Bijoy Sarkar

গানের বিজয়

ফিচার পাতা

অলক বিশ্বাস

বাংলার বাতাসে সুরেলা ধ্বনি। নদীর কুল কুল শব্দে গান হয়ে ওঠে। সংসার পরিজন এমনকি নিতান্ত আটপৌরে সাংসারিক কথাবার্তা, প্রেম-বিরহ-দ্বন্দ্বে শব্দের জন্ম দেয়। তা দিয়েই গান বাঁধেন কবিয়ালরা। বিজয় সরকার কবিয়াল। রাজ রাজাদের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত খিস্তি খেউড় থেকে মুক্ত করে চেতনার রঙে তাকে সামাজিক করেছেন। এককথায় বলা যায় এ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর ফলে গ্রাম্য সংস্কৃতির এই ধারা কেবল শ্রুতিমধুরই হয়নি, শুদ্ধ সমাজ তাকে গ্রহণ করেছে বলেই কালজয়ী হয়েছে। সারাদিন কাজের শেষে ক্লান্ত মানুষ মানসিক শান্তির জন্য আসরে ভিড় করে বুঁদ হয়ে শোনে কবিগান। এই গান যেন প্রকৃতপক্ষে হয়ে ওঠে নিজের এলাকার, নিজের পরিবারের কথা। বুকে হাত রাখলে হয়ে ওঠে একান্ত ব্যক্তিগত। যে গান গেয়ে অন্তজ বাঙালি নিজেকে হালকা করে।
পিছিয়ে পড়া বাংলার গ্রামে বিজয় সরকার অহঙ্কারের নাম। কবিতার মতো করে শব্দের বুননে তিনি গান রচনা করেছেন। উতোর চাপান কেন্দ্রিক লোক গানের এই ধারাটির নাম কবিগান, আর এই গানের গায়ককে বলা হয় কবিয়াল। কবিগান বাউলের একটি ধারা। যাকে দর্শন আশ্রয়ী সাধন সঙ্গীত বলা হয়। ইতিহাসে কবি গানের স্বর্ণযুগ ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মরমী গানের স্রষ্টা বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। র্অথাৎ কবি গানের স্বর্ণযুগের পঞ্চাশ বছর  পরে এই সাধকের জন্ম। 
নগর সংস্কৃতি যখন কবি গানকে গ্রাস করতে বসেছে তখন তিনি দেহাত্ম চেতনা ও অধ্যাত্মবাদের রস সিঞ্চনে কবিগানে প্রাণ এনেছেন। তাঁর নিরন্তর চেষ্টায় কবিগান হয়ে উঠেছে সমাজ সচেতন। ঘর, গেরস্থালির পারিবারিক কথপোকথন সুর ও শব্দ বুননে বাঁক নেওয়ায় হয়ে উঠেছে আধুনিক। তাই বর্তমানের অর্কেস্ট্রার যুগেও গ্রাম বাংলায়  বিজয়ের গানের আসর বসে। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে নিঝুম গাছতলায় কেউ গেয়ে ওঠেন ‘তুমি জানো নারে প্রিয়/ তুমি মোর জীবনের সাধনা’, কিংবা খালে-বিলে মাঝি-মল্লারদের উদাত্ত কণ্ঠে ভেসে আসে ‘পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী/ একদিন ভাবি নাই মনে।’ এমনই জনপ্রিয় গান। যে গানে মনের শান্তি। প্রাণের আরাম। 
একেবারে নিজস্ব ঢঙে বিচ্ছেদী গান রচনা করেছেন যা ‘বিজয়বিচ্ছেদ’ নামে পরিচিত। বিজয় সরকারের সৃষ্টির অভিনবত্বে এবং বিষয় ভাবনার নতুনত্বে তিনি আধুনিক। তাঁর কবিত্ব শক্তি, শাস্ত্রজ্ঞান, সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ দখল তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। বিজয় সরকার গানের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার সমালোচনা করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ে তথা নিম্নবর্ণের। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়ায় অনেক অবহেলা, ঘৃণা আর বঞ্চনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। সমাজে শ্রেণি বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি এক বালিকা বিধবাকে নিজের এক ভক্তের সাথে বিয়ে দেওয়ায় নিজের সম্প্রদায়ই তাঁকে ধিক্কার জানিয়েছিল। খোলা মনের মানুষ ছিলেন বলেই পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডায় তিনি সবসময় বলতেন, ‘সামাজিক অনাচার, জাতিভেদের বিরুদ্ধে আমি সাম্যের গান গাই।’
জাতি নিয়ে বিজয় সরকারের ভাবনা ছিল স্বতন্ত্র। জাতিভেদ বলতে তিনি কেবল দুই জাতিকে বুঝেছেন, নারী ও পুরুষ জাতি। সমকালীন সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না। মুসলিম সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গান রচনা করে তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বিজয় প্রকৃতই কৃষ্ণ প্রেমে পাগল এক কবি। তবে তাঁর এই প্রেম ভাবনায় নতুনত্ব আছে। বিজয়ের গান শুনে মনে হতে পারে তিনি বাঁশি বন্দনায় মেতেছেন। অর্থাৎ প্রেম ভাবনায় তিনি ছিলেন আধুনিক ছিলেন বলেই মানুষকে এখনো নবপ্রণে উজ্জীবিত করে। কবিগানের সম্রাট বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী কারো কাছে তিনি ‘চারণ কবি সম্রাট’, কারো কাছে ‘ভাটিয়ালী গানের রাজা’, আবার কারো কাছে ‘শ্রেষ্ঠ কবিয়াল’। তবে, গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘পাগল বিজয়’ বলেই বেশি পরিচিত। 
যে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, তিনি আমাদের লোকসঙ্গীতের উঠোনে উজ্জ্বল নক্ষত্র। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে একান্ত আপনজন। অন্ত্যজ মানুষের জয়গান গাওয়া এক অনন্য আধুনিক শিল্পী। স্বাধীনতার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে মেয়ের কাছে চলে এলেও শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে বিজয়কে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেছে। নড়াইলে বাসগ্রাম ইউনিয়নের ডুমদী গ্রামে ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কবিয়াল বিজয় সরকারের জন্ম। প্রায় চারশতাধিক গান রচনা করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতে সব মিলিয়ে আনুমানিক ৪০০০ আসরে কবিগান গেয়েছেন। 
যেভাবে বাংলাগান প্রতিনিয়ত বাঁক নিচ্ছে, এই বাঁকপ্রবাহ কোনদিকে যাবে কেউ জানে না। তবে এটা বলা যায় বিজয়ের গানগুলি কালের গণ্ডি ভেঙে এগিয়ে চলেছে। মানুষের ভিড়ের মধ্যেও নিজেকে একলা হয়ে বসার ইশারা দেয়। সরল শব্দে রয়েছে মাটির ঘ্রাণ, শিল্পের যুগলবন্দিতে ঋতুতে ঋতুতে উজ্জীবিত হয়। কোন কোন মঞ্চে তৎক্ষণাৎ রচিত গান গেয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের মন জয় করা ছিল তাঁর কাছে জলভাত।
ভারতীয় ভাষা পরিষদ তাঁকে ‘চারণকবি সম্রাট’ বলে অভিহিত করে। তারা তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল ও ভাটিয়ালী গানের রাজা বলেও সম্মানিত করে।

হিন্দুত্ববাদীদের কাছে যা ছিল অচ্ছুৎ মানুষের গান এবং দর্শন বিরোধী। ক্ষমতা দখলের স্বার্থে গরিব মানুষের সেই আবেগকে ব্যবহার করা হয়েছে এই বাংলায়। মহল্লায় মহল্লায়।
 

Comments :0

Login to leave a comment