Education Scam

‘অতীতে গাছেরা চলাফেরা করতে পারত’

ফিচার পাতা

দেবাশিস দত্ত
 

সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশ সাধনের কথা বলা থাকলেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সে ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য কোনও সরকারই বিশেষ  উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। যেহেতু শিক্ষা যুগ্ম তালিকায় রয়েছে আমাদের রাজ্যে ১৯৭৭ সালের পর  উচ্চ শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষার আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। কিন্তু সেই ধারা গত ১০ বছরে উলটো খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। 
এক্ষেত্রে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। একটি শিশুর সম্পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের পরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলির গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০১১ সালের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষার হাল কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে একবার ভেবে দেখা যাক। ২০১১ সালে নতুন রাজ্য সরকার প্রথমেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, যার ফলে জেলা প্রাথমিক সংসদগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। জেলা প্রাথমিক সংসদগুলি পরিচালিত হতো নির্বাচিত সাংসদ দ্বারা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংসদের নির্বাচন হতো। এককথায় সংসদ পরিচালনার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। নিয়োগ ও বদলির দায়িত্ব ডিপিএসসি সভাপতির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। অতীতে স্বীকৃত শিক্ষক সংগঠনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই চেয়ারম্যানগণ নিয়োগ ও বদলির বিষয়টি প্রণয়ন করতেন। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয়ভাবে হওয়ার ফলে বদলির ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক কেন্দ্র। এই অফিসগুলি পরিচালনা করেন বেশিরভাগ জায়গায় একজন বা কোনও জায়গায় কোনও কর্মী নেই। অস্থায়ী কর্মীরা এই অফিসগুলি পরিচালনা করেন। স্কুল ইন্সপেক্টর একজনের দায়িত্বে একাধিক চক্র থাকার জন্য ইন্সপেকশন হয় না বললেই চলে। 


অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের আর একটি স্তম্ভ— এই ধারণা নিয়ে তৈরি হয়েছিল মাতা শিক্ষক কমিটি, ভিলেজ এডুকেশন কমিটি ও শহরের ক্ষেত্রে ওয়ার্ড এডুকেশন কমিটি। বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত অভিভাবক সভা করতেই হতো। যার ফলে বিদ্যালয় পরিচালনা এবং গড়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বর্তমানে এই বিষয়গুলি ইতিহাস হয়ে গেছে। যার ফলে বিদ্যালয়গুলি যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। 
এবার আসা যাক আরেকটি স্তম্ভ শিক্ষক প্রসঙ্গে। অতীতে প্রাথমিক শিক্ষকরা গ্রামের মানুষের দানেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করতেন। অনেক সময় অভুক্ত থেকেই পাঠদান করতেন। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে অনিয়মিত মানি অর্ডার আসতো। প্রাপ্য ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ১-৪-১৯৮১ সালে শিক্ষকদের মর্যাদা দেয় বামফ্রন্ট সরকার, পে কমিশনের আওতায় এনে। বর্তমানে সময় শিক্ষকরা প্রশাসনিক ফতোয়া, আর্থিক বঞ্চনাতে নাজেহাল। তার ওপর বিদ্যালয় পিছু শিক্ষক অপ্রতুলতা। সাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা বহির্ভূত বিভিন্ন কাজ— যেমন চাইল্ড রেজিস্টার, প্রতিদিনের বিভিন্ন তথ্য যা শিক্ষককে পাঠদান থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করছে। গত দু’বছরে করোনা কাল শিশুদের যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে তাতে সেই সকল শিশুদের দু’বছরের ঘাটতি মেটানোর কোনও রূপরেখা সরকার রাখতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে ক্রমশ ড্রপ আউটের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এরপরে রয়েছে অবৈজ্ঞানিক সিলেবাস যেমন। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইতে (পৃষ্ঠা ৫৬ থেকে ৫৯) অতীতে গাছেরা চলাফেরা করতে পারতো। প্রথম শ্রেণিতে ‘আমার বই’ নামক যে বইটি আছে তাতে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয়গুলি একসাথে এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা কার্যত হ য ব র ল। 


এবার আসা যাক মিড  ডে  মিল প্রসঙ্গে। বর্তমান সরকার মিড ডে মিল চালু রাখার থেকে বন্ধ রাখবার দিকে আগ্রহ বেশি। দীর্ঘ দিন ধরে প্রথমিকে ছাত্র প্রতি বারাদ্দ ছিল ৪টাকা ৯৭পয়সা। এই বছরে হঠাৎ করে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের কারণে ৫টাকা ৪৫ পয়সা ও তার সাথে অতিরিক্ত ২০ টাকা প্রতি সপ্তাহে ছাত্র পিছু ধার্য করা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বস্তরে নীতিহীনতা ও অস্বচ্ছতা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান সময়ে প্রথমিক শিক্ষার এই বেহাল অবস্থা, যে কোনও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ভাবিত করে তোলে। পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। শিক্ষকদের প্রতি অশ্রদ্ধার মনোভাব পরিবেশের মধ্যেই বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রিয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে শুকিয়ে মারার চেষ্টা চলছে, রাজ্য সরকারের বদন্যতায়।
এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর প্রচুর পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। নিয়োগ নেই। শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। উদাহরণ স্বরূপ দশ বছর আগে একটা বিদ্যালয়ে হয়তো ২০০০ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য অনুমোদিত সহকারী শিক্ষক পদের সংখ্যা ছিল ৫০। দশ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা হয়েছে ৪০০০। ছাত্র সংখ্যার নিরিখে অনুমোদিত শিক্ষক পদের সংখ্যা ১০০ হওয়া উচিত। কিন্তু তা ৫০ই রয়ে গেছে আর শূন্য পদে নিয়মিত নিয়োগ না হওয়ার জন্য বাস্তবে (in position) হয়তো ৫০-এর বদলে ৪০ জন শিক্ষক আছেন। 
বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এসএসসি’র মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন। অনিয়ম দুর্নীতি বঞ্চনা বৈষম্যের কোনও অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির সরকার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের সেই অসাধারণ ব্যবস্থাটিকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। গত এগারো বছরে একবারও কমিশন স্বচ্ছতার সঙ্গে সন্তোষজনকভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারেনি। যে দু’তিনবার নিয়োগ হয়েছে তাতে অজস্র অভিযোগ উঠতে এবং আদালতে কমিশন তথা সরকারকে জেরবার হতে দেখা গেছে। এসএসসি-র চেয়ারম্যানের মর্যাদাপূর্ণ পদটি মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে। কে কবে ঐ পদে বসেন আর কবে পদত্যাগ করেন তার হিসাব রাখাই কঠিন। 


গত বছরের আগস্ট মাস থেকে উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের যে বদলি পদ্ধতি চালু হয়েছে তাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলো থেকে প্রচুর শিক্ষক বদলি নিয়ে চলে গেছেন শহর ও শহরতলির স্কুলে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলো অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমনিতেই গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলির শূন্যপদের সংখ্যা শহরাঞ্চলের স্কুলগুলির তুলনায় অনেকটা বেশি। নতুন বদলি-ব্যবস্থায় গ্রাম-শহরের বৈষম্য নিশ্চিতভাবেই আরও বাড়বে। 
এই মুহূর্তে গ্রামের দিকে এমন অনেক স্কুলের সন্ধান পাওয়া যাবে যেখানে যতগুলো সেকশন আছে তত জন শিক্ষক নেই। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়গুলো পড়ানোর শিক্ষক বাড়ন্ত। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী যতজন শিক্ষক থাকা দরকার বাস্তবে তার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক নিয়ে কোনোরকমে দায়সারাভাবে স্কুল চলছে। গ্রাম-বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা একদম ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে। গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসক থাকেন না, এখন গ্রামের স্কুলে শিক্ষক থাকবেন না। গ্রাম তবে ‘গেঁয়ো’ হয়েই থাক! সম্প্রতি এসএসসি’র মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির হদিশ মিলছে। রাজ্যের শাসকদলের নেতামন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকরা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যাচ্ছে। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। কোনও নিয়ম নীতি মানা হয়নি। পরীক্ষায় না বসে অথবা সাদা খাতা জমা দিয়ে অনেকেই চাকরি পেয়েছে। Empanelled অথবা Waiting list-এ নাম না থাকা সত্ত্বেও চাকরি হয়েছে। তালিকার ক্রমিক নম্বর ভেঙে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। 


এইসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অনেক যোগ্য ছেলেমেয়ে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁরা কলকাতার রাজপথে অবস্থান আন্দোলন করছেন। চরম অনিয়ম করে নিয়োগপত্র পাওয়ার কারণে আদালতের নির্দেশে কয়েকজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিক অস্থির, অরাজক ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কথায় আছে— শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কাজেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সুস্থিতি ফিরে না এলে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন না ঘটলে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডটা নিশ্চিতভাবেই দুর্বল হয়ে পড়বে। বাংলায় একটা উন্নত সমাজ গড়ার স্বার্থেই আমাদের সকলের শিক্ষার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। মানুষের সচেতনতা ছাড়া একটা অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment