Betel Cultivation

পান রোগের আক্রমণ ও প্রতিকার

বিশেষ বিভাগ

তপন বিশ্বাস-ইসলামপুর

পান একটি অর্থকরী ফসল, যার বৈজ্ঞানিক নাম পাইপার বিটল। ভারতবর্ষে পানের উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ হয় পশ্চিবঙ্গে। এছাড়াও, ওড়িশা, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যে পানের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর হাওড়া হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং নদিয়া সহ বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ জেলাতেও কিছু কিছু পানের চাষ হয়। পানের বরজের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতেও পানের চাষ হয়।
পানের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। কিন্তু রোগবালাই পান উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পানে গোড়া পচা, ঢলে পড়া, পাতা পচা, অ্যানথ্রাকনোজ, সাদা গুঁড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাই পানের কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নারায়ণ চন্দ্র সরকার ও  ইসলামপুরের উদ্যান পালন বিভাগের আধিকারিক অনিক মজুমদারের এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।
 

১. রোগের নাম : কাণ্ড পচা/গোড়া পচা 
রোগের কারণ : স্ক্লেরোসিয়াম রফসি  নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে। মাটিতে জৈব সার বেশি ও খড়কুটা থাকলে এবং জল সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
 

রোগের লক্ষণ :
গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে।
গ্রীষ্মকালে মাটির ওপর শায়িত লতায় এ রোগ হয়। গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গোড়ায় লক্ষ করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দুটি পর্ব মধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে। উপরে লতার পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঝড়ে পড়ে। মাটি সংলগ্ন লতার ওপর সাদা সুতার মতো ছত্রাক মাইসেলিয়া দেখা যায়। পরে হালকা বাদামি থেকে বাদামি সরিষার ন্যায় এক প্রকার অসংখ্য দানার মতো স্কে¬রোাসিয়া দেখা যায়। মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।
 

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদ্রে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
ট্রাইকোডারমা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
 

২. রোগের নাম : শিকড় পচা 
রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি  নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : মাটি, ফসলের পরিতক্ত অংশ ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
 

রোগের লক্ষণ :
গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে। পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়। এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
 

রোগের প্রতিকার :
সম্ভব হলে মাটি শোধন করতে হবে।
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
 

৩. রোগের নাম : ঢলে পড়া 
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে 
এবং  সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
 

রোগের লক্ষণ :
গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
কাণ্ডের ভাস্কুলার টিস্যু আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভেতরে দাগ দেখা যায়। পরে গাছ ঢলে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মরে যায়।
 

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
 

৪. রোগের নাম : গোড়া-লতা ও পাতা পচা 
রোগের কারণ : ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : কম ম্যাগনেসিয়াম ও বেশি লবণাক্ত মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশি। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
 

রোগের লক্ষণ :
প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় জল ভেজা হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ বিস্তৃত হয়ে বড় হতে থাকে। দাগ পাতার কিনারা হতেও শুরু হতে পারে। অবিরত বৃষ্টিপাত স্থলে রোগটি পাতা হতে বোঁটায় এবং লতায় সংক্রমিত হয়।
আক্রান্ত পাতা ও লতায় এক প্রকার কালো দাগ পড়ে। ওই দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পচে যায়।
আক্রান্ত পাতা ঝরে পড়ে। পরে গাছের শিকড়, লতা ও পাতা পচে এক প্রকার দুর্গন্ধ নির্গত করে।
আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যায়।
 

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছের পাতা তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
রোগমুক্ত লতা বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী জাত  চাষ করতে হবে। ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্রাইকোডার্মা জীবাণু সার ৫ গ্রাম হারে প্রতি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
বরজে রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড অথবা কমপেনিয়ন প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ সব গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
 

৫. রোগের নাম : ক্ষত বা পাতার দাগ 
রোগের কারণ : কোলেটোট্রিকাম পাইপারিস নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে দ্রুত রোগ বাড়ে।
 

রোগের লক্ষণ :
প্রথমে পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট ফোস্কার মতো অসম দাগ পড়ে।
দাগগুলো কিনারা থেকে ভেতরের দিকেই বেশি দেখা যায়। দাগগুলো হালকা বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি হয় এবং চারিদিকে হলুদ বর্ণের হয়।
দাগগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। অনেক দাগ এক সঙ্গে মিলিত হয়ে বড় দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি করে।
পরে প্রতিটি দাগের মাঝখানে কালো ও চারিপাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
দাগগুলোর মাঝখানটা শুকিয়ে যায় এবং সমগ্র পাতা নষ্ট হয়ে পড়ে।
বেশি দাগ হলে পাতা খসে পড়ে।
 

রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ হতে তুলে পুড়ে করতে হবে। নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা রোপণ করতে হবে । রোগ প্রতিরোধী জাত  চাষ করতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার জলে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
 

৬. রোগের নাম : সাদা গুড়া 
রোগের কারণ : অয়িডিয়াম পাইপারিস 
রোগের বিস্তার : গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং ৫০ থেকে ৬০% বাতাসের আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।
 

রোগের লক্ষণ :
পাতার নিচের পিঠ সাদা থেকে হালকা বাদামি গোলাকৃতি পাউডার লাগানো দাগ পড়ে। পরে দুই পিঠেই দাগ হয়।
দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। দাগ পড়া এলাকাটি পরে বাদামি রঙের হয়, শুকনো ও ভঙ্গুর হয়।
কচি পাতা আক্রান্ত হলে সে পাতা আর বাড়ে না এবং বিকৃত হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে। লতার বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
 

রোগের প্রতিকার :  
রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ এবং আর্বজনা পুড়ে ফেলতে হবে। দ্রুতবেগে জল স্প্রে করলেও রোগের প্রকোপ কমে যায়। রোগ দেখা দিলে থিউভিট ৮০ ঢ়ি অথবা কুমুলাস ডিএফ প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে  মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার জলে ব্যভিস্টিন ১ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment