‘এখনও সময় আছে। তুমি হয় আত্মসমর্পন করো, নয়তো ভোটের পরে অ্যাকশন আছে। তোমায় তুলে নিয়ে গিয়ে উধাও করে দেব। কেউ খুঁজে পাবে না।’
তাঁকে বাড়িতে না পেয়ে দরজায় বঁটি দিয়ে কোপও মেরে গিয়েছে তৃণমূল।
এই ঘটনা বনগাঁ ব্লকের বৈরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলগোড়িয়া গ্রামের। গ্রাম পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম) প্রার্থী খোদেজা বিবিকে ঠিক এই ভাষায় বাড়িতে ঢুকে হুমকি দিয়েছে তৃণমূল।
কিন্তু গ্রামের একজন মহিলাকে কেন এমন হুমকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল তৃণমূলের?
খোদেজা বিবির কথায়, ‘‘তৃণমূল বলেছে তোমার কত বড় খ্যামতা, তুমি হায়দারের মুখের কাছে দ্যেইড়েছো।’’
তাঁর অভিযোগ, যখন তৃণমূলের এই হামলা চলছে, তখন তিনি মাঠে। তাঁকে বাড়িতে না পাওয়ার আক্রোশে তাঁর দরজার সামনে আঁশ বটি নিয়ে কোপ মেরেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
এই প্রসঙ্গে হায়দারের সঙ্গে পরিচয় সেরে নেওয়া যাক। হায়দার আলি মোল্লা। বৈরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলী প্রধান তনুজা খাতুন মোল্লার স্বামী।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ১০০ দিনের কাজের দুর্নীতি থেকে শুরু করে সীমান্তে চোরাচালান, সব ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ হায়দারের। বৈরামপুর পঞ্চায়েত এলাকায় ২০০’র বেশি পুকুর জেসিবি মেশিন দিয়ে খুঁড়েছে হায়দার বাহিনী এবং সমস্ত মাটি চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। আমফানের ত্রাণের টাকাও লুঠ হয়েছ। এইভাবেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছে, অভিযোগ তেমনই। এলাকায় জনশ্রুতি, কয়েক কোটি টাকা মূল্যের প্রাসাদ তৈরি হয়েছে প্রধানের স্বামীর।
বনগাঁর মানুষের অভিযোগ, ভারত এবং বাংলাদেশ- উভয় দেশের পরিচিয়পত্র রয়েছে তাঁর। যশোর শহরে রয়েছে সারের কারখানা। দুই দেশের নির্বাচনেই ভাড়া খাটে তাঁর বাহিনী।
এই জাতীয় শক্তি স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধী শূন্য পরিসরে দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। ২০১৮ সালে ঠিক সেই কারণেই বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত গড়ার জন্য এত তৎপর ছিল তৃণমূল। তৎপর ছিলেন হায়দাররা।
কিন্তু এবারে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। বৈরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯টি আসনে রয়েছে সিপিআই(এম) প্রার্থী। খুনের হুমকি দিয়েও একটিও মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে পারেনি হায়দার বাহিনী। তাই মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরে খোদেজা বিবির বাড়িতে হামলা চালিয়ে গায়ের ঝাল মেটাতে হয়েছে।
কেবলমাত্র খোদেজা বিবি নন। গোটা বনগাঁ ব্লক জুড়েই প্রতিস্পর্ধা দেখাচ্ছে লাল ঝাণ্ডা। ব্লকে ২৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন বামপন্থীরা। মাত্র ৩টি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাহার হয়েছে। সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশের কাছে গ্রাম সভা আসনে লালঝাণ্ডার প্রার্থী রয়েছে এবারের পঞ্চায়েতে।
২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্লক অফিসে ঢুকে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র ছিঁড়ে ফেলেছিল তৃণমূল। সেবার আক্রান্ত দেবব্রত মজুমদার এবারেও গ্রাম সভায় দাঁড়িয়েছেন। জয়ের ব্যাপারে তুমুল আত্মবিশ্বাসী।
খোদেজা বিবির মতোই আরও এক একরোখা সিপিআই(এম) প্রার্থী হলেন বাবুল বরণ মজুমদার।
‘কুখ্যাত’ হায়দার আলি মোল্লার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন।
বাবুল বরণ মজুমদারের কথায়, ‘‘ মানুষ ভোট দিতে পারলে নিজের পরিবারের সব ভোটও পাবে না হায়দার। তাই সন্ত্রাস চালাচ্ছে। পরাজয়ের আতঙ্কে হায়দার ওর ১ নম্বর বুথকে ২ ভাগে ভেঙেছে। ও নিজে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ নম্বর আসনে। আর ওর ভাই কামাল,যে কিনা খুনের আসামী সে এলাকায় ‘মেশিন’ নিয়ে ঘুরছে আর হুমকি দিচ্ছে। আমাদের সমস্ত পোস্টার, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুলি দিয়ে আসছে। বলছে ভোট দিলে এই গুলি শরীরে ঢুকিয়ে দেব।’’
বাবুল বরণ মজুমদারের অভিযোগ, ২ নম্বর আসনের ভোটার তালিকায় ৩০’র বেশি মৃত ভোটারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্লক অফিসে জানিয়েও সেই নামগুলি বাদ দেওয়ানো যায়নি।
বনগাঁ ব্লকের অপর পঞ্চায়েত হল ট্যাংরা। একদম বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। সেই পঞ্চায়েতের ২৮৮ নম্বর বুথের সিপিআই(এম) প্রার্থী বিমল সরদার। ২০১৮ সালেও জিতেছিলেন। এই বুথে ৪৫ বছর ধরে, অর্থাৎ প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে বামপন্থীরা জিতে আসছেন।
বিমল সরদারের কথায়, ‘‘আমরা এবারেও এই বুথে জিতে রেকর্ড করব।’’
বনগাঁ অঞ্চলে ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচনের পরে বেড়েছে বিজেপি। ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ লোকসভায় জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনেও বনগাঁ মহকুমার ৪টি আসনেই জয়ী হয় বিজেপি। কিন্তু বর্তমানে ঠিক কোন অবস্থায় রয়েছে বিজেপি?
বনগাঁ ব্লকের সিপিআই(এম) নেতা নারায়ণ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘২০১৬’র পর থেকে বিজেপি ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ শুরু করে। তাতে একদিকে যেমন ছিল হিন্দুত্ববাদী প্রচার, তেমনই ছিল ‘আগে রাম পরে বাম’ স্লোগান। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। কোভিডের সময় রেড ভলান্টিয়ার্স, বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচন, শান্তিপুর বিধানসভা উপনির্বাচনে বামপন্থীদের ঘুরে দাঁড়ানো মানুষের বিজেপির প্রতি মোহভঙ্গ করতে সাহায্য করে।’’
সুমিত কর, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মতো জেলাস্তরের সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ জানাচ্ছেন, গত ২ বছর ধরে ধাপে ধাপে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে সিপিআই(এম) কর্মীদের ভিতরে। মানুষও তারফলে লালঝাণ্ডাকে ফের ভরসা করতে শুরু করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সেই কারণেই ফের ভিড় বাড়ছে লাল ঝাণ্ডার মিছিলে। অপরদিকে বহু মনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলি বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। তাই আশাভঙ্গের বিষয়টি তো রয়েছেই। তারফলে সাধের বনগাঁ ব্লকের সমস্ত আসনে প্রার্থীই দিয়ে উঠতে পারেনি বিজেপি। একইসঙ্গে তৃণমূলের মতো এই ব্লকে বিজেপিও গোঁজ কাঁটায় রক্তাক্ত।
এলাকার বামপন্থী কর্মীরা জানাচ্ছেন, কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও, নতুন কায়দায় ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ করার চেষ্টায় রয়েছে বিজেপি। বিজেপি এখন প্রচার চালাচ্ছে, ‘‘সিপিএম কিছু নিক, আমরা কিছু নেব।’’
যদিও সেই সুবিধাবাদী অবস্থান এক কথায় বর্জন করেছেন সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীরা।
ব্লকের সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের কথায়, ধর্মপুকুরিয়া-১, হাটবাওড়, গোপালনগর-২, আকাইপুর এবং চৌবেড়িয়া-২ পঞ্চায়েত জেতার ব্যাপারে আশাবাদী তাঁরা। একইসঙ্গে জোর লড়াই দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ছয়ঘড়িয়া, পাল্লা, ট্যাংড়া এবং সুন্দরপুর পঞ্চায়েতে।
Comments :0