Namkhana local

ফেরিওয়ালার প্র্যাকটিক্যাল খাতা

ফিচার পাতা

চিরন্তন নাইঞা

ভিক্ষুক বেড়ে গেছে। 
রাত সাড়ে ৯টার ডাউন নামখানা লোকালে বাড়ি ফেরতা ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের অভিজ্ঞতা,‘‘অনেকে নতুন আসছেন ভিক্ষা করতে।’’
এই ট্রেন মূলত বাড়ি ফেরার ট্রেন। শহরে প্রতিদিন লড়তে লড়তে বেঁচে থাকতে আসা দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রাম-মফঃস্বলের মানুষরাই এই ট্রেনের সওয়ারি হন। 
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনটি প্রতিদিন রাত সাড়ে ন’টায় তিরিশ শিয়ালদহ সাউথ সেকশন থেকে ছেড়ে নামখানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রত্যহ এই ট্রেনটিতে বহু নিত্য যাত্রী যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য উঠা নামা করে। অধিকাংশই গ্রামবাসী। শহরে আসেন নানা কাজে। তাঁদের আলাপচারিতায়, কখনও ঝগড়ায় উঠে আসে আজকের বাংলা।


শিয়ালদহ থেকে ছাড়ার পর বালিগঞ্জ স্টেশন থামে। কারণ— এটি গ্যালপিং। এরপর যাদবপুর। সোনারপুর আসতে আসতে ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। কেউ বসার সিট পান। আবার কেউ পান না। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝগড়াও বাঁধে। আবার ট্রেনের মধ্যে সেটা মিটেও যায়। ট্রেনটি বারুইপুর স্টেশন আসার পর আবার যথারীতি অন্য সব লোকাল ট্রেনের মতো প্রতিটি স্টেশনে থেমে থেমে যায়। এটি নামখানা লোকাল হলেও, জয়নগর আসতেই প্রায় খালি হয়ে যায় বলাই বাহুল্য। এরপর লক্ষ্মীকান্তপুর আসার পর ট্রেনের প্রতিটি কামরায় যাত্রী সংখ্যা মাত্র দুই থেকে তিনজন থাকে।
কেমন কথা শোনা যায় কামরায়?               
আসগার আলি খানের বাড়ি নামখানার অবস্থিত দ্বারিকনগর গ্রামে। বয়স ৩৫ বছর। পেশায় সোফা টেলর মিস্ত্রী। কর্মসূত্রে তিনি হায়দরাবাদে থাকেন। হঠাৎ বাবার মৃত্যু সংবাদের খবর পেয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ খেলা চলছিল। ট্রেনে উঠে গল্পে গল্পে প্রথমেই তিনি আলোচনা শুরু করেন ভারত কেন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এই প্রসঙ্গে তিনি রাজনীতির কথাও তুলে ধরলেন। বললেন বর্তমানে যে দুই সরকার মসনদে বসে আছেন তাদের কাজকর্ম অত্যন্ত নিম্নমানের। আমরা দেখেছি যখন বাম সরকার ছিল, তাদের জামানায় কত ভালো কাজকর্ম হয়েছে। হয়েছে বিভিন্ন জেলায় জেলায় স্টেডিয়াম, গড়ে উঠেছিল নিত্য নতুন অসংখ্য মাঠ। বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলো কার্যকরী রূপ দিতে পারছে খুব কম। বর্তমান যুব সমাজ নিজের রাজ্যে কাজ পাচ্ছে না বলে যেতে হচ্ছে ভিন্ন রাজ্যে, আলাদা দেশে। তাঁর জলজ্যান্ত উদাহারণ আমি নিজে। 


এক বাদাম বিক্রেতা আছেন, যিনি এই ট্রেনেই বাড়ি ফেরেন। বাদাম বিক্রিও করেন ফেরার পথে। তাঁর মেয়ে সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। বললেন,‘‘মেয়েটাকে প্র্যাকটিকাল খাতা কিনে দেব বলে ১০ দিন ধরে ঘোরাচ্ছি। বলতে পারছি না যে, আমার হাতে একদম পয়সা নেই। আগে আমরা এই ট্রেনে হাতে গোনা কয়েকজন হকার থাকতাম। এখন সেটা অনেক বেড়ে গেছে। বেচা কেনাও কমে গেছে।’’
অরূপ অধিকারী। এই ছেলেটির বয়স মাত্র ২০ বছর। আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ বুঝে কম বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। পেশায় ঘুগনি বিক্রেতা অরূপ। তিনি বললেন, ‘‘ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। মাঝে মধ্যে ঘুগনি বাড়িতেও ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে। কোনও কোনও সময় মনে হয় পরের দিন থেকে ব্যবসায় আর আসবো না।’’ বললেন,‘‘ট্রেনে আগের থেকে অনেক প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বেড়েছে। ট্রেন বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।’’


ছেলেটি খেলা দেখতে অত্যন্ত পছন্দ করেন। বললেন,‘‘তামাম বিশ্ব তো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার শৈল্পিক ফুটবল দেখবে বলে টিভির পর্দার সামনে আসে। সেমিফাইনালে লাতিন আমেরিকার দুই দেশ পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হলে আমি বেশি খুশি হতাম। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল দল টাইব্রেকারে ছিটকে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশও করেছেন অরূপ।’’
প্রোজ্জ্বল নস্কর পেশায় ফুচকা বিক্রেতা। বয়স ২৮। ট্রেন যখন গোচরণ স্টেশন পৌঁছেছে এক লেবু বিক্রেতার কাছ থেকে দরকষাকষি করে লেবু কিনছিলেন তিনি। তারপর ট্রেনের কামরাতে দু’জনের আলোচনা শুরু হয়ে গেল। দু’জনেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। মোদ্দা কথা— গ্রামে সরকার থেকে যে সমস্ত অনুদানগুলো আসছে সেগুলো সব তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাদের এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, বলছে পার্টির উপর মহলের নির্দেশ আছে সক্রিয়ভাবে যাঁরা পার্টির কাজে নিয়োজিত তাঁদের আগে দিতে হবে। এইভাবেই দলের অনেক কোটিপতিও বাড়ির টাকা, অন্য সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment