পরিপূর্ণা মজুমদার ও অনুষ্টুপ চক্রবর্তী
অল্প কয়েকদিন আগেই, গত ৯ মে আইএমএফ’র এক জরুরি বৈঠকে পাকিস্তানের প্রস্তাব অনুসারে তাদের আর্থিক সহায়তার জন্য ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান মঞ্জুর হয়েছে। ভারত নাকি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু কোনও সদস্য দেশই পাকিস্তানকে এই বিপুল অনুদান মঞ্জুর করার বিরোধিতা করেনি। আইএমএফ’র সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রধানমন্ত্রী নিজের ব্যক্তিগত বন্ধু বলে দাবি করেন এবং নিজের নির্বাচনী প্রচারেও ব্যবহার করেন, তিনিও পাকিস্তানের পক্ষে থেকেছেন এবং বাকি সদস্যরা যাতে পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাবে সমর্থন করে, সেটা নিশ্চিত করেছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে ভারত স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে জোট নিরপেক্ষ নীতি বজায় রেখে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে মৈত্রীর ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল, সেই ভারত গত এক দশকে শুধুমাত্র আইএমএফ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেই নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে। যে ভারত এককালে জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে প্রবল মার্কিনী চাপ অগ্রাহ্য করেও বাংলাদেশ সহ গোটা দুনিয়ার উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই ভারত জোট নিরপেক্ষতার নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজের প্রতিবেশীদের কাছেও কোণঠাসা কেন? নেহরু আমলের বান্দুং সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে যে জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতির ভিত মজবুত করা হয়েছিল তা মোদীর আমলে এমন নিদারুণ বিপর্যস্ত কেন?
প্রথমত, গত এক দশকে মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন এবং কর্মসূচির থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সরিয়ে নিয়ে ক্রমাগত একের পর এক অবস্থান এবং কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে আমেরিকার শিবিরের কাছে আত্মসমর্পণ করে তার শরিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে তাতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতায় আঘাত লেগেছে। যে সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশ জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিল তারা ভারতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য বৈদেশিক শক্তিদের আরও কাছাকাছি ঘেঁষতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে। ভারতের মতো বড় দেশের দুর্বলতায় সার্বিকভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। আমেরিকার একমেরুর বিশ্বের বিরুদ্ধে বহুমেরুর বিশ্বের প্রণেতা হিসাবে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের মধ্যেই নিজেদের বিশ্বস্ত সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে আক্রান্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশ। QUAD -এর মতো আমেরিকার নেতৃত্বে থাকা সামরিক জোটের অংশীদার হওয়া ও প্যালেস্তাইনে লাগাতার গণহত্যা চালানো ইজরায়েলের সাথে সখ্যতা বৃদ্ধি করা এই সমস্ত দেশের কাছে ভারতের বিদেশনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা ও ধারাবাহিকতাকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যদিও একথা সত্যি যে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রশ্নে বা প্যালেস্তাইনে গণহত্যার প্রশ্নে ভারত সরাসরি আমেরিকার বক্তব্যের অবিকল উচ্চারণ করেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও ভারত যে আমেরিকার সাথে তালে তাল মিলিয়ে শুধুমাত্র মুখরক্ষার মতো করে জোট নিরপেক্ষতা বা তৃতীয় বিশ্বের সাথে মৈত্রী রক্ষার কথা বলছে এমন একটা ধারণা ভারত সম্পর্কে এই মুহুর্তে বিশ্ব আঙিনায় জোরালো হয়েছে, বিশেষ করে এশিয়াতে। আমেরিকা ও ইজরায়েলকে বন্ধু হিসাবে পেতে গিয়ে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বহু বন্ধুকে ভারত হারিয়ে ফেলছে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে মোদীর নেতৃত্বে আরএসএস নির্দেশিত পথে এবং কর্পোরেট পুঁজির তোষামোদ করার জন্য যে উগ্র দক্ষিণপন্থী কেন্দ্রীয় সরকার চলছে, বৈদেশিক নীতিতে তারই প্রতিফলন ঘটছে আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক কর্পোরেট পুঁজির সুবিধা করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপে। শুধু তাই নয়, ভারতের উচ্চ প্রশিক্ষিত পেশাদারি দক্ষতা সম্পন্ন কূটনীতিবিদদের কাজেও কি হস্তক্ষেপ হচ্ছে নাগপুর থেকে? এই মুহুর্তে ভারতের বিদেশনীতির স্বঘোষিত মুখপাত্র হয়ে উঠছে বিজেপি’র বিষাক্ত রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করতে নামা কিছু ব্যক্তিবর্গ যারা শাসকদলের হয়ে ফেক নিউজ প্রচার করে, সোশাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমে বসে অনবরত মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ায়। গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ভারতের বায়ুসেনা পাকিস্তানের মাটিতে অনেকগুলি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চালায়। এরপর পাকিস্তানের তরফে একাধিকবার ভারতের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করে আক্রমণ করার চেষ্টা হওয়ায় দেশের সার্বিক বাতাবরণ, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সেনাবাহিনীর তরফে পরিমিত জবাবী কার্যকলাপ চালানো হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যে পাকিস্তানের সাথে এই ধরনের সামরিক দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতেও, যা সহজেই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারতো, দেশ ও দেশের বিদেশনীতির প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা না থাকা রাজনৈতিক ‘মুখপাত্ররা’ এমন বক্তব্য প্রচার করেছেন যা আদতে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে সার্বিকভাবে ভারত সরকার ও সেনাবাহিনী পরিকল্পিত জাতীয় স্বার্থবাহী প্রচারের বিপরীত বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা করেছে। যেখানে ভারত সরকারের বিদেশ সচিব ও সেনাবাহিনী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ লাগাতার বলার চেষ্টা করেছে যে ভারত সরকার কোনোভাবেই যুদ্ধ চায় না, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, ভারতের নীতি এবং পদক্ষেপ একমাত্র পাকিস্তানের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে, সেই অবস্থায় দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ইসলামাবাদ, করাচি ইত্যাদি দখলের আকাশ কুসুম গল্প প্রচার গোটা পৃথিবীর কাছে ভারত সম্বন্ধে এক হাস্যকর বিশ্বাসহীনতা ও বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। জরুরি পরিস্থিতির মধ্যেও বিদেশ সচিব এবং তাঁর পরিবারকে ট্রোলিং ও বুলিং, সামরিক অভিযানে বীরত্ব ও বিবৃতিদানে পারদর্শিতা দেখানো মহিলা অফিসারকে তাঁর ধর্ম চিহ্নিত করে অবমাননা করা, এগুলি শুধু দেশের ভিতরেই অন্তর্ঘাত নয়, দুনিয়ার মাঝে ভারতের অনৈক্যকে কর্কশভাবে প্রকাশ করা। বিদেশ সচিব এবং সেনা অফিসাররা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ভিত্তিক পরিমিত ক্রমবর্ধমান সামরিক অভিযানের কথা। উলটোদিকে যুদ্ধোন্মাদ স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকরা প্রচার করেছেন, পাকিস্তান দখলের কথা। স্বাভাবিক যুদ্ধবিরোধিতাই যখন বিশ্ব জনমত, তখন যুদ্ধোন্মাদনা জাগানো প্রচার ভারতকে বিশ্বের দরবারে আরও কোণঠাসা করেছে।
এমনকি ইরানের এক আধিকারিক সম্পর্কে গৌরব আর্য নামের এক স্বঘোষিত মুখপাত্রের অশ্লীল বক্তব্যের ফলে ভারত সরকারকে ইরানের কাছে সরকারি স্তরে ক্ষমাও চাইতে হয়েছে। ভারত সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে, দৃঢ়তার অভাবের কারণে সংঘর্ষবিরতির সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীল আচরণের কথাও দুনিয়ার সামনে সরকারিভাবে ভারত নিজের থেকে আগে প্রকাশ করতে পারেনি, সমস্ত এক্তিয়ার লঙ্ঘন করে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের "সংঘর্ষবিরতি"র ঘোষণা করেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। রীতিমত ব্যঙ্গ করে ট্রাম্প বলেছেন যে বাণিজ্য থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেই ভারত এবং পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে গেছে যা ভারতের আন্তর্জাতিক মর্যাদায় জোরালো ধাক্কা দিয়েছে। আজ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসে ভারতের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করে কোনও বহিঃশক্তি ঠিক করে দেয়নি ভারতের সাথে অন্য কোনও দেশের দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে। মোদীর আমলে ভারত এতটাই আমেরিকার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে যে ভারতের কথা ভারত নয়, আমেরিকা ঘোষণা করছে। বুক ফুলিয়ে বলছে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের কী করা উচিত। বেশ পরিষ্কারভাবেই একটি জিনিস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে দেশের বিদেশনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তুলনায় এই গোটা সংঘাতের আবহে গোটা বিশ্ব জুড়ে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানের হয়ে সমর্থন জোটানো ও সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটির উপর কড়া পদক্ষেপ নেওয়া ভারতের বায়ুসেনার কার্যকলাপকে "ন্যক্কারজনক" আখ্যা দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর "ব্যক্তিগত বন্ধু" ও "নির্বাচনী সহায়ক" আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ও বিজেপি’র হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষ ছড়ানো স্বঘোষিত কূটনৈতিক মুখপাত্রদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। "ঘুস কে মারেঙ্গে" ছবি যা মোদী প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে দাবি করেন তা যে আদতে আমেরিকার কাছে বন্ধক দেওয়া মিথ্যাচারের এক ফানুস, তা আজ পরিষ্কার। ‘বিশ্বগুরু’ বলে প্রচার আসলে মূল্যহীন বিশ্বের দরবারে।
তৃতীয়ত, দুনিয়ার দরবারে একাকীত্বের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে ভারতের একাকী হয়ে পড়া, যা অতীতে কখনো এমন অবস্থায় ছিল না। পাড়ায় প্রতিবেশী বাসিন্দাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক নিজের বাড়িকে যতটা সুরক্ষিত করে পুলিশ পাহারা দিয়েও ততোটা হয় না। তেমনভাবেই জাতীয় সুরক্ষার জন্য সামরিক শক্তির চেয়েও বেশি জরুরি প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাথমিক পাঠ জানা ছাত্র-ছাত্রীরাও এটা জানেন। ভারত সরকারের বিপুল টাকা খরচ করে অল ইন্ডিয়া রেডিও বরাবর বহু বিদেশি ভাষায় বৈদেশিক সম্প্রচার করে থাকে যাতে প্রতিবেশী দেশগুলির জনগণ সেই সব সম্প্রচার শুনে ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয় (বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারত সরকার ‘মৈত্রী’ নামেই একটি রেডিও চ্যানেল চালিয়ে থাকে)। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে তীব্র বিদ্বেষমূলক মনোভাব প্রতিবেশী দেশের মানুষের সম্বন্ধে বিজেপি নির্বাচনী ফায়দার জন্য প্রচার করে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের মানুষের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক বিরূপ মনোভাব তৈরি করছে। যেহেতু ঐ সব দেশের জনমানসে এক ভারত-বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশের সরকারগুলোর তরফেও অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়ার এক প্রবণতা কাজ করে। প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে কেবল পাকিস্তানের সঙ্গেই ভারতের ঐতিহাসিকভাবে টানাপোড়েন থাকলেও অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলির সাথে যে সুসম্পর্ক ভারতের বরাবর ছিল তা এখন আর নেই। ইদানীংকালে নেপালের সাথেও কালাপানি ও লিপুলেখে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে যা একপ্রকার অভূতপূর্ব। দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বেড়েছে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ সহ সবার সাথেই। মালদ্বীপের সঙ্গে সমস্যা মেটানোর বদলে ভারত থেকে আরএসএস কর্মীরা মালদ্বীপে ভারতীয়দের পর্যটন বন্ধ করে দিয়ে শুকিয়ে মারার হুমকি দিয়েছে। হুমকি দিয়ে মিত্রতা আদায় সম্ভব হয়? ভুবনেশ্বরের কেআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেপাল থেকে আগত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জাতিবিদ্বেষী ঘটনা ভারতের চরিত্রকে উদারের পরিবর্তে উগ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছে প্রতিবেশী দেশগুলির কাছে। কার্যত জোর করে প্রতিবেশী দেশগুলিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে দূরে। তারাও সমান্তরাল সখ্যতা বাড়াচ্ছে চীনের সাথে বাণিজ্য ও পরিকাঠামো আদানপ্রদানের মাধ্যমে। জোট নিরপেক্ষতা বর্জন করে চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত সমস্যা মেটানোর না চেষ্টা করে আমেরিকার আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করা ভারত অযথা সন্দেহভাজন হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির কাছে। ১৯৮৫ সালে তৈরি হওয়া সার্ক’এর সবচেয়ে বড় সদস্য ভারত নিজেই সার্ক’কে ঠুঁটো করে দিচ্ছে। সার্ক’-এর গুরুত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নিশ্চিতভাবে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারতো। কিন্তু এখন ভারতের বিদেশনীতিতে সার্ক গুরুত্বহীন। এই পথে এগিয়ে আমেরিকার থেকে ভারত কোনোদিনই সেই সাহায্য পাবে না, যা পাকিস্তানি সেনার মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলাকে নিশ্চিত করতে পারে। এর মধ্যেই খবর এসেছে, তুরস্ককে ৩০৪ মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করবে ট্রাম্পের আমেরিকা। অথচ পাকিস্তানকে মদত দেওয়ার অভিযোগে এই তুরস্কের সঙ্গে বিবাদ তুঙ্গে তুলছে ভারত। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক তো বটেই এমনকি সাংস্কৃতিক ও উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত আদানপ্রদানও বন্ধ করে দিচ্ছে ভারত। সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া দেশকে ভারত কোণঠাসা করবে? মোদীর সঙ্গে এমনই বন্ধুত্ব ট্রাম্পের, যে আমেরিকা দরাজ হয়ে মদত দিতে নেমেছে সেই দেশকেই।
অতএব একথা আজকে স্পষ্ট যে মোদী আমলের অসংলগ্ন, অস্পষ্ট বিদেশনীতি একপ্রকার আরএসএস নির্দেশিত বিজেপি’র উগ্র দক্ষিণপন্থী ও আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়ক যে রাজনৈতিক অভিমুখ, সেই অভিমুখে ঠেলতে গিয়ে ভারতকে নিজের চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতির ধারাবাহিকতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি, যারা একসময় ভারতকে ভরসার চোখে দেখতো, তারা আর বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারছে না। নিঃশর্ত বন্ধু হিসাবে মনে করছে না পশ্চিমের প্রথম বিশ্বের দেশগুলিও। আধুনিকতার এই যুগে যেখানে সেনাবাহিনী নয় আন্তর্জাতিক দরবারে কূটনীতিই আসল অস্ত্র, সেখানে ভারতের কূটনীতির একূল ওকূল দু’কূলই ধসে যাচ্ছে। বিদেশনীতি দিশাহীন। চীন, রাশিয়া সহ যে সমস্ত দেশ নিজ স্বার্থেই আমেরিকার একমেরু সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর বিপরীতে বহুমেরুর পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর করে তৃতীয় বিশ্বের সাথে মৈত্রীর ভিত্তিতে জোট নিরপেক্ষ নীতিতে না ফিরলে ভারতের এই মুহুর্তে আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রভাব দূর অস্ত, বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়াই কঠিন হতে পারে।
Forreign Policy
সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইতে মিত্রতা জরুরি বিশ্বের আঙিনায়

×
Comments :0