সুব্রত দাশগুপ্ত
‘‘দরিয়ার ডাকে দিলো সাড়া মহাভারতের জনতা/উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে কল্লোলিত মহানগর কলকাতা’’— নৌবিদ্রোহের সুদুরপ্রসারী প্রভাবকে এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন শিল্পী স্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাঁর কালজয়ী গানে। ১৯৪৬সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, বম্বে উপকুলে ‘তলোয়ার’ জাহাজ থেকে যে ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহের রণধ্বনি ঘোষিত হয়েছিল, সেটাই হয়ে উঠতে পারতো ভারতের স্বাধীনতা লাভের শঙ্খনিনাদ। বিদ্রোহীরা এবং তাদের সমর্থনকারী হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক অকাতরে প্রাণ বলিদান দিয়েছেন তাঁরা উত্তর প্রজন্মকে দিয়ে গেছেন বিপ্লব-প্রচেষ্টার এক গৌরবময় উত্তরাধিকার। বিদগ্ধ কমিউনিস্ট নেতা ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের কথায়– ‘এই বিদ্রোহ যুদ্ধোত্তর পর্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ইতিবৃত্তের এক অবিস্মরণীয় কাহিনি।’
বিদ্রোহে অন্যতম ভূমিকা গ্রহণকারী বিসি দত্ত যথার্থই লিখেছেন— ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির বিদ্রোহ সংক্রান্ত সমস্ত প্রাসঙ্গিক নথিপত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রকের মহাফেজখানায় জমা রয়েছে। একমাত্র ভারত সরকারেরই উদ্যোগে আয়োজনে এই বিদ্রোহের সুবিস্তৃত ইতিহাস লেখা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এই ইতিহাস লেখার আজ পর্যন্ত না সরকারের তরফ থেকে হাত পড়েছে, না ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে’ ('Mutiny of Innocents', সিন্ধু পাব্লিকেশনস্, বোম্বাই)। তৎকালীন জাতীয় নেতারা এই বিদ্রোহে যে অবিমৃশ্যকারিতা দেখিয়েছেন তাতে বিদ্রোহের যথার্থ ইতিহাস লেখা হলে তাদের কলঙ্কজনক ভূমিকাই প্রকাশিত হতো। হয়ত এই কারণেই তারা বিরত থেকেছেন।
নৌবিদ্রোহের জ্বালামুখ ১৯৪৬-র ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হলেও তার উদ্গীরণ শুরু হয়েছিল ১৯৪৪-এর প্রথম বিদ্রোহে। এরও প্রায় তিন বছর আগে ভারতীয় সেনবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটিয়ে, গণসংগ্রামের সঙ্গে তার সংযুক্তিসাধন করে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করে ভারতে বিপ্লবী সরকার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪১ সালে গঠিত হয়েছিল ‘আন্ডারগ্রাউন্ড সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন’ বা ‘কেন্দ্রীয় গোপন সংস্থা’। এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ, ফরোয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টি, আরসিপিআই, ওয়ার্কার্স পার্টি, মুসলিম লিগ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি। ‘কেন্দ্রীয় গোপন সংস্থা’র সদস্যরা ছিলেন অচ্যুৎ পট্টবর্ধন, শেখ শাহাদাৎ আলি, ভুলাভাই দেশাই, আরএস রুইকর, ড. গঙ্গাধর অধিকারী, বিটি রণদিভে, কমলা ডোন্ডে, অরুণা আসফ আলি প্রমুখ।
বিদ্রোহ সংগঠিত করার জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নেওয়া হলো ভারতীয় জাহাজীদের সাধারণ দাবিগুলিকেই - ভারতীয় নৌ-সেনা (রেটিং)দের জন্য উন্নত মানের খাবার ও পর্যাপ্ত পানীয় জল, ব্রিটিশ সেনাদের সম-অনুপাতে মাইনে, ঠিক সময়ে মাস-মাইনে পরিবারের কাছে পাঠানো ইত্যাদি। কিন্তু ভিতরে প্রচার সংগঠিত করা হচ্ছিল যে, ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে না পারলে এই অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা কোনোকিছুরই স্থায়ী অবসান হবে না। এই চূড়ান্ত লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে '৪৩-র ১মে 'গোপন সংস্থা' এক ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় কার্যকরী করার নির্দেশ পাঠায়। ফিসফিস প্রচার, জাহাজে, ব্যারাকে এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, অন্তর্ঘাতী কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব তৈরি করা এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ- সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয় সেনাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করার এই কর্মসূচি পালনের অক্ষকেন্দ্র নির্ধারিত হলো নৌবাহিনী এবং সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়বে অন্য দুই বাহিনীতে। আন্দোলন শুরুর দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হলো ১৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে।
কিন্তু এর মধ্যেই নেমে এল বিপর্যয়। ৯ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় গোপন সংস্থার দু’জন মহিলা সদস্যা, 'উইমেন্স রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি'তে কর্মরতা মহারাষ্ট্রের উর্মিলা বাঈ আর বাংলার অনুভা সেন, গোপনে সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গুপ্তচরদের হাতে। তাঁদের হেপাজত থেকে পুলিশ উদ্ধার করলো গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথিপত্র। এবার শুরু হলো ভারতীয় সেনাদের মধ্য থেকে 'ডাইনি খোঁজা'র কাজ। ধূর্ত প্রশাসন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে, চলমান বিশ্বযুদ্ধে 'মিত্রপক্ষ'র দ্বিতীয় ফ্রন্টকে সাহায্যের অছিলায়, ১১ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ আফ্রিকা সীমান্তে পাঠানোর নামে সন্দেহভাজন ভারতীয় নৌ সেনাদের সেগুলিতে চালানের ব্যবস্থা করে। মূল লক্ষ্য ছিল আরব সাগরের মাঝদরিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজগুলিকে ধ্বংস করে সেনাদের ডুবিয়ে মারা। খবর জানতে পেরে ১০ ফেব্রুয়ারি রাতেই নৌ-বাহিনীর ‘অ্যাকশন কমিটি’র সদস্যরা ‘তলোয়ার’ জাহাজে গোপন সভায় মিলিত হয়ে ধর্মঘটের কর্মসূচি ১৮ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে নিয়ে আসে। কেন্দ্রীয় সংস্থাকে এই খবর জানিয়ে, বাকি দুই বাহিনীকেও রাতের মধ্যেই গোপন পথে খবরটা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেওয়া হলো কংগ্রেস নেতা ভুলাভাই দেশাইকে। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে আন্দোলন শুরু হলো। জাহাজীদের পাশাপাশি ব্যারাকগুলিতেও রেটিংরা শামিল হলো আন্দোলনে। ভারতীয় আধিকারিকদের দিয়ে রেটিংদের বোঝানোর কৌশল ব্যর্থ হলে, কম্যান্ডিং অফিসার ইনিগো জোন্স সরাসরি আক্রমণের পথ বেছে নিল। সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিরোধে চলল মরণপণ লড়াই। একই সময় করাচিতেও ‘খানা বনধ’, আন্দোলন পরিণত হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামে। নৌ-সেনারা নিশ্চিত ছিল যে তাদের পাশাপাশি স্থল ও বিমানবাহিনীও বিদ্রোহ শুরু করে ইংরেজদের দিশাহারা করে দেবে, ফলে জয় তাদের নিশ্চিত। কিন্তু না, সেটা হলো না। কারণ, ১১ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ ঘোষণার সিদ্ধান্ত অন্য দুই বাহিনীকে রাতের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়ার যে গুরুদায়িত্ব ভুলাভাই দেশাইকে দেওয়া হয়েছিল, তিনি তা ঐ দুই বাহিনীকে জানিয়েছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। তিনি পরে স্বীকার করেছিলেন যে এটা তার ভুল, কিন্তু বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এটা নিছক ভুল নয়,এটা বিশ্বাসঘাতকতা।
প্রথম বিদ্রোহ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন করা হলো, নেমে এল পাশবিক প্রতিহিংসা। ৩১ মার্চ বীরাঙ্গনা উর্মিলা বাঈ আর অনুভা সেনকে খোলামাঠে চাঁদমারীর দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে চারজন সেপাইকে দিয়ে গুলি করে মারা হলো। শহীদিবরণের আগে তাঁদের বজ্রকণ্ঠ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো - ''ভারতের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, জয় হিন্দ!"
প্রথম বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ‘কেন্দ্রীয় গোপন সংস্থা’ ভেঙে যায়নি, কিছু নুতন সদস্য নিয়ে তাকে পুনর্গঠিত করা হলো। তাঁদেরই প্রায় দু'বছরের প্রচেষ্টায় আবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো ১৯৪৬-র ফেব্রুয়ারিতে।
প্রথম বিদ্রোহকে স্মরণে রেখে ১৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো আন্দোলন -'খানা বনধ্' এবং 'খানা বনধ্ তো কাম বনধ্'। এবার আরও সংগঠিত ধর্মঘট। রিয়্যাল এডমিরাল রাটট্রে কৌশলে আন্দোলন দমন করতে করতে গেলে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়। আলোচনার প্রস্তাব বাতিল করে নাবিকরা আওয়াজ তোলে 'ভারত ছাড়ো'। পরের দিন সকালে ক্যাসেল ব্যারাকে খবর ছড়ায় যে 'তলোয়ার' জাহাজে ধর্মঘটী নাবিকদের উপর উপর গুলিবর্ষণ হয়েছে। ব্যাস, আগুনে ঘি পড়ার অবস্থা হলো। বিভিন্ন ব্যারাক থেকে রেটিংরা ছুটল 'তলোয়ার'-এর দিকে। তার পাশে এসে দাঁড়ালো বোম্বাই উপকূলের এগারটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় কুড়ি হাজার রেটিং। ধর্মঘট ব্যাপ্ত হলো চুয়াল্লিশটি জাহাজ, চারটি মেজর বেস্ ,চারটি ফ্লোটিলা এবং কুড়িটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। পোতাশ্রয়ের সব জাহাজ থেকে ব্রিটিশদের জাতীয় পতাকা 'ইউনিয়ন জ্যাক' নামিয়ে, একসঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া হলো কংগ্রেস-মুসলিম লিগ-কমিউনিস্ট পার্টির ঝান্ডা। পরের দিন সকালের মধ্যে ভারতীয় নৌ বাহিনীর সমস্ত সংস্থা থেকে ব্রিটিশরা তাদের আধিপত্য হারালো। ইতোমধ্যে আরব সাগরের সুনীল জলরাশিতে কল্লোল তুলে, বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে, বোম্বাই বন্দরে এসে উপস্থিত হলো শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ 'এইচ এম আই এস খাইবার'। 'খাইবার' এর উপস্থিতি বিদ্রোহী নাবিকদের মধ্যে তুমুল উন্মাদনা সৃষ্টি করে।
এই সময়ে আসরে নামলেন বল্লভভাই প্যাটেল। বিদ্রোহী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন প্রচেষ্টা শুরু করলেন বামপন্থী দলগুলিকে বাদ দিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি সামলে দেওয়ার। কিন্তু তার এই ছক ধোপে টিকলো না। ‘ফ্রি প্রেস জার্নাল’ খবর প্রকাশ করে দিল যে সমস্ত নৌবহর ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছে এবং স্থল ও নৌবাহিনীও বিদ্রোহের পথে এগচ্ছে। বোম্বাই উপকুলে উপস্থিত ৭৪টি জাহাজেই ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে একই দড়িতে বেঁধে উড়িয়ে দেওয় হলো কংগ্রেস-মুসলিম লিগ ও কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা। বিদ্রোহীদের পক্ষে অত্যন্ত ইতিবাচক এই পরিস্থিতিতেও জাতীয় নেতারা চাইলেন রোটিংরা যেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপোষে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে! এ এক ভয়ঙ্কর আপসকামিতা। রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহীরা যেমন হতাশ হচ্ছিল, তেমনি ধূর্ত ব্রিটিশ প্রশাসনও নেতাদের মনোভাব বুঝে নিয়ে বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। জাহাজীদের হরতালের সমর্থনে মুম্বাইয়ের শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার জাহার মানুষ পথে নামে। জনজীবন স্তব্ধ হয়। অ্যাডমিরাল র্যােটট্রে সারা বোম্বাইয়ে ‘মার্শাল ল’ জারি করে। গডফ্রের নির্দেশে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিরস্ত্র মানুষের সমাবেশের উপর নির্বিচারে মেশিনগান ও বোম্বার্ড-কার চালিয়ে দেয়। বেছে বেছে আক্রমণ চালানো হয় ওয়াটার ফ্রন্ট প্যারল বস্তি আর ডকইয়ার্ডে। এই ওয়াটার ফ্রন্ট বস্তি থেকেই গোপনে খাবার আর জল পাঠানো হতো বিদ্রোহী জাহাজীদের কাছে। ‘খাইবার’র সৈনিকদের আত্মীয়রাও সব থেকে বেশি সংখায় এই বস্তিগুলিতেই বাস করত। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ প্রাণ হারালো। প্রতিরোধে শামিল প্যারোল মহিলা সমিতির কমিউনিস্ট নেত্রী কমলা ডোন্ডে-র দেহ ব্রিটিশদের গুলি আর বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পথের ধুলায় মিশে যায়। এই হত্যালীলার বীভৎসতায় ক্রুদ্ধ ‘খাইবার’ এবং ‘নর্মদা’ পালটা আঘাত হেনে দূরপাল্লার কামান দেগে উড়িয়ে দেয় ক্যাসেল ব্যারাকের ইংরেজ বসতিকে। ক্ষিপ্ত জনতা দেশবাসীর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোকানপাট আগুন জ্বেলে ধ্বংস করে, হত্যা করে ইংরেজদের। সারা বোম্বাই তখন কার্যত বিদ্রোহী জাহাজী আর সংগ্রামী জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বিদ্রোহ চলাকালীন অ্যাডমিরাল র্যা টট্রে এবং বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনারের ফোনালাপের কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যাক। র্যা টট্রে -‘‘কম্যুনিস্ট পার্টির সবকটা অফিস দখল করা হয়েছে কি? ক'টাকে অ্যারেস্ট করেছেন? কি বললেন? বি টি রণদিভে? গা-ঢাকা দিয়েছে? খুঁজুন। বার করুন প্রত্যেককে। ওরাই যে সবচেয়ে অ্যা গ্রেসিভ, এটা তো বুঝতে পারছেন'’( সূত্র : আর্কাইভ ) |
২১ ফেব্রুয়ারি সরকারের আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়লো। করাচী, বোম্বাই সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের স্থল ও বিমানবাহিনীর সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হলো নৌ-বিদ্রোহ দমনে, কিন্তু তারা সেই নির্দেশ অমান্য করে ধর্মঘট করল। ধর্মঘট কমিটির নেতারা আবার জাতীয় নেতাদের আহ্বান জানালেন নৌবহরের কর্তৃত্বভার গ্রহণের জন্য এবং এও জানালেন যে জাতীয় নেতাদের কাছে তাঁরা আত্মসমর্পন করতে প্রস্তুত আছেন কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পন করবেন না। এদিকে ব্রিটিশ সৈন্য আবার আক্রমণ শুরু করলে রেটিংরা দাঁড়াল মুখোমুখি যুদ্ধে। পোতাশ্রয়ের সমস্ত জাহাজকে নির্দেশ দেওয়া হলো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে। যুদ্ধ চালানোর জন্য জাহাজীদের খাবারের প্রয়োজন হলে শহরের হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র পাড়ে এসে দাঁড়ালো খাবার প্যাকেট ও জল নিয়ে। সে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা। শহরের রেস্টুরেন্টের মালিকরা জনতাকে অনুরোধ জানালো যত খুশি খাবার বিদ্রোহী রোটিংদের জন্য তুলে নিয়ে যেতে। তথ্য ঘেঁটে জানা যায় যে রাস্তার ভিক্ষুকরা পর্যন্ত তাদের সাধ্যমত ছোট ছোট খাবারের প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়েছিল তাদের ধর্মঘটী বন্ধুদের হাতে তুলে দিতে।
মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে বিদ্রোহী জাহাজগুলি থেকে বিপুল উৎসাহে ইংরেজ সৈন্যদের ঘাঁটিগুলির উপর গোলা ও বোমাবর্ষণ শুরু হলো। বিদ্রোহীদের অনড় মনোভাব আর জনতার মেজাজ বুঝতে পেরে কর্ত্তৃপক্ষ সময় ব্যয় করার কৌশল নিল। অ্যাডমিরাল গডফ্রে প্রস্তাব পাঠালো আলোচনায় বসার। গোলাগুলি বন্ধ করে, ধর্মঘট কমিটির সভাপতি এসএম খান জাহাজের বাইরে এলেন আলোচনায় বসতে। গডফ্রে এল না, সময় নষ্ট হলো। যুদ্ধবিরতির এই সময়ের মধ্যে আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অতিরিক্ত ব্রিটিশ সৈন্য এসে গেল। অ্যাডমিরাল র্যা টট্রে প্রাণে বল পেয়ে পূর্বঘোষিত আলোচনা প্রস্তাব বাতিল করে জাহাজীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিল। রাজপথে তখনও সশস্ত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে লড়ে যাচ্ছিল আমজনতা, বিশেষতঃ শ্রমিকরা। এ’ছিল এক অনন্য গণঅভুত্থান। কিন্তু একসময় এ অসম লড়াই শেষ হলো। হাজার হাজার মানুষ গুলির আঘাতে প্রাণ দিল। রক্ত দিয়ে লিখে গেল স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়।
সেদিন রাতে বল্লভভাই প্যাটেল সহ নেতারা জাহাজে এলেন বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে। প্যাটেল তাদের কাছে আবেদন করলেন আত্মসমর্পণের এবং নিশ্চয়তা দিলেন যে বিদ্রোহী জাহাজীদের বিরুদ্ধে যাতে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হয় তা দেখবেন। অ্যনদিকে কলকাতায় বসে মহম্মদ আলি জিন্নাহ প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উপদেশ দিলেন নিয়মতান্ত্রিক ও আইনসঙ্গত পথে চলার। নৌ-সেনারা জাতীয় নেতাদের পরামর্শ মেনে নিলেন। ধর্মঘট কমিটি দেশের জনগণের কাছে তারবার্তায় আবেদন রাখলেন- ‘আমাদের জনগণের কাছে আমাদের শেষ কথা, আমাদের জাতীয় জীবনে এই ধর্মঘট এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই প্রথম জনগণের এবং সৈনিকগণের রক্ত একত্রে মিলিত হয়ে বয়ে চলেছে এক সাধারণ উদ্দেশ্যে। আমরা সৈনিকরা এই ইতিহাস কখনো ভুলবো না। আমাদের ভাই ও ভগিনীগণ, তোমরাও যে ভুলবে না, তাও আমরা জানি। আমাদের মহান জনগণ দীর্ঘজীবী হোক। জয়হিন্দ!’’
কিন্তু বিদ্রোহী জাহাজগুলিতে শান্তির পাতাকা উড়িয়ে জাহাজীরা যখন তাদের আন্দোলনের বিজয় উদ্যাপন করছে, সেই সময় প্রতিহিংসা প্রবণ ইংরেজ নিজেদের প্রাথমিক পরাজয়ের গ্লানি কাটাতে প্র্যতাঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের ব্যূহ রচনা করে বিদ্রোহী জাহাজগুলিকে ঘিরে ফেলে কামান ও মেশিনগান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। হতচকিত বিদ্রোহী জাহাজীরা বুঝে উঠতেই পারলো না যে তাহলে জাতীয় নেতাদের প্রতিশ্রুতির মূল্য কোথায়! আর এখন সেই নেতারাই বা কোথায়? পরিস্থিতির ভয়ঙ্করতা বুঝে বিদ্রোহীরা মরিয়া প্রচেষ্টা চালালো প্রতিরোধের। আবার হাতে তুলে নিল দূরে সরানো অস্ত্রগুলো। ইতোমধ্যেই ঝটিকা আক্রমণে দেড়শো জনের বেশি বিদ্রোহী নাবিক মারা পড়লো। ‘খাইবার’ থেকে বেতার সংকেতে আবার ঘোষণা হলো যুদ্ধ শুরু করার– ঘোষণা হলো ‘ডু অর ডাই’। বিদ্রোহী মদন সিং ‘খাইবার’-এর দূরপাল্লার বড় কামানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘন ঘন কামান দাগতে শুরু করলেন। এরই মধ্যে বেতারে খবর পেয়ে ‘করভেট কাথিয়ার’ গভীর সমুদ্র থেকে তীরের দিকে এগিয়ে এল বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে। সম্মিলিত প্রতিরোধে প্রায় দেয় হাজার ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গোলা-বারুদ-রসদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষপর্যন্ত বীর বিদ্রোহীরা বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পণ করল সেই ঘৃণিত ব্রিটিশ শক্তির কাছে। ব্রিটিশ তার বর্বর প্রতিশোধস্পৃহা পূরণ করল কোর্ট মার্শালে বিচার করে। হাজার হাজার বিদ্রোহীকে কারারুদ্ধ করা হলো, শত শত নাবিককে ডুবিয়ে মারা হলো, গুলি করে হত্যা করা হলো। বিদ্রোহের দুই প্রধান নেতা–এস এম খানকে দু’পায়ে একমন ওজনের পাথর বেধে আরব সাগরের মাঝখানে নিয়ে ডুবিয়ে মারা হলো আর মদন সিংকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হলো। সাড়ে চার হাজার ভারতীয় সৈন্যকে কুখ্যাত মুলতান জেলে পাঠানো হলো মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনতে। আরব সাগরের তীরে অস্তমিত হলো দেশকে স্বাধীন করার জন্য পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহী দেশপ্রেমিকের বুকভরা স্বপ্ন। এই মহাসংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছিল ‘তলোয়ার’ আর তার থেকে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছিল ‘খাইবার’। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে তাদের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে আর লেখা থাকবে সেই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের নাম, যাঁরা ‘দু’পায়ে দলে গেল মরণ শঙ্কারে/সবারে ডেকে গেল শিকল-ঝংকারে।’
Comments :0