একদিন যে আমেরিকার অর্থে, মদতে ও প্ররোচনায় রুশ বলয় থেকে বেরিয়ে আমেরিকা-ইউরোপের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল ইউক্রেন আজ সেই আমেরিকার কাছে অপমানিত-লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে অত্যন্ত কদর্যভাবে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোমেদির জেলেনেস্কিকে ওয়াশিংটনে ডেকে এনে যেভাবে হুমকি দিয়ে অপদস্থ করলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উপরাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্স সেটা এককথায় নজিরবিহীন। ভিনদেশের রাষ্ট্রপতি সফরে এলে যে ন্যূনতম কূটনৈতিক সৌজন্য ও আথিতেয়তা প্রাপ্য তা তো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান পেলেনই না উলটে তাকে যাচ্ছে তাই ভাবে অপমান করা হলো। যে ভাষায় এবং যেভাবে জেলেনেস্কিকে অপমান করা হলো সেটা ঔপনিবেশিক যুগের মানসিকতা থেকেও নিম্নমানের। ট্রাম্প-ভান্সরা বুঝিয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনের মতো দেশ তাদের উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তেমনি জেলেনেস্কিরা তাদের খাস তালুকের প্রজা। এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন রাশিয়ার সঙ্গে চলা তিন বছরব্যাপী যুদ্ধের যদি অবসান ঘটাতে হয় তবে আমেরিকার শর্তেই চুক্তি করতে হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হলেও ইউক্রেনের কোনও মতামত আমেরিকা গ্রাহ্য করবে না। ট্রাম্প-ভান্স স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন আমেরিকার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সম্মত হলেই ট্রাম্প রুশ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাবেন।
পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ইউক্রেন ১৯৯১ সালে ভেঙে স্বতন্ত্র হয়। তখন থেকে ইউক্রেন রুশ প্রভাবাধীন বলয়েই ছিল। ইউক্রেন সরকার রুশপন্থী বলেই পরিচিত ছিল। সেই ইউক্রেনে মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপের টাকায় সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে তথাকথিত কমলা বিপ্লবের মাধ্যমে ২০১৪ সালের রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটনো হয়। তারপর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের স্থায়ী শত্রুতা শুরু। রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে এবং চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে ইউক্রেনকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এবং ন্যাটোর সদস্য করতে তোড়জোড় শুরু করে আমেরিকা ও ইউরোপ। বিপদ বুঝে প্রবল বিরোধিতা শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়া মানে রাশিয়া খিড়কির দরজায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি হওয়া। বিপন্নতা বোধ করে রাশিয়া। অবশেষে ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য হওয়া থেকে বিরত করতে রাশিয়া সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর প্রেক্ষাপট এটাই। রুশ বাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর মতো সামরিক সামর্থ্য ইউক্রেনের নেই। তথাপি তিন বছর তার যুদ্ধ চালিয়েছে প্রধান আমেরিকার অর্থ, অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সহায়তায়। বাস্তবে ইউক্রেনকে দাবার বোড়ে বানিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়েছে যার ফলে বহু মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি গোটা দেশ ধ্বংসের মুখোমুখি। এই অবস্থায় খাদের অতলে চলে যাওয়া ইউক্রেন থেকে হাত তুলে নিচ্ছে আমেরিকা। খানিকটা রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ইউক্রেনকে আক্রমণ করে যুদ্ধ থামাতে বলেছেন ট্রাম্প। কিন্তু শর্ত চাপিয়েছেন যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকে দেওয়া টাকা ফেরত চাই। কীভাবে ফেরত? ইউক্রেনে আছে বিপুল দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান খনিজ। সেই খনিজের অধিকার দিতে হবে আমেরিকাকে। জেলেনেস্কিকে ডেকে সেই মর্মে চুক্তি করতে চেয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু জেলেনেস্কি নিরাপত্তার কথা তুলতেই খেপে যান ট্রাম্প। অর্থাৎ ইউক্রেনকে গাছে তুলে এখন মই কেড়ে নিচ্ছেন যাতে বাধ্য হয়ে তাদের খনিজ সম্পদ আমেরিকার নৈবেদ্যে অর্পণ করতে।
editorial
গাছে তুলে মই কাড়ছে আমেরিকা

×
Comments :0