বই — মুক্তধারা
পৃথিবী আজ সবচেয়ে বেশি ধুঁকছে জলবায়ুর সঙ্কটে
পার্থপ্রতিম ঘোষ
২ সেপ্টম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
কামারহাটি পৌরাঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য অণ্বেষ’ শারদোৎসবের প্রাক্কালে বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু সঙ্কটকে মূল বিষয় করে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সম্পাদকীয় নিবন্ধে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা হয়েছে— ‘‘বর্তমানের পৃথিবীতে সবচেয়ে অবহেলিত পৃথিবী নিজে। দায়ভার একশোভাগ তার অধিবাসী মানুষের। ক্রমশ উত্তাপ বাড়ছে বিশ্বের!...আজ মানুষেরই লাগামহীন চাহিদা মানুষকেই ধনে-প্রাণে মারছে-বাস্তুহারা হচ্ছে মানুষ-ই।’’ কর্পোরটকে তোল্লা দিতে গিয়ে দুনিয়ার মাতব্বর আমেরিকা থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশগুলি যেভাবে জীবাশ্ম দহনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে তারও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে ‘জলবায়ুর সঙ্কট: সুস্থ সমুদ্র, সুস্থ পৃথিবী’ নিবন্ধে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে এই বিপদের স্বরূপ, ও তার থেকে পরিত্রাণের স্পষ্ট দিশার সন্ধান দিয়েছেন সব্যসাচী মজুমদার। বিপন্নতার ব্যাপকতা বোঝাতে গিয়ে নিবন্ধকার যথার্থই বলেছেন—“এই সঙ্কটের সবচেয়ে বড় শিকার হলো প্রান্তিক মানুষ,মহিলা ও শিশুরা।…তাই আজ আওয়াজ উঠেছে জলবায়ু সুবিচার ও যথার্থ রূপান্তরের। ধনতান্ত্রিক ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলিকে অর্থ,প্রযুক্তি ও জ্ঞানের যথার্থ রূপান্তরের মাধ্যমে এই সংকট মোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে শতক শেষের 1.5০Celcius লক্ষমাত্রা মরীচিকা হয়েই থাকবে।” জলবায়ুর এই সঙ্কটমোচনের ক্ষেত্রে কৃষির তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার কথা তথ্যগতভাবে তুলে ধরে প্রাবন্ধিক অমিতাভ আইচ তাঁর নিবন্ধে ভারতবর্ষের মতো দেশে জনজাতিসমূহের কৃষিপদ্ধতি ও জ্ঞানসমূহের প্রতি আবারও নিবিড় দৃষ্টিপাত ও পর্যবেক্ষণের কথা বলেছেন। একই বিষয় নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ নিবন্ধ লিখেছেন অজয় ভট্টাচার্য ও মধুছন্দা চক্রবর্তী।
জলবায়ু সঙ্কট ছাড়াও ‘ঐতিহ্য অণ্বেষ’-এর এই সংখ্যায় ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ের জন্মদ্বিশতবর্ষের স্মরণে তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখেছেন তাপস ভট্টাচার্য। তাঁর এ মূল্যায়ন যথার্থ যে, ‘রামমোহন যে Universal brotherhood এবং liberty , Equality & Fraternity-র আদর্শ প্রচার করেছিলেন সেই আদর্শই আমাদের ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করেছিলেন। তাই রামমোহনকে বলা হয় প্রথম আধুনিক ভারতীয়।’ ‘শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি: নাগরিক মৃণাল সেন’ নিবন্ধে প্রাবন্ধিক পার্থ রাহা ভুবনজয়ী চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের সাথে কলকাতা আর তার নাগরিক জীবনের নিবিড় সম্পর্ক-সম্বন্ধের কথা বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন: ‘মৃণাল সেনের কলকাতার সঙ্গে আত্মীকরণ আজকের নয়,সাময়িক নয়। তাঁর আত্মীয়তা বহুদিনের,বহুযুগের।…পাঁচ দশকের বন্ধন কোনোদিন শিথিল হয়নি।’ ‘আমার ভুবন’-এর ন্যারেটিভ ভঙ্গিমায় যে পৃথিবীর দিশা স্রষ্টা মৃণাল দেখাতে চেয়েছেন, প্রাবন্ধিক পার্থ রাহার মনে হয়েছে এ হলো ‘পরিচালকের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ভুবন।’ প্রদোষ কুমার বাগচী ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় উজ্জ্বল স্মৃতিস্তম্ভ মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’ নিবন্ধে শিক্ষণীয় অতীত-ঐতিহ্যের আয়নাতে বর্তমানের বিপন্ন সংস্কৃতিকে দেখতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই লিখেছেন ‘সমাজের অভ্যন্তরে বই পাঠের কথা উঠলে জনাকয়েক উৎসাহী গ্রন্থকীটের পাঠস্পৃহার কথা বোঝায় না, সামগ্রিকভাবে সমাজের সকল অংশের মানুষের পাঠাভ্যাসের কথাই বোঝায়। এর জন্যই গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম। লেনিন বলেছিলেন,স্টাডি ইজ এসেনশিয়াল ফর ইন্টেলিজেন্ট, থটফুল অ্যান্ড সাকসেসফুল পার্টিসিপেশন ইন রেভোলিউশন।…এখানেই সংগ্রামের জন্য বই পড়ার গুরুত্ব। প্রদোষকুমার বাগচীর এই নিবন্ধের ভাবনা ও উপস্থাপন অভিনন্দনযোগ্য। ড.অমরনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তা: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ প্রবন্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিরপ্রাসঙ্গিক শিক্ষাভাবনাকে সমকালের প্রেক্ষিতে দেখতে চেয়েছেন। প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লেখা হয়েছে’ ‘যাঁর কাছে কর্মই ধর্মের নামান্তর।যিনি ধর্ম বলতে ঈশ্বরচিন্তাকে অগ্রাধিকার দেন না।…জনশিক্ষার বিস্তার-সংস্কার নিয়ে বাংলা তথা আসমুদ্র হিমাচল বর্তমান হতে ভবিষ্যৎ যতবার ভাববে ততবারই ঘুরে ফিরে আসবে বিদ্যাসাগরেরই কথা।…তিনি আমাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তিনি চিরজীবী।’ —কথাগুলি আপামর বাঙালিরই মনের কথা। দেবীপ্রসাদ মজুমদারের ‘শতবর্ষে রক্তকরবী’,ড.প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চিন্তায় ও মননে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’, মায়া দাশগুপ্তের ‘কনক মুখার্জি—স্মরণে-মননে’ মূল্যবান প্রবন্ধ। এছাড়া হেমন্ত কুমার রায়,শ্রাবণী সরকারের প্রবন্ধ ও কবিতাগুলি সংখ্যাটির উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনাও প্রশংসনীয়। ‘ঐতিহ্য অণ্বেষে’র এই সংখ্যা সংগ্রহে রাখবার মতো।
‘ঐতিহ্য অণ্বেষ’ । অষ্টম বর্ষ, বিশেষ সংখ্যা
সম্পাদক—ড.অমরনাথ ভট্টাচার্য। ৩৯,পি.সি.ব্যানার্জি রোড, কলকতা—৭০০ ০৭৬। ২০০টাকা।
Comments :0