ভোট এসেছে। গরমও। ডায়মন্ডহারবার-২নং ব্লকের নুরপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সালাউদ্দিন মোল্লার প্রধান দুশ্চিন্তা পানীয় জল। তাঁর পঞ্চায়েতে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছায়নি। পানীয় জল তো দূরের কথা, পানীয় জল পৌঁছানোর পাইপও আসেনি নুরপুরে। অথচ কয়েকদিনের মধ্যেই তাপমাত্রা ৪২ডিগ্রি ছাড়াবে। লাগোয়া নদীর জলস্তর নামছে। ভরসা কী? সালাউদ্দিন মোল্লা সোমবার বললেন,‘‘অনেকদিন আগে লাগানো টিউবওয়েল আছে। সেগুলিই ভরসা। আমার পঞ্চায়েত এলাকায় ধরুন প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস। তার মধ্যে ৩০ হাজার ভোটার। তবে জলের স্তর নামলে টিউবওয়েলেও সমস্যা হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর লোকসভা কেন্দ্রেরই এই হাল। অভিষেক সারা রাজ্যে কর্মীদের জ্ঞান দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের যৌথ দায়িত্বের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের এই ব্যর্থতার কথাও মুখেও আনছেন না।
শুধু নুরপুর নয়, ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের ব্লকগুলির বেশিরভাগ পঞ্চায়েতের এই দুর্দশা। সালাউদ্দিন মোল্লার কাছে একটি তথ্য পাওয়া গেল। তিনি জানালেন,‘‘১৯৯৮-এ অনেকগুলি পঞ্চায়েতে রাজ্য সরকারের পিএইচই দপ্তর রিজার্ভার বানিয়েছিল। সেখান থেকে পানীয় জল চালু হয়েছিল।’’ তখন তো বামফ্রন্ট সরকার? সালাউদ্দিন বললেন,‘‘হ্যাঁ, তাই তো। হয়েছিল সেই সময়।’’
তৃণমূল-শাসনে পানীয় জলের বন্দোবস্তে কোনও ‘সাফল্য’র কথা এই তৃণমূল নেতা বলতে পারলেন না। শুধু বললেন,‘‘একটু লিখে দেবেন যে, আমাদের নেতা অভিষেক ব্যানার্জি, শামিম ভাই খুব চেষ্টা করছেন।’’ ‘শামিম ভাই’ স্থানীয় তৃণমূল নেতা।
তাঁদের সেই ‘চেষ্টা’র হাল ছড়িয়ে আছে রাজ্য জুড়ে। সর্বত্র পানীয় জলের হাহাকার। অনেক সম্পন্ন গ্রামীণ পরিবারই জল কিনে খায়। তবু পানীয় জলের মাহাত্ম্য নিয়ে ছড়া ছেপেছে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের প্রচার পুস্তিকায় পানীয় জল সংক্রান্ত ছড়া আছে। সেই ছড়ায় বলা —‘জল সকলের, জল জীবনের। নদী-কন্দরে, গৃহে-অন্দরে, ঘাটে-বন্দরে, জল অমৃত।’ ছড়ার লেখিকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু আর সেই ‘অমৃত’ বড় দুর্দশায় আছে।
কোথাও পাইপ পৌঁছেছে। কিন্তু জল আসছে না। বেশিরভাগ জায়গায় পাইপও পৌঁছায়নি। রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার মাত্র ৪৬.৬৮% পরিবারে পানীয় জলের নল পৌঁছেছে। রাজ্য সরকারের তাই দাবি। কেন্দ্রীয় সরকার সেই ‘দাবি’ মেনেও নিয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে যে পরিবারে পানীয় জলের নল পৌঁছেছে বলে সরকারের দাবি, সেই সব পরিবারে সেই নল বেয়ে জল পৌঁছানো শুরু হয়নি।
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে, ২০১৯-এ এই প্রকল্পের শুরু কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে। নরেন্দ্র মোদী সরকার নাম দেয় ‘জল জীবন মিশন’। রাজ্যে সেই প্রকল্পের নামকরণ হয়েছে মমতা ব্যানার্জির মাধ্যমে — ‘জলস্বপ্ন’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০২০-র জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জল জীবন মিশন নামের প্রকল্পটির নামকরণ করেন ‘জলস্বপ্ন।’ তারপরেই ছিল বিধানসভা নির্বাচন। মূলত বিজেপি’র বিরুদ্ধে তিনিই লড়ছেন, তা বোঝাতেই জলের প্রকল্পের নাম নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখাচ্ছিল দু’পক্ষ— তৃণমূল এবং বিজেপি। কিন্তু তাতে জল সমস্যা লাঘব হয়নি।
প্রমাণ আলিপুরদুয়ার। ২০১৯-এ আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। সেই কেন্দ্রের একটি পঞ্চায়েত মথুরা। প্রধান তৃণমূলের। নাম ফুলচাঁদ ওঁরাও। সোমবার স্বীকার করলেন, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতের ১০টি পার্টের ৮টিতেই বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছায়নি। দুটি পার্টের কিছু অংশে পৌঁছেছে। ১১০০০ মানুষের ভরসা ৪-টির মতো টিউবওয়েল। চা বাগানের জল কিছু মেলে। তবে তা অল্প। এই গরম বাড়ছে। অবস্থা আরও খারাপ হবে। কী যে করব?’’
মোদী ঘোষিত প্রকল্পের পাঁচ বছর পর দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ৪৭%-র কম পরিবারে পানীয় জলের নল পৌঁছেছে। রাজ্যে ১কোটি ৭৫লক্ষের বেশি পরিবারে পানীয় জল পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার মিলে ঠিক করেছিল। জলের নল পৌঁছেছে ৮১লক্ষ ৭২ হাজারের কিছু বেশি পরিবারে। পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিঙ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমে ৩৭%-র কম পরিবারে পানীয় জলের নল পৌঁছেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের ৪৭%-র কম পরিবারে পৌঁছেছে পানীয় জল। সরকারের হিসাবেই এমন অনেক ব্লক আছে যেখানে কোনও বাড়িতে পানীয় জলের পাইপও পৌঁছায়নি। যেমন বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি, পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়।
PIPED WATER BENGAL
মোদী-মমতার যৌথ দায়িত্বে রাজ্যের ৫৩% বাড়িতে জলের নলই পৌঁছায়নি
×
Comments :0