NOVEMBER REVOLUTION

হেরে যাওয়া শব্দই নেই

সম্পাদকীয় বিভাগ

কী ব্যাপার বলতো, চারদিকে নতুন নতুন লাল পতাকা দেখছি ? পাড়ার যে পার্টি অফিসটা দেখলাম লাল টুনি দিয়ে সাজানো, কী যেন বিপ্লব না কি একটা লেখা আছে! মাহির আকাশকে প্রশ্ন করলো। 

আকাশ: নভেম্বর বিপ্লবের জন্য হতে পারে। 
মাহির: আরে ছাড় ! ওসব বিপ্লব বইয়ের পাতার জন্য ঠিক আছে , বাস্তবে এসব হয় না, আসল কথাটাই হলো রাজনীতি জিনিসটাই খারাপ! যে লঙ্কায় যায় সেই রাবণ হয়। লকডাউন এর পর থেকেই আব্বুর কাজটাই নেই! থার্ড সেমিস্টারের ভর্তির টাকা যোগাড় করতে পারছি না , মা বলে ‘আর পড়ে লাভ নেই, চাকরি তোর হবে না, ঐ তো রোজ টিভি- তেখবর দেখি ঘুষ দিয়ে চাকরি হয়। আমাদের টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাই হবে না! এখন থেকেই কোনো কাজ করলে তাও লাভ আছে তাই না বসে থেকে কাজে লেগে পড়’’।

 আকাশ: এই অবস্থা শুধু তোর নয় ভাই, এটা গোটা পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় একই অবস্থা! মানুষের হাতে কাজ নেই, পেটে ক্ষুধা আছে তাও ভাত নেই, মানুষের হাতে পয়সা নেই।

মাহির: তাই তো বলছি এসব রাজনীতি, শুধু মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য!

 আকাশ: আরও একটা কথা তুই কি জানিস? এই সময় আম্বানি আদানি বা ওদের মতোই বড় বড় পুঁজিপতিরা সবচয়ে বেশি মুনাফা করেছে। তোর চাহিদাকেই এরা হাতিয়ার করে যাতে তুই এদের কথা মত চলতে বাধ্য থাকিস, এই ধর কোভিডের সময়, স্যানিটাইজার আর মাস্ক বিক্রি হলো সবচেয় বেশি। তোর সামনে উপায় ও ছিল না, অনলাইন ক্লাস হলো কোনোও একটা বিশেষ কোম্পানির অ্যাপ এর মাধ্যমে! তোর সামনের উপায়ও ছিল না, তুই ও তো টাকা ধার নিয়ে ডাটা প্যাক ভরলি ,তাই না? 

মাহির: উপায় তো ছিল না ভাই, কলেজ বন্ধ কি করতাম তখন?

 আকাশ: এটাকেই ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম বলে, ওরা এক ভাগ মানুষ ঠিক করে দেবে তুই কেমন করে বাঁচবি, তুই কোথায় পড়বি, কোথায় কাজ করবি, কি খাবি! ওরা কেউ মন্ত্রী নয়, রাজা নয়, ওরা মন্ত্রী আর রাজাদের পুষে রাখে ওদের কাজ করার জন্য। ওদের পুঁজিপতি বলে। আর ওদের, ওরা কেউ খাবে আর কেউ খাবে না এই নিয়কেই ক্যাপিটালিজম বলে ।

 মাহির: আরে কি বলছিস ?প্রধানমন্ত্রী , মুখ্যমন্ত্রীকেও এরা পুষে রাখে? তাহলে এদের ভোট দিয়ে লাভ কি? এরাই বা আছে কেন? এই পার্লামেন্ট, বিধানসভা বা আছে কেন? সত্যি কি পুঁজি এদের নিয়ন্ত্রণ করে? তাহলে আমরা পুঁজি কে দেখতে পাই না কেন? 
আকাশ: তুই কী বাতাস দেখতে পাস? তাও তার অস্তিত্ব অনুভব করিস না? পুঁজি তেমন আছে, তুই যাতে দেখতে না পাস তার জন্য এদের জামা কাপড় হলো এই লোকসভা, বিধানসভা! তোর খুব রাগ যদি হয় তাহলেও তুই যাতে পুঁজির বিরুদ্ধে না বলে সরকারের বিরুদ্ধে বলিস তাই এই ব্যবস্থা তৈরি করা বুঝলি? 
মাহির: বুঝলাম তো, কিন্তু উপায় কি তাহলে?

 আকাশ: ‘বিপ্লব’ ।

মাহির: এটা কি সত্যি সম্ভব?

আকাশ: এটাই হয়ে ছিল একটা দেশে , একজন বিপ্লবীর নেতৃত্বে। লেনিন ! এই দেশের সংবিধানে শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। সরকারি উদ্যোগে সারা দেশজুড়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য সরকারি বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে জোর দেওয়া হয় প্রযুক্তি ও কারিগরিবিদ্যার উন্নতির দিকে ।কর্মরতদের পড়াশোনার জন্য গড়ে ওঠে রাত্রিকালীন স্কুলের বন্দোবস্ত। তার পাশাপাশি কমসমল ও ইয়ং পাইওনিয়ারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যবস্থা করা হয়।শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নবীনদের আরও বেশি করে শিক্ষাঙ্গনে টেনে আনে। কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রগতি চলতে থাকে তাল মিলিয়ে। সরকারি উদ্যোগে অজস্র কলকারখানা তৈরি হলে তা কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ এনে দেয়। নিশ্চিত করা হয় শ্রমের ন্যূনতম মজুরি। ১৯২৮ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েতের অর্থনীতির সুদৃঢ়করণের রুটম্যাপ। এরপর প্রযুক্তির অগ্রগতি, ইঞ্জিনিয়ারিং হাব, বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েতে সাক্ষরতার হার বেড়ে হয় ৭৫%। সার্বজনীন শিক্ষার মডেল প্রশংসিত হয় বিশ্বজুড়ে।প্রযুক্তি বিজ্ঞান,মহাকাশ বিজ্ঞান নিত্য নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানে অগ্রণী দেশ হয়ে ওঠে সোভিয়েত। আর একটা মজার কথা বলবো?

মহির: বল শুনি, আমার কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। 
আকাশ: ১৯১৭-র অক্টোবরে সোভিয়েতে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ছিল ৩,২৪,০০০,১৯৩০। এর পর সেদেশে বেকারত্বের কোনো তথ্য পাওয়া যায়না কারণ_ তখন আর সোভিয়েত কেউ কর্মহীনতায় জর্জরিত ছিল না। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় সোভিয়েত ভ্রমণকালে লেখক প্রতিটি স্টেশনে একটি ঘোষণা শুনতে পান। পরে দোভাষীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তা ছিল উদ্বৃত্ত চাকরির জন্য আবেদনকারীদের সন্ধান। রবি ঠাকুর নিজে গিয়ে ছিলেন সেখানে, সেখানের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন সেগুলো পরে একসঙ্গে করে রাশিয়ার চিঠি নামে একটা বইও বের হয়। উনি লিখেছিলেন ‘‘রাশিয়ায় না এলে আমার এ'জন্মের তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ থাকত’’।

মাহির: রাশিয়ার রেভোলিউশন নিয়ে ইন্ডিয়ার কী হবে?

আকাশ: আরে রাশিয়াতে বিপ্লবটা হয়েছিল। শুধু রাশিয়ার জন্য হয়নি। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের জন্য হয়েছিল। ওই বিপ্লব প্রথম দেখিয়েছিল আরেক ধরনের পৃথিবীও সম্ভব। যেখানে মানুষের কোনো অভাব থাকবে না। সবাই সবার জন্য বাঁচবে। সবাই আনন্দে থাকবে। এই যন্ত্রসভ্যতার যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাম পুঁজিবাদ। অসাম্যের ব্যবস্থার নামই পুঁজিবাদ। অল্প কিছু মানুষ ব্যবসা আর বিক্রি করতে করতে বড়লোক হতে থাকবে। আর বেশিরভাগ মানুষ অভাবে দিন কাটাবে। স্বাস্থ্য আর খাবারের সুরক্ষাটুকুও পাবে না। ভারতে এখন মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ২২১। বিশ্বের দ্বিতীয় বড়লোক গৌতম আদানি ভারতের লোক। কিন্তু গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারত ১০৭ নম্বরে। আমাদের দেশে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ আছে।

মাহির: তা তোর এই সমাজতন্ত্রের জন্য কী করতে হবে?

আকাশ: করতে তো অনেক কিছুই হবে। মার্কস-এঙ্গেলস মিলে লিখেছিলেন 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। ওরা এই বই লেখার মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে ফ্রান্সের প্যারিসেই মানুষ প্রথম চেষ্টা করে সমাজতন্ত্র আনার। কিন্তু টেকেনি বেশিদিন। মাত্র ৭২ দিন টিকেছিল। ওই ক'দিন ওই মুক্ত অঞ্চলের নাম ছিল 'প্যারি কমিউন'। 
মাহির: তাহলে? টেকেনি যখন, আজগুবি হয়ে গেল না কথাগুলো?

আকাশ: একদম না। এখানেই তো নভেম্বর বিপ্লবের গুরুত্ব। যারা মার্কসবাদ মেনে সমাজ বদল করতে চাইল তারা এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিল। প্রতিদিনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করা দরকার, সে'সব অনেক বিতর্ক-বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে খুঁজতে শুরু করল। এর মধ্যে রাশিয়াতে প্যারি কমিউন থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে মার্কসবাদকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রয়োগ করে রাশিয়ায় জারকে উৎখাত করলো প্রথমে, তারপর ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেতৃত্ব দিল। এভাবেই নভেম্বর বিপ্লব হল। একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হল। সাধারণ মানুষের কো-অপারেটিভ, ওরা সেটাকে সোভিয়েত বলতো, সেটাই হয়ে উঠলো শাসন কাঠামো। শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-খেলা সমস্ত ক্ষেত্রে পৃথিবীতে তখন সেরার সেরা সোভিয়েত রাশিয়া। প্রথম কারা মহাকাশযান পাঠিয়েছিল? কারা লাইকাকে মহাকাশে পাঠিয়েছিল? মহাকাশে প্রথম মানুষ মনে আছে? ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা? ভাব, একজন মহিলা ঘরের চার দেওয়াল ভেঙে সোজা একেবারে মহাকাশের প্রথম মানুষ! স্বপ্ন মনে হচ্ছে না? প্রথম মহিলাদের ভোটাধিকার দিয়েছিল এই সোভিয়েত রাশিয়া। এই বিপ্লবের পর পৃথিবীর ১০৪ টি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। লাতিন আমেরিকা , আফ্রিকা, এশিয়া সহ বিভিন্ন পরাধীন দেশগুলিতে মুক্তিকামী মানুষের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লড়াই আরোও তীব্র হয়। এক কথায় গরিব মানুষ যাদের কথা কেউ কোন দিন বলে নি তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। ভগৎ সিংও ঐ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন। বাংলাতে এর প্রভাব ছিল বিরাট।

মাহির: এটা যদি এত ভালো হয় ভেঙে পড়ল কেন? 
আকাশ: দেখ এখনও পাঁচটা সমাজতান্ত্রিক দেশ টিকে আছে,যারা সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করে চলেছে। কয়েক দিন আগে ব্রাজিলে দেখলি না বামপন্থী সরকার গঠন হলো তাছাড়া ভাব, প্রথম প্রচেষ্টা টিকে ছিল ৭৮ দিন। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা টিকল ৭৪ বছর। আবার যদি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে নতুন করে চেষ্টা করা যায়?

মাহির: হ্যাঁ। মন্দ বলিসনি। 

আকাশ: পৃথিবীতে বাড়তে থাকা বৈষম্য বাস্তব তো? মানুষের উপর মানুষের শোষণ বাস্তব তো? দুনিয়াজুড়ে মানুষের অসম্ভব অভাব বাস্তব তো? মানুষের জন্য এর থেকে মুক্তির উপায় তো থাকবেই। উন্নততর সমাজ তো থাকতেই হবে। এবার হলে হয়তো মডেলটা আলাদা হবে। সেই উন্নততর সমাজও যে সম্ভব সেটার প্রেরণা তো দেয় নভেম্বর বিপ্লব!

মাহির: এখন কেন এরকম হয় না? এখন কেন বেকা রা চাকরি পায় না? এখন কেন আমার পড়াশোনা ছাড়তে হবে? 

আকাশ: এটা শুধু তোর একার সমস্যা নয়। এই কোভিডের সময় সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ছাত্ররা ! এই সময় যখন শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশি টাকা খরচ করার কথা তখন সরকার ৬% বাজেট কমিয়েছে। জিডিপির ৬%হওয়ার কথা, সেখানে এখন ৩.১%। গোটা দেশে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ১ জন। এই রাজ্যের অবস্থাটাও দেখ! গত ১১ বছরে রাজ্যে বন্ধ হয়েছে ৭০০০ এর বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যালয়গুলি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কত টাকা দিতে হচ্ছেশাসক দলের ইউনিয়নের দাদাদের? স্বচ্ছ নিয়োগের অভাবে একটা প্রজন্মের কাছে ব্রাত্য হয়ে উঠছে শিক্ষা, সবচেয়ে ভয়ানক - এখন পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে একটা প্রজন্ম। শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বুকে রোজ তোর মা আব্বু দেখছে প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রীর বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হচ্ছে। গোটা শিক্ষা দপ্তরটার ঠিকানা এখন জেল। 
মাহির: উপায় কি তাহলে? এইরকম কি চলতে থাকবে? 
আকাশ: উপায় ‘‘বামপন্থা’‘। এই রাজনীতি পারবে তোর, আমার, আমাদের আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে। 
মাহির: ধুর এরা তো এখন শূন্য! এরা কি পারবে? এরা তো হেরে গেছে।

আকাশ: তুই কি বাদল শেখের নাম শুনেছিস? এক বছর আগে এই নভেম্বর বিপ্লবের ঝান্ডা তোলার জন্য খুন হয়েছিল, আর আজ দেখ এরাই সব জায়গায় এই ঝান্ডা তুলেছে, তাই এদের অভিধানে হেরে যাওয়া শব্দটাই নেই ! তবে লড়ে যাওয়া আছে।

Comments :0

Login to leave a comment