লোকসভা ভোট, রামমন্দির উদ্বোধনের আগে মুসলিম বিরোধী জিগির তুলতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল আসল ঘটনা। বিদ্বেষ ছড়াতে গিয়ে উলটে ফাঁস হয়ে গেলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ছক। মুসলিম নামের আড়ালে ই-মেলে হুমকি বার্তা দিচ্ছিল দুই হিন্দু যুবক, তা হাতেনাতে ধরে ফেলেছে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। আইএসআই’র সক্রিয় সদস্য জুবেইর খানের ছদ্মনামে রামমন্দির উড়িয়ে দেওয়া, আদিত্যনাথকে হত্যার বার্তা এসেছিল এসটিএফ’র সদর দপ্তরে। এরপরেই তদন্তে নেমে গত বুধবার লক্ষ্ণৌ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দুই যুবককে। মুসলিম দূর অস্ত, তারা শুধু হিন্দুই নয়, বিজেপি’র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজনের নাম তাহর সিং এবং অপরজন ওমপ্রকাশ মিশ্র। আর এদের মাথা হিসাবে যিনি গোটা বিষয়টি পরিচালনা করেছেন, সেই দেবেন্দ্র তিওয়ারি নিজে আরও বড় তালেবর। আদিত্যনাথ থেকে বিজেপি’র বড় মাপের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ছবি অহরহ জ্বলজ্বল করে সমাজ মাধ্যমে। ভারতীয় কিষান মঞ্চ এবং ভারতীয় গৌ সেবা পরিষদ নামের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দুই স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার কর্ণধার তিনি। তবে অভিযোগ দায়ের হলেও তিনি বেপাত্তা।
জম্মু-কাশ্মীরের সর্বশেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক অবশ্য অনেক আগেই এমন ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। বিজেপি’র সঙ্গে একসময় দীর্ঘদিন ‘ঘর’ করা মালিক পুলওয়ামার মতো লোকসভা ভোটের আগে রামমন্দির ধ্বংসের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বা হুমকি ছড়িয়ে উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তোলা হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। উত্তর প্রদেশের গোণ্ডাবাসী ওই দুই যুবকের গ্রেপ্তার বা পলাতক দেবেন্দ্র যাদবের কাণ্ডকারখানা দেখে সেই আশঙ্কাই বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে ধারণা। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ উত্তর প্রদেশের এসটিএফ সদর দপ্তরকে একটি তথ্য সরবরাহ করে রাজ্য পুলিশের ডিজি’র সদর দপ্তর। বলা হয়, ‘দেবেন্দ্র তিওয়ারির এক্স হ্যান্ডেলে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে খুন এবং রামমন্দির উড়িয়ে দেওয়ার হুমকির কথা পোস্ট করা আছে’। সেই এক্স হ্যান্ডেলেই বলা হয় যে, পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সক্রিয় সদস্য জনৈক জুবেইর খান এই হুমকি দিয়েছে। আরেকটি ভুয়ো ই-মেল আইডি-ও ব্যবহার করা হয় আনসারি খানের নামে। এরপর পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের নির্দেশে ডিএসপি প্রমেশ কুমার শুক্লার নেতৃত্বে তদন্ত নামে এসটিএফ। তদন্তে নেমে দেখা যায়, দুটি এফআইআর দায়ের করা আছে লক্ষ্ণৌয়ের আলমবাগ এবং সুশান্ত গলফ সিটি থানায়। দেখা যায়, আনাসারি খান এবং জুবেইর খানের ই-মেল আইডি থেকে হুমকি বার্তা এসেছে, সেকথা উল্লেখ করা আছে এফআইআর-এ। সেই ই-মেল আইডি’র প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন করতেই ফাঁস হয়ে যায় রহস্য। দেখা যায়, ই-মেল আইডি তৈরি করেছে তাহর সিং এবং হুমকি-বার্তা পাঠাতো ওমপ্রকাশ মিশ্র। এরা দু’জনে গ্রেপ্তারের পর জেরায় দেবেন্দ্র তিওয়ারির নাম জানিয়ে দেয়। ওরাই জানায়, দেবেন্দ্রর নির্দেশেই তারা ই-মেল আইডি তৈরি করে ভুয়ো হুমকি বার্তা পাঠাতো। এই দেবেন্দ্রের বিরুদ্ধে আবার আশিয়ানা, বানথারা, গৌতমপল্লি এবং আলমবাগ থানায় বহু অভিযোগ রয়েছে।
দেবেন্দ্র তিওয়ারির আলমবাগে একটি প্যারামেডিক্যাল কলেজ আছে। সেই কলেজেই সোসাল মিডিয়া হ্যান্ডলার হিসাবে কাজ করতো তাহর সিং। আর দেবেন্দ্রর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করতো ওমপ্রকাশ সিং। আবার ওমপ্রকাশ ওই কলেজ থেকে দু’বছরের অপ্টোমেট্রি-তে ডিপ্লোমাও করেছে। এসটিএফ জানাচ্ছে, দেবেন্দ্রর নির্দেশে তাহর ভুয়ো ই-মেল আইডি তৈরি করে পাসওয়ার্ড সহ তা পাঠিয়ে দিতো ওমপ্রকাশের হোয়াটসঅ্যাপে। ওই নম্বর দুটি পাঠিয়ে দেওয়া হতো লক্ষ্ণৌয়ের আমন মোবাইল সেন্টারে। হুমকি মেল দু’বার পাঠানো হয়, প্রথম গত বছর ১৯ নভেম্বর এবং দ্বিতীয়টি ২৭ ডিসেম্বর। হুমকি-বার্তা গোটা বিষয়টি বানিয়ে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো দেবেন্দ্র তিওয়ারির কাছে। এরপর দেবেন্দ্র তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করতেন সেই বার্তা। মেল পাওয়ার পরেই দুটি মোবাইল ফোন পুড়িয়ে দেন। দপ্তরে থাকা ওয়াইফাই রাউটার দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে মেল পাঠানো হতো। ধৃতরা জেরায় বলেছে, দেবেন্দ্র তিওয়ারি বলেছিলেন যে এই কাজ করলে সমাজ মাধ্যমে তাদের নাম ছড়িয়ে যাবে এবং রাজনৈতিক ফায়দাও হবে অনেক।
দেবেন্দ্র এবং তাঁর শাগরেদরা উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার চালাতো জোরকদমে। বিজেপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ছবির পাশাপাশি গো-রক্ষা, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো উগ্র হিন্দুত্বের কর্মসূচিতে লিপ্ত ছিল। এর ফলে তাদের রাজনৈতিক মুনাফাও হয়েছিল। দেবেন্দ্র পুলিশি নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। কারণ দেবেন্দ্র মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন দাবি করে পুলিশি নিরাপত্তা আদায় করে নিয়েছিলেন। দেবেন্দ্র এও ভেবেছিল যে, এরপর রাজনীতিতে তাঁর দর আরও বেড়ে যাবে। দেবেন্দ্র বা তাঁর দুই সহচরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর কথা এসটিএফ জানালেও গোটা ঘটনার পিছনে আরও বড় রাজনৈতিক চক্রান্ত আছে বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। এই হুমকির ছক বড় ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ বলেই মনে করা হচ্ছে। যার লভ্যাংশ মিলতো লোকসভা ভোটে।
দেবেন্দ্র, তাহর কিংবা ওমপ্রকাশ খোলাখুলিভাবে বিজেপি’র হয়ে প্রচার চালাতো। একটি পোস্টে দেখা যাচ্ছে, তাহরকে এক মহিলা এসে ভালোবাসার প্রস্তাব দিলে সে উলটে তাকে বলছে, ‘আমি ভালোবাসি বিজেপি-কে’। এছাড়া বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা ছিল নিয়মিত। দেবেন্দ্র আবার ২০২২ সালে বিজেপি উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে। উত্তর প্রদেশ সরকারের হালাল শংসাপত্র সংবলিত পণ্য বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা, গো-রক্ষার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানো অফিসারদের বিরুদ্ধে যোগী সরকারের কঠোর মনোভাবের পক্ষে সওয়াল, মোদী সরকারে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অবস্থানকে সমর্থন, দেশেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণার দাবি জানানো পোস্ট দেখা যায় তাঁর ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডেল বা ইনস্টাগ্রামে। এমনকি মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, রামমন্দির উদ্বোধনের সময় অযোধ্যায় মুসলিমদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, লক্ষ্ণৌয়ের মসজিদগুলি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করতেও দেখা গিয়েছে দেবেন্দ্রকে। দুই শাগরেদ ধরা পড়লেও দেবেন্দ্র তিওয়ারি এখন পলাতক। পুলিশের চোখ এড়িয়ে তাঁর বেপাত্তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
এদিকে, কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাথে এদিন এক্স হ্যান্ডলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চক্রান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠলেই যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার পৌঁছে যায় তাদের বাড়িতে। আর এখানে হিন্দুদের নাম সামনে চলে আসায় সেই বুলডোজারের ডিজেলই শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
Bomb Threat
নাম ভাঁড়িয়ে ভুয়ো হুমকি, ধরা পড়লো ৩ হিন্দুত্ববাদী
×
Comments :0