স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক দাঙ্গার সাক্ষী থেকে রক্তাক্ত হয়েছে অনেকবার, বহু সম্প্রদায়ের আশ্রয় হয়ে উঠবে,আর সময়ের প্রেক্ষিতে ক্ষত তৈরি হবে না, এ তো ভাবনাতীত। যতই পরিস্থিতি জটিল হোক, সাধারণ হিন্দু মুসলিম উভয়ই নিজেরা সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে এগিয়ে এসেছে, এ ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট,শুরু হল ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। ৭৬ বছর অতিক্রান্ত। তখন মানুষের বুঝতে সময় লেগেছিল যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় দুই সম্প্রদায়ের ( হিন্দু ও মুসলিম) উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাই দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য দিনের পর দিন প্রস্তুতি চালিয়েছিল। মানুষের মধ্যে যথারীতি সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষ ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি, এতে এক উন্মত্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। অবিভক্ত ভারত, চূড়ান্ত সময়। ব্রিটিশ শাসক বরাবর দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুলে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার কাজে নিমগ্ন হয়ে থাকত। আঁচড় লাগত না নিজেদের। তারা ঠিক করেই ফেলেছিল ভারতকে বিভক্ত করে পৃথকভাবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, আর সেই কারণেই দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়া জরুরি। দাঙ্গা শুরু হতেই কলকাতার পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সেই কারণে অবারিত গণহত্যা, লুঠতরাজ ব্যাপক আকার নিতেই ব্রিটিশ শাসক "শান্তিকামী", ও "ভারত বন্ধু" হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে গিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়, এতে ১৬ই আগস্টে দাঙ্গার পেছনের উদ্দেশ্য সফল হবার প্রক্রিয় অনেকটাই এগিয়ে গেল। সেই অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি পরিষ্কারভাবেই দেশ বিভাগের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, সেই সময় তৎকালীন নিজেদের সীমিত শক্তি নিয়েই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ও কংগ্রেস-লীগের ঐক্যের জন্য লাগাতার অভিযান চালিয়ে গেছে। ঠিক চারদিন আগে ১২ই আগস্ট আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন বাংলা সরকার ১৬ ই আগস্ট কে সরকারি ছুটি ঘোষণা করল, সেই দিন কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে বিষয়টির ওপর মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের নোটিশ দেওয়া হয়,পাশাপাশি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সারাদেশে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস" হিসেবে পালনের আহ্বান জানানো হয়। ঠিক সেইদিন কমরেড জ্যোতি বসু পার্টির অভিমত জ্ঞাপনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার সেই মুহূর্তে তাকে বলার অনুমতি দিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। আগেভাগে এই ছুটি ঘোষণা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সম্প্রীতির পরিবেশ কে দূষিত করবে,সুতরাং এই দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা নেই,এই মর্মে জ্যোতি বসু বোঝাতে চেয়েছিলেন কিন্তু অবিচল ছিলেন লীগের নেতৃবৃন্দ। কিছু একটা অপ্রীতিকর ঘটার আশঙ্কায় তৎকালীন পার্টিনেতৃত্ব স্থানীয় কমরেডদের আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই কলকাতায় শ্রমিক অধ্যুষিত ও মিশ্র এলাকাগুলোতে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেন। কমরেড জ্যোতি বসু তখন রেল ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত সঙ্গে আরেক নেতা কৃষ্ণমূর্তি এবং নিখিল মৈত্র নারকেলডাঙ্গায় শ্রমিক লাইনে সন্ধ্যে অবধি থেকে যান। ততক্ষণে দাঙ্গা শিয়ালদহ অঞ্চলে এবং বেলেঘাটা মেনরোডে চূড়ান্ত আকার নিয়েছে। একদিকে যেমন মিছিলের পর মিছিল, অন্যদিকে বাড়িঘর পুড়ছে রাস্তার দুপাশে সারি সারি মৃতদেহ চারিদিকে আগুন। ততক্ষণে লোকজনের মুখে মুখে দাঙ্গার ভয়াবহ অবস্থা শুনতে পেয়ে তারা মেইন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহ লরেটো স্কুলের পাশে ১২১ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির অফিসে চলে আসেন, সেখানেই রাত অবধি থাকেন। কমরেডরা খালি পেটে কখনও অল্প বিস্তর কিছু মুখে দিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন বিনা দ্বিধায়। সদা জাগ্রত প্রহরীর মতো নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সারা দিন রাত মানুষকে ভয়াবহ গন্ডগোলের ভেতর থেকে উদ্ধার কার্যে লেগে যান, কখনও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কখনো নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, এ সবের জন্য পার্টি অফিসেই খবর আসত। সেই সময়ের নেতৃবর্গ নৃপেন সেন, সরোজবাবু নিজেরাই পিপলস রিলিফ কমিটির ভ্যান চালিয়ে ৮/ই ডেকার্স লেনে অফিসে জড়ো হতেন। আহত কমরেডদের বিপদসঙ্কুল পরিবেশ থেকে স্থানান্তরিত করে মেডিকেল কলেজে পৌঁছে দিয়ে আবার অন্যত্র ঝাঁপিয়ে পড়তে হত। কলকাতায় বরাবর বিপদের ঢেউ আগে এসে পড়ত যথারীতি, আর তারা মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে চলত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। খোকা রায়,প্রমোদ দাশগুপ্ত, দীনেশ রায় প্রমুখ কমরেড উপস্থিত তখন। হঠাৎ প্রাদেশিক কমিটির অফিসে খবর এসে পৌঁছল চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে ইসলামিয়া হাসপাতালের পাশে এক বিরাট বাড়ির হোটেলের ওপর তলায় ফ্ল্যাটে আটকে পড়েছেন নীরদ চক্রবর্তী,বঙ্কিম মুখার্জি, সস্ত্রীক আব্দুল মোমিন,আর ওই বাড়িতে অন্যদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে,জীবন বিপন্ন সকলেরই। পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী কমরেড জ্যোতি বসু মহম্মদ ইসমাইল কে সঙ্গে নিয়ে একটি গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লেন, ময়দানের উদ্ধার কেন্দ্রের কাছে পৌঁছতেই এক ইংরেজ যুবক রিভলবার হাতে এক সিপাইকে নিয়ে লরিতে উঠছিল,ওদেরকে এই বিষয়ে কথা বলতেই সেই ইংরেজ যুবক তাদের অনুসরণ করার কথা বলে, এতে বেশ কাজ হয়েছিল, উন্মত্ত হাজার হাজার জনতা কিন্তু সেই লরি পৌঁছতেই সরে গেল, এরপরেই একে একে সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়, যদিও ইতিমধ্যে কমল সরকার ও স্নেহাংশু আচার্য্য যোগ দেন। কলকাতা জেলার পার্টি অফিস, প্রাদেশিক কমিটির পার্টি অফিস গুলোতে ততদিনে দলমত, ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলিম উভয়কেই আশ্রয় দেওয়া শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় কলকাতায় মৃতের সংখ্যা ২০,০০০ এর বেশি। এটাই বাস্তব ছিল,হিন্দু মুসলিমের বিরাট সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ বিভাগ একেবারেই চান নি, ঠিক যেমন ভাবে চান নি কংগ্রেস- লীগের একাংশ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ( উত্তরপ্রদেশ),বিহার প্রভৃতি প্রদেশে দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই এমন বহু ঘটনা সামনে আসতে শুরু করেছিল যেখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নিজেরাই হিন্দুদের থাকার জায়গা করে দিচ্ছেন এবং হিন্দুরাও এগিয়ে আসছেন পাশাপাশি। বহুদিন ধরেই অস্থিরতা চললে, এর জেরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং শান্তিরক্ষা কমিটি তৈরি করা সম্ভব, জনসাধারণের ভেতর আতঙ্ক দূর করা, পুনর্বাসন এসব নিয়ে মুখ্য ভূমিকায় পার্টি কর্মীরাই তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। শান্তি বাহিনীর কার্যত রূপ প্রকৃতপক্ষে গড়ে তুলেছিলেন কমিউনিস্টরাই। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী স্বীকার করেছিলেন জনসমক্ষে। পার্টি নেতৃত্ব সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় শান্তি রক্ষা কমিটি গড়তে চাইছিলেন, আর এই বিষয়ে মতামত নিতে কমরেড জ্যোতি বসু ভূপেশ গুপ্ত কে নিয়ে দেখা করতে গেলেন গান্ধীজীর সাথে, ১৯৪৭ সালে বেলেঘাটায় তখন গান্ধীজী ক্যাম্প করে ছিলেন, দেখা করার পরেই মত দিলেন সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় মিছিল সংগঠিত করতে। সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা এক হলেও হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কমিউনিস্টদের সঙ্গে আসতে রাজি হলেন না, পরবর্তী প্রেক্ষিতে দলমত নির্বিশেষে শান্তি অভিযান কে কেন্দ্র করে ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং উভয় সম্প্রদায়ের দাঙ্গাবাজদের সংযত করাও শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষের চেহারা নিয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষ ভাবে চিন্তিত, মণিপুরের সম্ভ্রম বেআব্রু হয়ে পড়েছে গত তিনমাস ধরেই, সভ্যতার লজ্জা ,অন্ধকারময় পরিস্থিতি যাই বলা যাক না কেন, প্রতিদিন ভয়াবহতা বাড়ছে। আগুন কিছুতেই নিভছে না। ডুয়েল ইঞ্জিনের কোনো তৎপরতা না থাকার দরুণ আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে সারা দেশের মানুষকে, প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবের চাপে পড়ে নব্বই দিন পর দের ঘণ্টার বক্তৃতার শেষে মণিপুর নিয়ে দুটি লাইন, কিন্তু নিজের দলের বিজ্ঞাপন, আগামী ভোটের কথা মাথায় রেখে কর্পোরেট কায়দায় মুনাফা তুলতে চাইলেন পরিকল্পনা মাফিক, দেশের প্রধানমন্ত্রী দলের হয়েই রইলেন, দেশের সাধারণ মানুষের জন্য হতে পারলেন না, ব্যর্থ। যেটা ভয়ংকর চিন্তার বিষয় সাম্প্রদায়িকতা বিষ আবারও ছড়াচ্ছে হরিয়ানায়,মিজোরামে ধর্মের উস্কানি, কিন্তু এবারে বিরোধী জোট "ইন্ডিয়া" যে সত্যিই চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে তা প্রধানমন্ত্রী চোখে মুখে স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু ইন্ডিয়াকে রক্ষা করতে " ইন্ডিয়া"র দায়িত্ব, দায় অনেক বেশি, অস্বীকার করার জায়গা নেই। সময় আলাদা, হলেও দেশের কোথাও কোথাও চিত্র যে এক হতে শুরু করেছে, তাতে ভাবনা গভীর হচ্ছে।
(তথ্যঋণ: "যত দূর মনে পড়ে " জ্যোতি বসু)
Comments :0