দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত দে
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর। হিংসার আগুনে সেখানকার মাটি এখন তপ্ত। ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের আগেই দেশের সংসদ ভবনে শেষ হয়েছে বাদল অধিবেশন। মণিপুর প্রসঙ্গে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল বিরোধীরা। দাবি ছিল মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের।
চাপের মুখে কেন্দ্র জানায় তারা মণিপুর নিয়ে আলোচনা করবে। প্রথমে দীর্ঘ ভাষণে মিনিট পাঁচেকের জন্য মণিপুর নিয়ে বলেছেন শাহ। তারপর প্রধানমন্ত্রী, একই কায়দায় ঘণ্টাখানেক নিজের ঢাক বাজানোর পর, শুরু করেন মণিপুর প্রসঙ্গে বলতে। তার আগে সুরটানা দুই ঘন্টার বক্তব্যে ছিল অতীত ভারত ও বিজেপি সরকার কি করেছে তার বিবরণ। বহু ‘বীথি’ ঘুরে তিনি অবশেষে মণিপুরে ঢোকেন কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। মণিপুরের ঘটনা নিয়ে যত না বললেন তার থেকে বেশি নিন্দা করলেন বিরোধীদের। তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে তিনি নিজের ‘জিগর কা টুকরা’ বলে কী আলাদা বোঝাতে চাইলেন!
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন মণিপুরে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতমাতাকে হত্যা করা হয়েছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের সময়ের নানা দৃষ্টান্ত তুললেন, তা নিয়ে বিতর্কও হলো। কারণ উগ্রপন্থীদের দমনে বায়ুসেনার তৎপরতাকেও দায়ী করে ফেললেন! কিন্তু কেন এই বিভাজন, কেন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা, ব্যাখ্যা করার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না নরেন্দ্র মোদী।
মণিপুরবাসীরা কিন্তু বলছেন কুকি-মেইতেই নয় সেখানের সমস্যা সৃষ্টির পেছনে সম্পূর্ণ দায়ী কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। কুকি দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বিজেপির বোঝাপড়ার অভাব এবং মণিপুরের মাটিতে থাকা অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রথমটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে গোপনে আদানি আম্বানির কাছে সেই সম্পদ বিক্রি করার জন্যই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসার বিষ ছড়িয়েছে বিজেপি।
লামাবাম পিশাক সিং নামে মণিপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, বিজেপি সরকার অন্য কিছু ধামা চাপা দেওয়ার জন্য কুকি-মেইতেইদের মধ্যে সমস্যা দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মেইতেই বা কুকিরা কেউ কারো বিরোধী নয়। বহু পরিবার আছে যেখানে মা হয়তো মইতেই আর বাবা কুকি বা উল্টোটা। কিন্তু আসলে মণিপুরের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সঙ্গে সমস্যা কুকি উগ্রপন্থীদের। লামাবামের আরও দাবি এই সব কিছুর মধ্যে চরম নির্যাতনের স্বিকার মহিলারা। শুধু যে তারা ধর্ষিত হচ্ছে খুন হচ্ছে তাই নয়। বহু মেয়ে ইঈ সুযোগে পাচার হয়ে যাচ্ছে রাজ্যের বাইরে। সন্ত্রাস কবলিত মণিপুরে এখন নেই কাজ করার পরিবেশ। লামাবামের দাবি এই সুযোগে বাড়ির মেয়েরা কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে যেতে চাইবে সেখানেই ওঁত পেতে আছে পাচার চক্র। তবে শুধু মেয়েরা নয় বহু অল্প বয়েসি ছেলেরাও পাচার হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা পত্রে উঠ আসা তথ্য অনুযায়ী মণিপুর ব্যবহৃত হয় মহিলা পাচারের রুট হিসেবেও। নেপাল সহ ভারতের প্রত্যন্ত প্রান্তের মেয়েদের এই রুটে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয় ভিন দেশে। যেহেতু মণিপুরের একদিকে মায়ানমার সীমান্ত সেখানে থেকে কেউ পাচার হয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ডের দিকে। আবার দুবাইতে কাজ দেওয়ার নাম করেও পাচার চক্র কাজ চালাচ্ছে।
রাত পোহালেই স্বাধীনতা দিবস। সারা দেশেই পালিত হবে এই দিবস। কিন্তু মণিপুরে অবস্থাটা কেমন হবে। স্বাধীন একটি রাজ্য এখন কারফিউয়ের বেড়াজালে আটকা। মানুষের সমস্ত অধিকার নিয়ন্ত্রিত সেনা-পুলিশ দ্বারা। সরকার সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ। দিশেহারা রাজ্যবাসী কি করবেন জানেন না। কিন্তু তারপরেও বাড়ির মেয়েগুলো যখন অত্যাচারীদের হাতে আক্রান্ত তখন সাধারণ মানুষ তাদের কন্ঠ ছেড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। রাষ্ট্র চক্রান্ত করে গুন্ডামি চালালেও মানুষ ভয় ভুলে পথে নেমেছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ছিড়ে মেয়েরা অভিযোগ দায়ের করছে। এটাই হয়তো স্বাধীনতার পথ।
মণিপুর গত ২ মে থেকে উত্তপ্ত। কেন্দ্র ও সে রাজ্যের বিজেপি সরকারের দাবি কুকি ও মইতেইদের মধ্যে জাতী গত সমস্যা। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে মারছে, লুঠ করছে, খুন করছে, তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি হিংসাতে ধর্ষিত হয়েছেন, খুন হয়েছেন বহু মহিলা। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সেই বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ উহ্য। আজাদি কি অমৃত মহোৎসবে তার ‘বেটি’-দের জন্য কি বললেন মোদী। তবে যে শুধু মণিপুর প্রসঙ্গেই নয় বিলকিস বানো, কাঠুয়া, হাথরস, মহিলা কুস্তিগির বা মণিপুর কোনও কান্ডতেই ‘বেটিদের’ পাশে দাঁড়াননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বহু কষ্টে মণিপুরের ধর্ষণ ও খুন কান্ড নিয়ে দুটো লাইন বলেছিলেন বটে। ‘কিন্তু মেয়েরা সমাজের নিম্ন স্তরে বা মেয়েদের কাজ শুধু রান্না করা সন্তান প্রতিপালন করা’ এই মানসিকতায় যে রাজনৈতিক দল বিশ্বাস করে সেই দলের নেতা আর কতই বা স্বাধীন চিন্তা করতে পারবেন!
Comments :0