Neo Fascism PB

নয়া ফ্যাসিবাদ ব্যাখ্যা করল পলিট ব্যুরো

জাতীয়

আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব, ফ্যাসিবাদ ও নয়া উদারবাদের সাপেক্ষে ‘নয়া ফ্যাসিবাrদ’-কে ব্যাখ্যা করল সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো। গত ১৭-১৯ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে পলিট ব্যুরো ‘নয়া ফ্যাসিবাদ’ শব্দবন্ধনীটির ব্যবহার নিয়ে এই ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছে শনিবার। পলিট ব্যুরো বলেছে, পার্টির ২৪তম কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব ইতিমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে। তার সঙ্গেই এই ব্যাখ্যাটিকে যুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রচার মাধ্যমে ওই ব্যাখ্যার কিছু ভুল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেই কারণে পলিট ব্যুরোর ব্যাখ্যাটি প্রকাশ করা হলো।
এই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে:
প্রথমত, খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে লেখা হয়েছে, ‘‘বিরোধীপক্ষ ও গণতন্ত্রকে দমন করতে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ও কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসনে নয়া-ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।’’ রাজনৈতিক প্রস্তাবে জাতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে এই প্রথম আমরা ‘নয়া-ফ্যাসিবাদী’ শব্দবন্ধনীটি ব্যবহার করেছি।
দ্বিতীয়ত, এর আগে পার্টির ২২তম কংগ্রেসে আমরা বলেছিলাম, কর্তৃত্ববাদী ও হিন্দুত্ববাসী সাম্প্রদায়িক আক্রমণে ‘ফ্যাসিস্ত ধাঁচের প্রবণতার উত্থান’ দেখা যাচ্ছে। ২৩তম কংগ্রেসে বলা হয়েছিল, মোদী সরকার আরএসএস’র ফ্যাসিস্ত ধাঁচের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, নয়া-ফ্যাসিবাদ শব্দবন্ধনীটির অর্থ কী? ‘নয়া’-র অর্থ নতুন বা পুরানো কিছুর সমসাময়িক বর্ণনা। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে নয়া-ফ্যাসিবাদ শব্দবন্ধনীটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল ইউরোপে যুদ্ধের অন্তর্বর্তী বছরগুলিতে, যেমন মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ও হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে। সেই সময়ে বিশ্বের পুঁজিবাদী সঙ্কটের পরিণতিতে ১৯২৯ ও ১৯৩৩ সালের মধ্যে মহা মন্দা দেখা দিয়েছিল, তীব্র হচ্ছিল আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বগুলি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুই-ই ছিল আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের ফল। ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি ক্ষমতা দখলের পরে খতম করে দিয়েছিল বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে এবং অস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর ও অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার একটি পথ হিসাবে ব্যবহার করেছিল যুদ্ধকে। ওই সব দেশের একচেটিয়া পুঁজি পুরোপুরি সমর্থন জানিয়েছিল ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলিকে এবং সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাদের উপরেই ভরসা করেছিল। 
চতুর্থত, নয়া-ফ্যাসিবাদের কিছু উপাদানের সঙ্গে মিল রয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ফ্যাসিবাদের। উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আছে ঐতিহাসিক ভুল ও অন্যায় সম্পর্কে ধারণাগত উপলব্ধি, যা একদিকে নিশানা করে ‘অন্যদের’— জাতিগত দিক থেকে অন্যদের বা ধর্মীয় দিক থেকে অন্যদের বা জনগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের এবং আরেকদিকে সমর্থন করে অতি-দক্ষিণপন্থী বা নয়া-ফ্যাসিস্ত দল বা শক্তিগুলিকে। ভারতে নয়া-ফ্যাসিবাদকে রূপ দিয়েছে আরএসএস এবং তার হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ, যা আমাদের পার্টি কর্মসূচি অনুযায়ী ফ্যাসিস্ত ধাঁচের এবং যা বিজেপি শাসনে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। বৃহৎ বুর্জোয়াদের স্বার্থে কাজ করার জন্য হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণ মতাদর্শ, নয়া-উদার সঙ্কট এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সমন্বয় প্রাথমিক নয়া-ফ্যাসিবাদেরই উপাদান। 
পঞ্চমত, নয়া-উদারবাদের সঙ্কট থেকেই নয়া-ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি। বিভিন্ন দেশে নানা নয়া-ফ্যাসিস্ত শক্তির উত্থান হয়েছে এবং কয়েকটি দেশে তারা ক্ষমতায়ও এসেছে। কিন্তু এই সময়ে বিশ্ব লগ্নি পুঁজির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বগুলিকে চেপে রাখা হয়েছে, যাতে নয়া-ফ্যাসিস্ত শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী শত্রুতা থেকে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে। ১৯৩০’র দশকের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির এখানেই তফাৎ। অতি-দক্ষিণপন্থী ও নয়া-ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি নয়া-উদার সঙ্কট এবং তার পরিণতিতে উদ্ভূত মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগায় মনোরঞ্জনকারী বাগাড়ম্বরের রাস্তায় হেঁটে। কিন্তু ক্ষমতায় এলে এরা নয়া-উদার নীতিগুলিকে বাতিল করে না, বরং সেই একই নীতি অনুসরণ করে, যা বৃহৎ পুঁজির স্বার্থবাহী। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নয়া-ফ্যাসিবাদের আরেকটি পার্থক্য হলো, নয়া-ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি নিজেদের রাজনৈতিক প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নির্বাচনকে ব্যবহার করে এবং এমনকী ক্ষমতায় এ‍‍‌লেও এরা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয় না। এরা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে, কিন্তু বিরোধীপক্ষকে দমন করতে ও নির্বাচনে সুবিধা পেতে কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এরা রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে থেকে কাজ করে রাষ্ট্র কাঠামোয় দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবর্তন আনতে চায়। 
ষষ্ঠত, আমরা বলেছি, বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট আঁতাতে পরিচালিত কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা, যার মধ্যে নয়া-ফ্যাসিস্ত ধাঁচের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। আমরা বলছি না যে, মোদী সরকার একটি ফ্যাসিস্ত সরকার বা নয়া-ফাসিস্ত সরকার। ভারতীয় রাষ্ট্রকেও আমরা নয়া-ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করছি না। যে বিষয়টির উপর আমরা মূল জোর দিতে চাইছি, তা হলো, আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি’র টানা দশ বছরের শাসনে বিজেপি-আরএসএস’র হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তার পরিণতিতেই ‘নয়া-ফ্যাসিস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি’র বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এই ‘বৈশিষ্ট্য’ শব্দটির অর্থ লক্ষণ বা প্রবণতা, কিন্তু বৈশিষ্ট্যগুলির বহিঃপ্রকাশ এখনও একটি নয়া-ফ্যাসিস্ত সরকার বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপ নেয়নি। তাই আমাদের পার্টির ২৪তম কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট আঁতাতে পরিচালিত কর্তৃত্ববাদের বিপদের কথা বলা হয়েছে, যা নয়া-ফ্যাসিবাদের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে, যদি না বিজেপি-আরএসএস’র সঙ্গে লড়াই করে ওই শক্তিকে রুখে দেওয়া যায়।  
সপ্তমত, আমাদের পার্টির এই অবস্থান সিপিআই এবং সিপিআই(এমএল)’র থেকে আলাদা। সিপিআই মোদী সরকারকে একটি ফ্যাসিস্ত সরকার বলে চিহ্নিত করছে। সিপিআই(এমএল)’র মতে, ভারতীয় ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment