ভাবছিলাম লেখাটার শিরোনাম এমনটা হতে পারে কিনা— ‘রাজপথের রাজার ভারতদর্শন’ কিংবা ‘রোড-মুডির রাজার কলকাতা ভ্রমণ’! কিন্তু গত ১৬-১৯ ফেব্রুয়ারি, উইম ওয়েন্ডার্সের কলকাতা বাসের চারদিনে নন্দন-বসুশ্রী-বিড়লা সভাঘর মিলিয়ে তাঁর দু’টি প্রশ্নোত্তর পর্ব ও একটি মাস্টার ক্লাসেও কিছুটা উঁকিঝুঁকি মারার অভিজ্ঞতায় একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। জার্মান সিনেমার কিংবদন্তীর এই ভারত-সফরের ব্র্যান্ডিং, পোস্টার, ব্যানার-এর ক্যাচলাইনে যাই থাকুক, তাঁকে ‘কিং অফ দ্য রোড’ বলে যতই আদিখ্যেতা হোক, রাজা সাজতে তিনি আসেননি। অথবা রাজা সাজা তাঁর পক্ষে সম্ভবই নয়। কারণ রাজা দরবারেরই হোন অথবা সিনেমাঘরের, প্রজারা আড়ালে নিন্দেমন্দ করছে কিনা জানার জন্যে তিনি বড়জোর হারুন-অল-রশিদের মতো রাতদুপুরে আমআদমির ঘরের দোরে কান পাততে পারেন! কিন্তু নিজের রাজপাট-সাম্রাজ্য নিয়ে মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি মন খুলে কথা তো বলতে পারেন না। কিন্তু উইম ওয়েন্ডার্স পারেন। একজন চলচ্চিত্রকারের নিজের ভুবন, তাঁর রাজ্যপাট তো তাঁর সিনেমা। এই শহরে অন্তত তিনদফায় তাঁর সেই সৃজন-সাম্রাজ্য নিয়ে অনুভবী-বোধহীন, বুদ্ধিদীপ্ত-দ্বিধাগ্রস্ত, ঝকমকে-ঝাপসা, সপ্রতিভ-আড়ষ্ঠ, তীক্ষ্ণ-বিহ্বল কত রকম প্রশ্নের অন্তরাল থেকে প্রশ্নকারীর মনটা ঠিক পড়ে নিতে পারছিলেন তিনি। কোনও ‘পথের রাজা’ নন, পথের কবিই পারেন অতটা উদার হতে। সিনেমা আগ্রহী প্রতিটা মানুষকে সমান গুরুত্ব দিতে।
উইম ওয়েন্ডার্সের এই কলকাতা সফরনামাকে তাই উলটো দিক কলকাতার ওয়েন্ডার্স-সফরও বলা যায়। এই শহর এর আগে উইম ওয়েন্ডার্সের ছবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে দেখেছে। কখনো চলচ্চিত্র উৎসবে, কখনো ফিল্ম সোসাইটিগুলোর শো-এ। তাই প্রথম দিন ‘প্যারিস, টেক্সাস’ দেখানোর আগে মঞ্চ থেকে উইম ওয়েন্ডার্স যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘এই ছবিটা এখানে আগে ক’জন দেখেছেন’ তখন নন্দন প্রেক্ষাগৃহের নিচ-ওপর মিলিয়ে বেশ কিছু হাত উঠেছিল। যেটা দেখে ছবির স্রষ্টাকে দৃশ্যতই একটু অবাক লাগছিল। এর আগেও এই শহরের সিনেমাচর্চার ঐতিহ্য, ইতিহাস, পাগলামো দেশি-বিদেশি অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাকেই বিস্মিত, উত্তেজিত করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্বয়ং উইম ওয়েন্ডার্সের সঙ্গে একই প্রেক্ষাগৃহে বসে আরো একবার ‘প্যারিস, টেক্সাস’ দেখে ফেলা এবং ছবি দেখার পরে ঘড়িতে শেষ মেট্রোটাও চলে যাওয়ার সময়কে তোয়াক্কা না করে পরিচালকের সঙ্গে প্রশ্নত্তোর পর্বে তুমুল মেতে যাওয়া—কলকাতার কাছেও এই অভিজ্ঞতা নতুন। তাছাড়া ৪দিনে উইম ওয়েন্ডার্সের ১৮টা সিনেমার একটা বিশেষ প্যাকেজ। তাতে ১৯৭০-২০২৩ সাল অবধি নির্মিত তথ্যচিত্র স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা, কাহিনীচিত্র, সবই আছে, ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় তুলে ব্লো-আপ করা। অ্যালিস ইন দ্য সিটি’র সবটাই ছিল থ্রি-ডি ফর্মাটের তথ্যচিত্র ‘অ্যানসেল্ম’। একজন ৮০ ছুঁইছুঁই সিনেমাকারের পথ চলার শুরু, বাঁক ফেরা, মোড় বদল, আবার কোথাও ফিরে আসা— বারবার নিজেকে ভাঙা, নতুন প্রযুক্তিকে পরখ করে দেখা— পথের কবির এই পুরো সময়টারই একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা ছিল গোটা প্যাকেজটায়। তাই আগেও যেটা বলছিলাম এটা শুধু উইমের প্রথমবার ভারত তথা কলকাতা সফর নয়— কলকাতার দর্শকের কাছেও মস্ত সুযোগ ছিল তাঁর সৃষ্টি ভুবনের গলি থেকে রাজপথে ঘুরে বেড়ানোয় তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার বা খুঁজে পাওয়ার।
মানুষটাকে আক্ষরিকভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর জার্মান প্রজন্মের প্রতিনিধি বলা যায়। তাঁর জন্ম ১৯৪৫সালের ১৪ আগস্ট— জাপানে শেষ পরমাণু বোমাটা পড়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। তারও আগে লালফৌজ বার্লিন দখল করেছে। পিছু পিছু পৌঁছেছে আমেরিকান সেনাও। সেই ভাঙনকাল পেরিয়ে নতুন জার্মানি গড়ে ওঠার উত্তাল অস্থির সময়েই উইম ওয়েন্ডার্সের বড় হওয়া। ১৯৬০-এর দশকে নিজের জীবন বা কেরিয়ার যাপনেও সেই অস্থিরতার ছাপছোপ ছিল। ডাক্তারির পড়া ছেড়ে প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন শিল্পকলা শিখতে। কিন্তু আর্ট কলেজের বিদ্যায়তনিক লেখাপড়ায় মন বসেনি। পাঠক্রম শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন। এটা সেটা অনেক মোকাম ঘুরে শেষ অবধি থিঙ্ক হন ফিল্ম স্কুলে তবে ছবি আঁকার রল তুলি আর স্টিল ক্যামেরায় ফোটো তোলার নেশা তাঁর সঙ্গী এখনও। সেই নেশা, প্যাশন থেকেই তো এই ২০২৩-এ ৭৭বছর বয়েসেও ঢুকে পড়তে পারেন জার্মান চিত্রকর-ভাস্কর অ্যানসেল্ম, কেইফারের স্টুতডিওয়। অন্দরে। তৈরি হয় অ্যানসেল্ম-এর মত তথ্যচিত্র। সচেতনভাবেই এখানে ত্রিমাত্রিক ফর্মাট ব্যবহার করে কেইফারের শিল্পজগতের সঙ্গে তিনি দর্শককে সংপৃক্ত করতে চেয়েছেন। মুছে ফেলতে চেয়েছেন সিনেমা আর চিত্রকলার সীমান্তরেখা।
তিনি যে রোড মুডির ধরন বা ঝোঁকটাকেই তাঁর শিল্পরীতি বা স্টাইল হিসেবে বারবার ব্যবহার করেছেন, সেখানেও কোথাও হয়তো নিজেকে বারবার ভেঙে ফেলা আর খুঁজে বেড়ানোর তাগিদটা কাজ করেছে। আসলে নতুন জার্মান সিনেমার সেই সময়টাই ছিল পথ খোঁজার, চেনার ১৯৬০-এর দশকের শেষে বা ৭০-এর গোড়ায় যে এক ঝাঁক তরুণ জার্মান সিনেমাকাররা ছবি করতে এলেন, তাঁদের মাথায় ফরাসি নবতরঙ্গ, তারও আগেকার ইতালির নব্য-বাস্তববাদ যত যাই থাকুক, এই নব্য জার্মান সিনেমাকাররা আসলে পৌঁছতে চাইছিলেন তাঁদের ইতিহাসের শিকড়ে। একদা নাৎসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া ও যুদ্ধে সমূহ পরাজয়ের লজ্জায়, তাঁদের মা-বাবারা যে ইতিহাসেককে সন্তানদের কাছে আড়াল করতে চাইতেন। ওয়ার্নার, হার্জগ, ফাসবিন্দার, মার্গারেট ফন ট্রটা, যাঁদের সবারই জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বা চলার সময়টায়, তাঁরা সেই লজ্জার, অসম্মানের ইতিহাসটাকে জেনে-চিনে, তার প্রেক্ষিতেই বুঝতে চাইছিলেন তাঁদের সমকালটাকেও। কিন্তু ওঁদের সবারই সিনেমা তৈরির ধরন-গড়ন-চলন ছিল অন্যের চেয়ে আলাদা রকমের। যেমন, এই আন্দোলনেরই শরিক হিসেবে উইম ওয়েন্ডার্স তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব স্টাইল। যেখানে রোড মুডি, হলিউড ওয়েস্টার্ন, আমেরিকান স্বপ্নসঙ্গীত-সংস্কৃতির টুকরো টাকরা, এইসব কিছু ক্রমশ পশ্চিমী সভ্যতার সীমানা পেরিয়ে এক বিশ্বজনীন মানবতার দিকে এগিয়ে যায়।
যে নাৎসিবাদের ভূত এই প্রজন্মের জার্মান পরিচালকদের জন্ম থেকেই তাড়া করেছে, তার বীজমন্ত্র ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠের হিংস্র জাতিগর্ব আর তীব্র জাতিবিদ্বেষ। ... রাষ্ট্রের অন্তরে যার চাষ, লালন আর ফলন হয়। ওয়েন্ডার্সের রোড মুডির নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট চরিত্ররা যখন ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া’ গোছের দ্বিধাহীন স্পর্ধায় জাতিরাষ্ট্রের কৃত্রিম সীমানাগুলোকে তাচ্ছিল্য বা উপেক্ষা করে, তাঁরা কী জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্গত বিপদগুলোকেই চিহ্নিত করতে করতে যায়? তাঁর রোড ট্রিলজির প্রথম ছবি ‘অ্যালিস ইন দ্য সিটি’র ফিলিপ উইন্টারের কথাই ধরা যেতে পারে। এই জার্মান লেখক-সাংবাদিক এক আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে হাইওয়েতে চক্কর মারছেন, মোটেলে রাত কাটাচ্ছেন, মার্কিন টেলিভিশনের অসহ্য অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে রাগ করে টেলিভিশন সেটটাই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন— পোলারয়েড ক্যামেরায় খচখচ করে প্রচুর ছবি তুলছেন— কিন্তু লেখা বেরোচ্ছে না। ‘রাইটার্স ব্লক’ কাটাতে তিনি মিউনিখে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাকেচক্রে নিউইয়র্ক বিমানবন্দরেই তাঁর সঙ্গে জুটে বা জুড়ে যায় ৯ বছরের এক আশ্চর্য বালিকা অ্যালিস। জার্মানির কোথাও কোনও এক শহরে, মেয়েটির দিদিমার জিম্মায় তাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটাও বাধ্যতই ফিলিপের ঘাড়ে এসে পড়ে। নিউইয়র্ক থেকে আমস্টারডাম হয়ে, জার্মানি পৌঁছে রাইন নদীর পার ধরে, রুঢ় শিল্পাঞ্চল ধরে এক বালিকার আবছা কুয়াশা-আলোছায়া মাখা স্মৃতি বেয়ে সে এক অলৌকিক যাত্রা। বাবার পরিচয় ও সাহচর্যহীন এক নারী-শিশু ও এক অসফল মধ্যবয়স্ক পুরুষের ক্রমশ তৈরি হয়ে ওঠা মানবিক বন্ধনের ফাঁক গলে কোথায় অস্তিত্বহীন, তুচ্ছ হয়ে যায় দু’টো মহাদেশ, দু’টো বিশ্বযুদ্ধ, পরাক্রান্ত রাষ্ট্রবিক্রম। ছবির শেষে আইনরক্ষকরা আসে বটে কিন্তু অ্যালিস আর ফিলিপ ততক্ষণে একটুও আবেগের বিচ্ছুরণ ছাড়াই লিখে ফেলেছে নির্ভরতা অনুভবের অন্য এক আখ্যান।
আমেরিকার বুকের ওপর বসে, হলিউডকে উপেক্ষা করে উইম ওয়েন্ডার্স পুরোদস্তুর ইউরোপীয় ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন জনপ্রিয় সংস্কৃতির অনেক কিছুই ঘুরেফিরে তাঁর ছবিতে জায়গা করে নিয়েছে। অবশ্যই তিনি মনে-প্রাণে জার্মান ক্যাথলিক। বার্লিন তাঁর প্রিয় শহর। বুন্দেশলিগায় বরসিয়া ডর্টমুন্ড তাঁর প্রিয় ফুটবল দল। কিন্তু উইম ওয়েন্ডার্স তাঁর রোড মুডির প্রধান চরিত্রদের মতোই বিশ্বনাগরিক। তাঁর শেষ কাহিনিচিত্র ‘পারফেক্ট ডেজ’-এর পটভূমি টোকিও। প্রবাদপ্রতিম জাপানি চলচ্চিত্রকার ওজুকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘টোকিও-গা’ নির্মাণের চার দশক পরে তিনি আবার ফিরে আসছেন জাপানে। আসলে কোনও রাষ্ট্র বা জাতীয় পরিচয়ের তকমায় তিনি আটকে থাকতে চাননি কখনো। বরং জাতীয়তাবাদকেই এই গ্রহের, এই মানবতার পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। এই ভারতে, এই শহরে তিনি এবারেই প্রথম এলেন। এই শহরের সত্যজিৎ রায় তাঁর অন্যতম প্রিয় পরিচালক। একাধিক বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সুযোগও হয়েছে। এবারেও তিনি সত্যজিতের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের জানা হলো না, এই শহরের আরেকজন বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, চিন্তা, দর্শনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে কিনা। তাঁকেও বোধহয় আমাদের জানানো হলো না, ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে’, তাঁর মতো করেই জাতিরাষ্ট্র আর উগ্র জাতীয়তাবাদকেই মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট হিসেবে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কী একবার ছবি করার কথা ভাবতে পারেন উইম ওয়েন্ডার্স। সেই জন্যেই কী আরও একবার আসতে হবে এই শহরে। আমাদের জানা নেই, কিন্তু অপেক্ষা রইল।
Comments :0