Bethune School

আলোর সন্ধানে যাত্রা পথের ১৭৫ বছরে পা বেথুন স্কুল

রাজ্য

Bethune School


১৭৫ বছরে পদার্পণ করল বেথুন কলিজিয়েট স্কুল। বিদ্যলয়ের হলঘরে প্রতিবারের মতোই ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনেই রবিবার পালিত হলো বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বেথুন সাহেবের শ্বেত মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রাক্তন অধ্যাপক  শান্তিনাথ ঘোষ, প্রাক্তন শিক্ষিকা  ইন্দিরা ঘটক ও অন্যান্য শিক্ষিকারা। এদিন বেথুন বিদ্যালয়ের দু’টি সংস্কৃত গান ‘প্রণৌমি বেথুনং’ এবং ‘বিদ্যাসাগারং নৌমি’ এই দুটির রচয়িতা শান্তিনাথ ঘোষ। তাঁর উপস্থিতিতেই এই গানের সুরে গলা মেলান বর্তমান ছাত্রী, শিক্ষিকা সহ বহু প্রাক্তন ছাত্রী। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীরা। 
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যে অন্দরমহল বন্দি জীবনে পরাধীন বাংলায় প্রথম মুক্তি আলো এনে দিয়েছিল এই বেথুন কলেজিয়েট স্কুল। অন্ধকার অচলায়তন কাটিয়ে ঘরের আগল খুলে একে একে বেরিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ের একদল ছাত্রী। জন এলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে তাঁরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম ও বইখাতা। ব্রিটিশ শাসনকালে বিধ্বস্ত দেশে অতিরক্ষণশীলতার বেড়া টপকে মেয়েদের লেখাপড়া করতে এগিয়ে আসা, যা ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায় বলেই দাবি করা যায়। তাই এই বছর নারীশিক্ষার ১৭৫ বছর। 


১৮৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকারে সরকারের শিক্ষা পরিষদের সভাপতি হন বেথুন সাহেব। তিনিই এদেশে নারীশিক্ষার সমস্যাটি অনুধাবন করে  একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন এই উদ্যোগে তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখরা। ১৮৪৯ সালের ৭ মে বাহির শিমুলিয়ায় ৫৬ সুকিয়া স্ট্রিটে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানায় মাত্র এগারো জন বালিকা নিয়ে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন তাঁর বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যালয়ের নাম হয় ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসাবে পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালার নাম পাওয়া যায়। স্কুল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও স্কুলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। তিনি আঠারো বছর এই স্কুলের সম্পাদক ছিলেন।


এরপর বেথুন সাহেব স্কুলের জন্য একটি নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করতে প্রয়াসী হন ১৮৫০ সালের ৬ নভেম্বর সরকারের কাছ থেকে কেনা হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে দশ বিঘা জমিতে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তখনকার বাংলার ডেপুটি গভর্নর স্যার জন হানটার লিটলার।  
বিদ্যালয়ের মূল ভবনটির নির্মাণ সমাপ্ত হয় ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে  কিন্তু তার আগেই ১৮৫১ সালের ১২ অগাস্ট বেথুন সাহেবের অকাল প্রয়াণ ঘটে। বেথুনের মৃত্যুর পরে লোকমুখে এটি বেথুন সাহেবের স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্কুলের সম্পাদক হিসাবে ১৮৬২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সরকারকে যে রিপোর্ট পাঠান তাতে বেথুন স্কুল নামটি প্রথম উল্লেখ করেন। ১৮৬২- ৬৩ সালে বাংলার জনশিক্ষা রিপোর্টে ‘বেথুন স্কুল’ নামটি উল্লিখিত হয় সেই থেকেই স্কুলটি বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। 


দীর্ঘকাল ধরে বহু ছাত্রী উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং স্কুলের নামকে গৌরবমণ্ডিত করেছেন। এই বিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কাদম্বিনী বসু ( গাঙ্গুলি )। মহিলা হিসাবে তিনিই প্রথম এই গৌরবের অধিকারী হন এবং প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসাবেও কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। সাহিত্যিক শান্তা দেবী ও সীতা দেবী, কবি কামিনী রায়, জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দাশ, সরলা দেবী চৌধুরানি প্রমুখ বিখ্যাত নারীরা এই বিদ্যালয়ের  ছাত্রী ছিলেন। তটিনী গুপ্ত (দাস ) বেথুন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম (মতান্তরে দ্বিতীয় ) হন এবং দীর্ঘ সতেরো বছর বেথুন কলেজের অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে আমরা বিখ্যাত বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়কে পাই বেথুন স্কুলের প্রাক্তনীরূপে পাই প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে। দীর্ঘ ১৭৪ বছরের বেথুন স্কুলের সেই গৌরবময় পতাকাই বহন করে নিয়ে চলেছেন আজকের শিক্ষিকা ও ছাত্রীরা। 


এই দীর্ঘ ইতিহাস স্মরণ করতেই একবছর ব্যাপী উদ্‌যাপন করা হবে ‘ঐতিহ্যের ১৭৫’ শীর্ষক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে। যা নারীশিক্ষা ও চেতনা বিকাশের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। 
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই অনন্য ইতিহাসকে তুলে ধরতেই  যৌথ উদ্যোগে এক বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজন করছে বেথুন কলেজিয়েট স্কুল ও বেথুন স্কুল প্রাক্তনী সমিতি।
অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়েছে গত ২ মে মঙ্গলবার বর্ণাঢ্য পদযাত্রার মাধ্যমে। ওই দিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে এই পদযাত্রা এগিয়ে যায় স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির দিকে। বর্তমান ছাত্রীরা ছাড়াও, শিক্ষিকা, প্রাক্তনী, অভিভাবক সমিতির সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পা মেলান এই পদযাত্রায়। আগামী ১০ মে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়েমে মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওইদিন বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও প্রাক্তনীরা একত্রে বিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে তুলে ধরা হবে।

Comments :0

Login to leave a comment