রণদীপ মিত্র
‘কি এমন করেছে কেষ্ট যে ওকে অ্যারেস্ট করতে হবে ?’ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বেহালায় দাঁড়িয়ে একথা বলেছিলেন খোদ মমতা ব্যানার্জী। তারপর কেটে গিয়েছে ছ-ছ’টি মাস। দেখে নেওয়া যাক সত্যিই কি করেছে কেষ্টা ? কারন এই মমতাই চলতি মাসে বীরভূমে দাঁড়িয়েই বলে দিয়েছেন, ‘‘আগের সিস্টেমেই সব চলবে।’’
চালকল:: গোরু পাচারের টাকা লন্ডারিংয়েই জেলার চালকল ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল অনুব্রত মণ্ডল। জেলার চালকল ব্যবসা গিলে নেয় মণ্ডল পরিবার ও তার শাগরেদরা। কোনওটি নামে তো কোনওটি বেনামে। সবার প্রথমেই এসেছে ‘ভোলেবোম’ রাইস মিলের নাম। যা কেনা হয়েছিল ২০১১ সালে। ধান মিলের ব্যবসায় বীরভূমের জনক বলে পরিচিত জনৈক হারাধন মণ্ডলের কাছ থেকে এই রাইস মিলটি কেনা হয়েছিল। তখন নাম ছিল শ্রীগুরু রাইস মিল। অনুব্রত কেনার পর নাম পালটানোই শুধু নয়, গা ঘেঁষে থাকা মহেশ্বরী রাইস মিলটিও কিনে নেন অনুব্রত। মাঝের পাঁচিল ভেঙে দুই রাইস মিলকে এক করে নেন। আছে শিবশম্ভু রাইস মিলও। যার বর্তমান লিজ প্রাপকরা হলেন অনুব্রতর দিদি-জামাইবাবু। বুঝত অসুবিধা হয় না, আখেরে এর নিয়ন্ত্রকও কে? এছাড়াও আহমেদপুরের ৭টি রাইস মিলের সাথে যোগ মিলেছে অনুব্রতর লেনদেনের। রাজীব ভট্টাচার্যই হচ্ছে সেখানে অনুব্রতর ঢাল। সামান্য মিল শ্রমিক রাজীব ভট্টাচার্য হয়ে উঠেছে এখন চালকল মালিক, তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি। সকলেই জানেন, কাগুজে মালিক কে আর মুনাফার বড় অংশ যায় কোথায়?
গোরু হাট:: গোরু পাচারের কিংপিন এনামুলের বাংলাদেশে গোরু পাচারের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল ইলামবাজারের সুখবাজার হাট। সুখবাজার তো ছিল, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মেরেকেটে তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা এই হাটকেও গোরু পাচারের নির্ভরযোগ্য গন্তব্য করা হয়েছিল। গোটা কারবার নিরপদ্রুব রাখতে আদায় করা হত মোটা টাকা, যাকে চলতি কথায় বলে ‘প্যাড’। ‘প্যাডে’র টাকা বিলির দরজার খোঁজ করতে নেমেই তো সিবিআই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের করে ফেলেছে। প্যাডের টাকার একটা বড় অংশই তো পৌঁছতো অনুব্রতর দরজায়। সেই দরজায় পাহাড়া দিত সায়গল। সিবিআই তদন্তের অগ্রগতিতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তা। ইতিমধ্যই আদালতেও সিবিআই জানিয়েছে, রীতিমত সশরীরে হাজির থেকে প্রত্যক্ষ ভাবেই গোরু পাচারের কারবারে যুক্ত ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল।
জমি:: অপেক্ষা ছিল স্রেফ নজরে পড়ার। চোখে ধরলেই যেকোনও উপায়ে সেই জমি চলে এসেছে অনুব্রত, তার পরিবার কিংবা ঘনিষ্টদের দখলে। অনুব্রতর পরিবারের এভাবেই ৫৩টি সম্পত্তি বিস্তারের কাহিনি সিবিআই লিপিবদ্ধ করে দিয়েছে তাদের রিপোর্টে। অনুব্রতর দেহরক্ষী সায়গল হোসেনও কম যান না। তারও প্রায় ৪৪ টি সম্পত্তি সিবিআই-র র্যা ডারে চলে এসেছিল আগেই। আদিবাসী জমি থেকে পাথর খাদান, শহরের বুকে লোভনীয় জমি থেকে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের জমি পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে অনুব্রত মণ্ডলের বৃত্ত। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো সম্পত্তির বিস্তার হয়েছে মাত্র কয়েক বছরে। এরমধ্যে বিপুল পরিমাণ কেনাবেচা হয়েছে লকডাউন পর্বে।
লটারি:: গোরু পাচার মামলার তদন্তে ‘লটারি’ যোগও এক এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। গত বছরের গোড়ার দিকে ‘ডিয়ার’ নামে এক লটারি সংস্থার ওয়েবসাইটে অনুব্রতর ১ কোটি টাকার লটারির পাওয়ার বিজ্ঞাপন ফলাও করে বেরিয়েছিল ছবি সহ। এগারো মাস পরে সেই পর্বই চলে আসে গোরু পাচারের মামলায়। সিবিআই হানা দেয় বোলপুরের এক লটারি এজেন্সিতে। সেই এজেন্সির নামেই ছিল এক কোটির লটারির টিকিটকি। সাব এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মেলে এক কোটি টাকার লটারির বিজেতাকে। লটারির প্রকৃত বিজেতা শিমূলিয়া গ্রামের নুর আলির বাবা কটাই শেখ বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি দেন,‘‘লটারিতে এক কোটি টাকা পাওয়ার পরেই তৃণমূলের লোকজন বাড়ি যায়। হুমকি দেয়। টিকিট জোর করে কেড়ে নিয়ে চলে আসে। আপত্তি করেছিলাম তারজন্য ঘরছাড়াও হতে হয়েছিল। ওদের সাথে কি পারা যায়। পার্টির (তৃণমূল) লোক।’’ ফলে গোরু পাচারের কালো টাকা সাদা করার আরও এক মাধ্যম ছিল লটারি। অনুব্রত মণ্ডল গত বছরের প্রথম ডিয়ার লটারিতে ১কোটি টাকা জিতেছিলেন তা নয় তার আগেও মোট তিনবার তাঁর ও মেয়ে লটারিতে বাম্পার পুরস্কার জিতেছিলেন! ২০১৯ সালে অনুব্রত মণ্ডলের একটি অ্যাকাউন্টে লটারির পুরস্কার মূল্য হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। তার আগে অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের অ্যাকাউন্টে দু’দফায় ৫১লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। এরপর ২০২০ সালে ঢোকে আরও ৫০ লক্ষ টাকা আর অনুব্রত মণ্ডলের নিজে ‘জিতেছল’ একবার ১কোটি আরেকবার ১০ লক্ষ। অর্থাৎ শুধু অনুব্রত মণ্ডলের পরিবারে ২কোটি ১১লক্ষ টাকা বেমালুম ঢুকে গিয়েছিল!
ভুয়ো অ্যাকাউন্ট:: স্রেফ একটি সমবায় ব্যাঙ্কেই ৩৩০টি বেনামি, ভুয়ো অ্যাকাউন্ট! যার সঙ্গে যোগ মিলেছে গোরু পাচারকাণ্ডে জেলবন্দি অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, এখনও তৃণমূলের জেলা নেতা, সিউড়ি ২নং ব্লকের সভাপতি। সেই ব্যাঙ্কেই ৩০০’র বেশি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে মানি লন্ডারিং করা হয়েছে।গ্রামের হতদদরিদ্র মানুষগুলোর পরিচয় পত্র হাতিয়ে খোলা হয়েছিল এই অ্যাকাউন্টগুলি। ইতিমধ্যেই সিবিআই নথি আদালতে পেশ করে প্রমান দিয়েছে, সরকারি প্রকল্পের টাকাই লেনদেন হয়েছে এই সকল অ্যাকাউন্ট থেকে। তার সাথে ঘুরে ফিরে যোগ মিলেছে সেই অনুব্রতর। পরিকল্পনা করেই অ্যাকাউন্টগুলি খুলে তার মাধ্যমে গোরু পাচারের কালো টাকাকে চালকলের পথ ধরেই সাদা করেছেন অনুব্রত মণ্ডল। কারন অ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে হওয়া লেনদেনের বড় অংশই হয়ে সরকারি ধান বিক্রির টাকা!
Comments :0