RG KAR MOVEMENT

দ্রোহ অরাজনৈতিক হতে পারে না

রাজ্য বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

বন্যা কর


১১ অগাস্টের অবনিন্দ সভাঘরে একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। সেই সন্ধ্যায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন আয়োজকরা, যার মধ্যে আমার নজর কেড়েছিল দু’টি কর্মসূচিতে — ১) সাহিত্য জগতে গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার, যা পেয়েছিলেন মূলত সোশাল মিডিয়া বা ছোট টিভি ও রেডিও-তে জনপ্রিয় কিছু ব্যক্তিত্ব। ২) একটা আলোচনাসভা যার বিষয় বক্তব্য ছিল ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে শিশু সাহিত্যের অবদান’। এর দু-দিন আগেই কলকাতার নামকরা সরকারি হাসপাতাল আর জি করে কর্মরত এক মহিলা ডাক্তার কর্তব্যরত অবস্থায় হাসপাতালের ভিতরেই খুন ও ধর্ষিতা হন। ১১ তারিখের সন্ধ্যার গোটা অনুষ্ঠানে  উপস্থিত ছিলাম, একজন সাহিত্যিক, লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার বিজয়ী এমনকি আমন্ত্রিত কবি ও বাচিক শিল্পীদের মধ্যে কেউই আর জি কর নিয়ে বা নারী সুরক্ষা নিয়ে একটাও কথা বললেন না। আমি যখন মঞ্চ পেলাম, তখন আর জি করের প্রসঙ্গ তুলতে দর্শকদের থেকে দু-তিনটে ‘ইশরে’ শুনতে পেলেও, আয়োজকের মুখ ছোট হয়ে গেছিল। বোধ করি ভয় পেয়ে ছিল বইমেলায় যদি স্টল না পায়! বুঝেছিলাম তোষণের রাজনীতি কতটা তীব্র যে বইয়ের কালোকালো অক্ষর গুলোকেও ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে পারে।
১২ তারিখ রাতের বেলায় নিজের ফেসবুক ওয়ালে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’-র পোস্টার আপলোড করি। কয়েকটি কমেন্টের পর চোখে পড়ে একটি কমেন্ট— ‘বন্যা কর ‘দাদা’ মেয়েদের রাত দখল করার কথা, আপনি সেখানে কী করবেন?’ তারপরের কমেন্ট— ‘জনগণ জানতে চায় বন্যা কর রাত দখলে গেলে কী মেয়েরা সেফ ফিল করবে?’
১৪ তারিখের রাত তখন ২:৩০। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে অ্যাকাডেমি চত্বরে। রানুছায়া মঞ্চে মাইক হাতে আমি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় হাজার জন মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই যে আমি বন্যা কর, একজন রূপান্তরিত নারী, আপনাদের সঙ্গে যে রাত কাটালাম, আপনারা কি অসুরক্ষিত বোধ করলেন?’ একটা সমবেত চিৎকার শুনতে পেলাম— ‘না’। হঠাৎ করে দর্শকের মধ্যে থেকে একটা ভীষণ স্পষ্ট নারী কন্ঠ স্লোগান তুললে, ‘মেরি হা বোলনে কি আজাদী, মেরি না বোলনে কি আজাদী, সুনসান সড়ক পে আজাদী, ইয়ে কালি রাত সে আজাদী’
আমার কাছে আর জি করের এই ঘটনা এবং তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা এই নবজাগরণ প্রথম দিন থেকেই একটা বৃহত্তর নারী আন্দোলন। একজন মহিলা, সে তার কর্মক্ষেত্র নৃশংস ভাবে খুন ও ধর্ষিতা হয় এবং আমি ‌নিজে একজন মাইনরিটি ব্যাকগ্রাউন্ডের নারী ও কর্মরত হয়ে মনে করি এই আন্দোলনে তার পরিচয় হিসেবে ডাক্তার শব্দটি অনেক পরে আসে, বরং তার নারী হওয়াটাই এই আন্দোলনটাকে তত বেশি রাজনৈতিক করে দেয় যত বেশি এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
আমি কখনো তিলোত্তমার জন্য পথে নামা এবং ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান বা ধর্মতলার অনশনকে এক আঙ্গিকে দেখিনি। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তিলোত্তমার ন্যায় বিচারের দাবিতে ঠিকই কিন্তু তাঁদের দাবি অনেকটাই বেশি তাদের কর্মক্ষেত্র কেন্দ্রিক এবং একটা প্রচেষ্টা রাজনৈতিক তকমা এড়িয়ে যাওয়ার। আমার কাছে তিলোত্তমার লড়াইটা স্বাস্থ্য ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আরও অনেক বেশি বিস্তারিত এবং নারী অধিকারের একটি লড়াই। তাই এই আন্দোলন অরও বেশি রাজনৈতিক এবং স্পষ্ট ভাবে মতাদর্শ বেছে নেওয়ার মতোই রাজনৈতিক।
একটা রাজ্য যেখানে ঠিক করে দেওয়া হয় আন্দোলনে নামা মেয়েরা হাসবে কি হাসবে না, কী জামা পরবে এবং পরবে না, বিরিয়ানি খাবে কি খাবে না, রাতে বাইরে থাকলে ছেলে বন্ধুর সাথে থাকবে কি থাকবে না, পথ নাটিকায় ঠিক কতখানি ওড়না সরাতে পারবে, হিন্দিতে স্লোগান দিতে পারবে কি পারবে না, আজাদী বলতে পারবে কি পারবে না— সেখানে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ অরাজনৈতিক হতে পারে না। উপরন্তু আমি ভীষণ ভাবেই ডাক্তারদের আন্দোলন থেকে নারী আন্দোলন এবং প্রান্তিক যৌন গোষ্ঠীর মানুষদের অধিকারের আন্দোলনকে আরও বেশি করে আলাদা করতে পেরেছি। যদি সংগ্রামের পক্ষ বাছতে না জানেন তাহলে তা আপোষ হয়েই যাবে। অতএব আর জি করকাণ্ড আদতে দু’টো আন্দোলনের সূত্রপাত— ১) ডাক্তারদের আন্দোলন, ২) নারী ও প্রান্তিক যৌনগোষ্ঠীর মানুষের সুরক্ষা ও অধিকারের আন্দোলন।

 

Comments :0

Login to leave a comment