট সরকারের শ্রম দপ্তরে থাকাকালীন মুটিয়াদের জন্য মডেল কোড তৈরির বিষয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে পালাবদলের পর তৃণমূল সরকার এসে এই সিদ্ধান্তকে আইনে প্রণয়ন করেনি।
পশ্চিমবঙ্গ মুটিয়া ইউনিয়নের রাজ্য ও জেলা সম্পাদক শঙ্কর মুখার্জি জানান, ১০০ কেজির বস্তা হতো আগে। আমাদের আন্দোলনের ফলে বস্তার ওজন সরকার কমিয়ে ৫০ কেজি করে দিয়েছিলো। মুটিয়াদের স্বার্থে সিআইটিইউ ও পশ্চিমবঙ্গ মুটিয়া মজদুর ইউনিয়নের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। আমাদের একটাই দাবি মুটিয়াদের সরকার কর্তৃক সামাজিক সুরক্ষার ব্যাবস্থা থাকতে হবে। শ্রমিকদের সুবিধার্থে মডেল কোড চালু করুক রাজ্য সরকার। তাদের মজুরির হার ঠিক করে দিক।
 

Comments :0

Login to leave a comment