নিরাপদ সরদার
সন্দেশখালির ত্রাস শেখ শাহজাহান। মমতা ব্যানার্জির মানসপুত্র: ‘ভালো ছেলে, ভালো সংগঠক, ভালো ভোট করে।’
এমন নেতা যে ভয়, ভীতি, সন্ত্রাস, ধমকিয়ে, চমকিয়ে মানুষকে বশংবদ করে রাখতে পারে।
সন্দেশখালি পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সুন্দরবনের পাদদেশে অবস্থিত। ১৩টি নদী ৯টি দ্বীপবেষ্টিত এলাকা। ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২টি ব্লক সন্দেশখালি ১ও সন্দেশখালি ২। দুটি থানা ন্যাজাট ও সন্দেশখালি। শিবপদ হাজরা, সত্যজ্যোতি সান্যাল, জিয়াউদ্দিন মোল্লা, শেখ সিরাজ সহ প্রায় দুই শত সশস্ত্র বাইকবাহিনী দিয়ে লুটের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে শাহজাহান। প্রচুর বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রর মজুত আছে দ্বীপগুলোতে। দ্বীপগুলোতে টিম লিডার আছে। তাদের নেতৃত্বে লুট, সন্ত্রাস তোলাবাজি চলে। তার বড় ভগ্নাংশ জমা হয় শাহজাহানের কাছে। পঞ্চায়েতে এলাকা উন্নয়নের টাকা এদের হাত দিয়ে জমা হয় শাহজাহানের কাছে। শাহজাহানের হাত দিয়ে টাকা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও কালীঘাট পর্যন্ত চলে যায়। ফলে দুষ্কৃতীরা মনে করে সরকারটা তাদের। গড়ে উঠলো পুলিশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের বন্ধুত্ব।
২০১১ সালে সরকার বদলের পর হাত পড়লো খাস, ভেস্টেট ও বর্গাজমির ওপর। ২০১৩সালে খুলনা অঞ্চলের চাষিদের পাট্টা জমি কেড়ে নেয় তৃণমূল বাহিনী।
সেই জমি রক্ষার আন্দোলনে মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করে তৃণমূল বাহিনী। প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সরদার সহ আহত হন ১৭জন আদিবাসী। এদের মধ্যে ১০ জন আদিবাসী মহিলা। থানায় অভিযোগ হয়েছে, কিন্তু অ্যারেস্ট হয়নি দুষ্কৃতীরা। ২০১৪ সালে সন্দেশখালিতে রামপুর হালদার ঘেরিপাড়ায় তৃণমূলের বোমা, গুলিতে পুলিশ সহ ১৬জন আহত হন। কয়েক জন গুরুতর জখম হলে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কেস হয়েছে, কিন্তু অ্যারেস্ট হয়নি। ২০১৯ সালে রাজবাড়িতে ৪জন রাজনৈতিক খুন, এবং খুলনায় পুলিশ খুন।
২০২১ সালে ৩০০ পরিবারের আবাস যোজনার প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা তৃণমূল লুট করেছে। সন্দেশখালি-২’র বিডিও প্রতিবাদ করলে অফিসে ঢুকে বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। কেস হয়েছে কিন্তু অ্যারেস্ট হয়নি। আসামিরা বহাল তবিয়তে বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ তারা সকলেই শাহজাহান বাহিনীর। ২০২৩ সাল। শাহজাহান বাহিনীর কর্মীরা মাসের পর মাস বিদ্যুৎ বিল দেয় না। বিদ্যুৎকর্মী ও অফিসাররা বলতে এলে তাঁদের মারধর করে উলটে তাঁদের বিরুদ্ধে ন্যাজাট থানায় এফআইআর করা হয়। এভাবেই শেখ শাহজাহানের একনায়কতন্ত্র ও লুটের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
নদী ভরাট করে নদীর চরে মেয়ের নামে গড়ে তুলছে মীনবাজার। সমস্ত মীন ব্যবসায়ীদের এখানেই মাছ দিতে হবে। অন্যথা হলে তার ওপর অত্যাচার হবে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
সরবেড়িয়ায় গড়ে তুলেছে বিশাল মাছের আড়ত। ধামাখালি, বেড়মজুর, সরবেড়িয়া আগার আটি, বয়ারমারি, কানমারী-সমস্ত ফিশারি থেকে মাছ আসে তাঁর আড়তে। অন্যথা হওয়ার উপায় নেই। অন্যথা হলে ফিশারি লুট হয়ে যাবে।
এভাবেই ইটভাটা থেকে ইট নিতে বাধ্য করে পঞ্চায়েত ও ব্লকের ঠিকাদারদের। পঞ্চায়েতে যত কাজ, সব কাজে ইটের মালিক শেখ শাহজাহান। তার কাছ থেকে ইট নিতে হবে। অন্যথা হলে পেমেন্ট বন্ধ। আবাস যোজনার টাকা, গরিব মানুষের হকের টাকা। সেখানেও তৃণমূলের ভাগ। ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত তৃণমূল বাহিনীকে দিতে হয়। না দিলে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা আর পাবে না। গরিব মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাকা দিতে বাধ্য হয়।
১০০ দিনের কাজের টাকা দেদার লুট। লুট করার জন্য তৈরি করেছে ভুয়ো জবকার্ড। সেই জবকার্ডের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা লুট করেছে তৃণমূলের নেতা, কর্মীরা। কাজ না করে পুকুর দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে।
সন্দেশখালিতে একশোর বেশি রেশন ডিলার বিভিন্ন দ্বীপ এলাকায় আছে। এরা সকলেই ন্যাজাট থেকে অ্যালটমেন্ট পায়। রেশনের মাল খুবই নিম্নমানের। মানুষের খাওয়ার অযোগ্য। বাধ্য হয়ে হাঁস, মুরগিকে খাওয়ায়। আটা খুব খারাপ, মাছের খাবার হিসাবে ব্যবহার করে। সন্দেশখালিতে অভিনব নাটক করে তৃণমূল। শাহজাহান তার কর্মীদের দিয়ে করায়। রেশন ডিলারের দোকানের সামনে বিক্ষোভ। কি না, খারাপ মাল দিচ্ছো কেন। মাল বদলি করছে শাহজাহান, চুরি করছে শাহজাহান, ভালো সাজার জন্য কর্মীদের দিয়ে বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন তিনি! রেশনের মাল বস্তা পাল্টি করে খারাপ পচা মাল চলে আসে ডিলারের গোডাউনে। ভালো মাল বাইরে সাপ্লাই হয়ে যায়। রাস্তায় মাল পাল্টি হয়ে যায়। হাজার হাজার গরিব মানুষ রেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ডিজিটাল রেশন ব্যবস্থায় গরিব লোকগুলো রেশন পাচ্ছেন না। রেশন দুর্নীতিতে বালু, শাহজাহান পরস্পরের বাল্যবন্ধু। তাই তো তার মেয়ে শাহজাহানকে খুব ভালো সমাজকর্মী হিসাবে চেনে।
২০১১ সালের পর মূলত রাজনীতিতে শাহজাহানের হাতেখড়ি। একেবারে গরিব পরিবারেই জন্ম। দিন গুজরানে সংসার চলতো। সেখান থেকে উত্থান তৃণমূলের লুটেরাতন্ত্রের শরিক হয়ে। কিন্তু মিডিয়া মাঝে মাঝে শাহজাহানকে ‘সিপিএম’ বানিয়ে ফেলছে। ‘সিপিএম’ নাকি ওকে তৈরি করেছে, এখন তৃণমূল ব্যবহার করছে। শুনলে মনে হতেই পারে, হয়তো ঠিক। কিন্তু আসল বিষয়টি অন্য, সাধারণ মানুষ কখনো কোনও দলের হতে পারে না। সিপিআই(এম) বলতে কাকে বুঝি? পার্টির এজি সদস্য, সিএম (প্রার্থী সদস্য), পিএম (পার্টি সদস্য), এরা হলো সিপিআই(এম)। এর কোনোটাই শাহজাহান কখনও ছিল না। এমনকি গ্রাম কমিটি, বুথ কমিটি কোনোটির সদস্য ছিল না। সিপিআই(এম)’র কিছু গণসংগঠন আছে। সেখানেও ব্লক, অঞ্চল ও বুথের কোনো স্তরেও সে সদস্য ছিল না। তাহলে কীসের ভিত্তিতে বলা হয়? সিপিআই(এম)’কে কলুষিত করার জন্য।
বাম জমানার পর পঞ্চায়েতে প্রচুর টাকা। খরচ না করে নিজেরা ভাগাভাগি করে নেয়। ওপর থেকে নিচ, সবস্তরের নেতারা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, ‘‘ভাগ করে খাও। নিজে খাও, কম হলেও কিছু দাও।’’ এর ফলে দুষ্কৃতীরা দেখলো, এটা আয় বা রোজগার করার ভালো রাস্তা। মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলে আর কে আটকায়।
এখান থেকে লোভ, লালসা, আত্মম্ভরিতা গ্রাস করে। ধীরে ধীরে শাহজাহান তৃণমূলের নেতা হয়ে ওঠে।
চুরি, লুট, খুন, সন্ত্রাস ও দখলদারির মধ্যে হয়ে ওঠে শেখ শাহজাহান। আদিবাসীদের জমি জোর জবরদস্তির মাধ্যমে দখল করে। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মুখ খুললে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। প্রকাশ্যে গাছে বেঁধে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রাখে। হুকুম জারি করা হয়, কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবে না। মানুষের মধ্যে ভয়, ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
সন্দেশখালির বর্গাদার, পাট্টা হোল্ডারদের জমি জোর জবরদস্তি করে কেড়ে নেয়। জমি চলে যায় তৃণমূলের সন্ত্রাসবাহিনীর হাতে। মেছো ঘেরি, ইটভাটা, মাছের আড়ৎ, সরকারি সম্পত্তি-এভাবেই তার দখলে চলে আসে। ধামাখালি থেকে নদীপথে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ, গোপন ব্যবসা, সুন্দরবনের কাঠ, মধু-সবেতেই তার অংশ থাকে। পুলিশ প্রশাসন তার হুকুম পালনের জন্য ব্যস্ত থাকে।
সন্দেশখালি দ্বীপ এলাকা। ১৩টি নদী, ৯টি দ্বীপ বেআইনি অস্ত্র রাখার ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালের পর সন্দেশখালিতে ভোট হয় না। ভোটে কেউ প্রার্থী হতে পারে না। যারা প্রার্থী হয়, তাঁদের সর্বস্ব হারাতে হয়। নির্মম অত্যাচার, মা-বোনের উপর আক্রমণ, মারধর, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, হাঁস, মুরগি, গোরু, ছাগল, জমিজমা, পুকুরের মাছ-সব লুট হয়ে যায়।
মানুষ আর ভোট দিতে পারে না। তাঁদের ভোটাধিকার নেই। বিধানসভা ও লোকসভা ভোটেও মানুষ ভোট দিতে পারেননি। কেন্দ্রীয় বাহিনীও তার পকেটে চলে আসে। টাকাপয়সা দিয়ে ভালোমন্দ খাইয়ে বোবা করে রাখে। ভোট দিতে দেয় না। লাইনে দাঁড়িয়ে আঙুলে কালি লাগিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়, আর বলতে হয়, ভোট দিয়েছি। তৃণমূলের কর্মীকেও ভোট দিতে দেয় না, ছাপ্পা মেরে নেয়। ভোটবাক্সে ওরা কাউকে বিশ্বাস করে না। এতকিছুর পরেও স্ট্রংরুম থেকে বাক্স পাল্টে জেতাটা নিশ্চিত করে। এই সব ঘটনা মানুষ দেখেছেন।
যদি জিজ্ঞেস করেন, সন্দেশখালির মানুষ কেমন আছেন? সবাই বলবে, ভালো আছি। অত্যাচারীর অত্যাচারে মানুষ নিথর পাষাণ হয়ে গেছে। দুঃখের কথা কাউকে বলতে চায় না। সন্দেশখালি শেখ শাহজাহানের অত্যাচারে বধ্যভুমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে শাসন, শোষণ, অত্যাচার, সবই শাহজাহানের ইচ্ছায়।
গত ৫ জানুয়ারি ২০২৪, ইডি অফিসাররা সকাল ৭টায় কোর্টের নির্দেশে শাহজাহানের বাড়ি তদন্তের জন্য যায়। গিয়ে দেখেন, ভেতর থেকে তালাবন্ধ। ডাকাডাকি করলেও কেউ বেরোয়নি। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর ইডি অফিসাররা তালা ভাঙার চেষ্টা করেন। এমন সময় তৃণমূলের সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী কিছু লোকজন নিয়ে হামলা করে। কেন্দ্রীয় বাহিনী সহ ইডি কর্তারা অনেকেই গুরুতরভাবে জখম হন। তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো। শাহজাহানের বাড়ি তদন্ত হলো না। সবাই হতাশ হয়ে ফিরে গেল। ঘটনার পর সংবাদমাধ্যম গোটা ঘটনা দেশের মানুষকে জানানোর চেষ্টা করেছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও সেদিন আক্রান্ত হয়েছেন তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীরা হাতে।
এই সব ঘটনার সঙ্গে সরাসরি পুলিশ জড়িত। পুলিশ শাহজাহানকে আড়াল করে রেখেছে। এটাও উপরের পুলিশকর্তার নির্দেশ। তা না হলে যারা মেরে মাথা ফাটালো, সরকারি কাজে বাধা দিল, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করল, তাদের বিরুদ্ধে ন্যাজাট থানা জামিনযোগ্য ধারা দিয়ে মামলা করে? মজার ব্যাপার, শাহজাহানের বাড়ির পাহারাদারের অভিযোগে থানা, ইডির অফিসারদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারা দিয়ে মামলা দায়ের করেছে।
রাজ্য পুলিশ কতটা নির্লজ্জ হলে একাজ করতে পারে। এই পুলিশ সন্দেশখালির সাধারণ মানুষের কী নিরাপত্তা দেবে বলুন।
Comments :0