Dental Care

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম...

ফিচার পাতা

Dental Care


ডাঃ উত্তম দেব

নামী-দামী নানা রোগের আড়ালে অনুচ্চারিত থেকে যায় প্রায় ৮০% বয়স্ক মানুষ যে রোগে ভোগেন সেই দাঁত, মাড়ি ও মুখমণ্ডলের নানা যন্ত্রণার কথা। বয়স্ক মানুষ দাঁত থাকলেও কষ্ট পান। না থাকলেও কষ্ট। দেহের অন্যান্য অংশের মতো দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত পরিচর্যা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার প্রয়োজন। দাঁত থাকতেই দাঁতের মর্যাদা রাখলে শরীরের মর্যাদাও সুরক্ষিত থাকে।
শরীরের ত্বক, আঙুলের নখ, মাথার চুল কিংবা মুখগহ্বরের ঝিল্লির মতোই দাঁতের এনামেল সমগোত্রীয় আবরণী কোষ-কলা দিয়ে তৈরি। চুল কিংবা নখ নষ্ট হলে আবার তৈরি হয়। কিন্তু দাঁতের এনামেল একবার নষ্ট হলে, ক্ষয় হলে নতুন করে গজায় না। তাই ক্ষতিগ্রস্ত এনামেলকে মেরামত করতে হয় কৃত্রিমভাবে।

কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ১৯০১ সালে ১.২ শতাংশ, ১৯৫১-তে ২%, ১৯৯২-এ ৫.৭%, ২০০১ সালে ৭.৭% এবং ২০১৮ সালে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা হলো ১০%। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা হতে চলেছে ৩০%। এই বিরাট সংখ্যক মানুষের বিশেষ রোগ (Geriatric disease) মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসাবিদ্যা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হলে এক প্রবল সামাজিক দুর্যোগ তৈরি হবে।

National Programme for Health Care for the Elderly (NPHCE) ২০১৩ সালে আর্থিক সংস্থান রাখবার ব্যবস্থা করেছিল বয়স্ক মানুষের, রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার উন্নতিসাধনে। এই ভাবনাকে কার্যকরী করার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য যৌথস্তরে সমন্বয় সাধন করে বয়স্ক মানুষ (৬০+) এবং অতিবয়স্ক মানুষ (৮০+)কে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে হবে। এই বিরাট অং‍‌শের প্রবীণ মানুষের ৩০% দরিদ্রসীমার নিচে বাস করেন। সরকারি উদ্যোগ এবং সক্রিয়তা ব্যতীত এই সমস্ত মানুষের চিকিৎসা সম্ভব নয়। পঞ্চায়েত স্তরে এই উদ্যোগকে সঠিকভাবে পৌঁছাতে হবে।

বয়স্ক মানুষের সাধারণ দাঁত ও মাড়ির রোগ:
মুখের মধ্যে কতগুলি দাঁত ভাঙাচোরা, কতগুলি দাঁত নেই, কত দাঁতে ফিলিং করা আছে, মুখে ক্ষত বা ঘা (Ulcer) আছে কিনা এবং দাঁতের উপর দন্তমল (Tartar) জমেছে কিনা এই সমস্ত পরিমাপ করে ‘Oral Hygiene Index’ তৈরি হয় এবং এই সূচকটি বেশিরভাগ প্রবীণ মানুষের ক্ষেত্রেই খারাপ।
: অনেকগুলি দাঁত নেই অর্থাৎ নড়ে নড়ে পড়ে গেছে কিংবা তুলে ফেলতে হয়েছে। তাই খাওয়ার অসুবিধা, সামনের দাঁত না থাকলে কথা বলতে অসুবিধা। মুখের সৌন্দর্যহানী। মুখের মাংসপেশি শিথিল হয়ে যাওয়া।


: ভাঙাচোরা দাঁতের জন্য চর্বণ ক্রিয়া ব্যহত, গাল কেটে যায়, জিবে কামড় পড়ে।
: চিকেন, মার্টন খাওয়ার পরে দাঁত ও মাড়িতে প্রবল ব্যথা। অনেকে ভয়ে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন।
: দাঁত ও মাড়িতে প্রচুর পাথর বা দন্তমল, ফলে দাঁত কমজোরি, দাঁত মাজলে রক্ত পড়ে, মুখে দুর্গন্ধ।
: দাঁত মোটামুটি ভালো কিন্তু জল খেলে বা চা খেলেই দাঁত কন কন করে। ঠান্ডা-গরম ছোঁয়ানো যায় না।
: নকল দাঁত ভালো ‘ফিট’ হয়নি। খাওয়া এবং কথা বলতে অসুবিধা। যথাযথ সাইজ এবং সেপ না হলে সেরামিক নকল দাঁত থেকেও চোয়ালে ব্যথা হতে পারে।

: দাঁতের মাড়ির লাগোয়া অংশে ক্ষয়ে যাওয়া, বিশেষ করে যারা উপর-নিচে ব্রাশিং না করে আড়াআড়ি ব্রাশিং করেন অথবা আঙুল দিয়ে গুঁড়ো পাউডার বা ছাই দিয়ে দাঁত মাজেন।
: সমস্ত দাঁত পড়ে গেলে মুখের উচ্চতা কমে যায়, মুখ কুঁচকে ছোট হয়ে যায়, পঞ্চাশ বছরের মানুষকে সত্তর বছরের বৃদ্ধ মনে হয়।
এই সমস্ত কারণ ছাড়াও বিশেষ কিছু অবস্থা দেখা যায় যা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। যেমন —
মুখের শুষ্কতা (Dry Mouth) —
মুখে লালা নিঃসরণের জন্য খাদ্য গলাধঃকরণ করতে সুবিধা হয় এবং এখান থেকেই পরিপাক ক্রিয়া শুরু হয়। লালা বা থুতু কিছুটা জীবাণুরোধক এবং দাঁত ও মাড়িকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করে। প্রায় ১৮০০ রকমের ঔষধি আছে যা লালা নিঃসরণ কমিয়ে দিতে পারে। যতই মুখের আদ্রতা কমে যায় ততই দাঁত ও মাড়ির রোগ বৃদ্ধি পায়। খুব ভয় পেলে (মঞ্চভীতি, পরীক্ষা হল), প্রচণ্ড দৌড়ঝাঁপ এবং অত্যধিক ধূমপান মুখের আর্দ্রতা কমায়। উচ্চ রক্তচাপের কিছু ওষুধ এবং ডায়াবেটিস, পারকিনসন, নার্ভের রোগের কিছু ওষুধ থেকে Dry Mouth হতে পারে। এই সময় কথা বলতে অসুবিধা হয়, খাবার গিলতেও সমস্যা হয়। শুষ্ক মুখে ভাইরাস বসতি স্থাপনে সুবিধা পায়। মুখের আর্দ্রতা বজায় রাখতে মাঝেমধ্যেই জলপান করা দরকার। কখনও বা কৃত্রিম স্যালাইভা ব্যবহার করা হয়।

মানুষের শরীরের নানান ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ (Xenobiotic) প্রবেশ করতে পারে ঔষধি, খাদ্যদ্রব্যের সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য থেকে। তড়কার (Epilopsy) জন্য ব্যবহৃত ডাইল্যান্‌চিন সোডিয়াম, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিফিডিমিন ও অ্যামলোডিপিন থেকে মাড়ি স্ফীত (Swelling) হতে পারে। খাদ্যদূষণ কিংবা জলদূষণ থেকেও শরীরে বিষাক্ত মলিকুল প্রবেশ করতে পারে। শৈশব এবং বার্ধক্যে এদের ক্ষতিকারক প্রভাব সব থেকে বেশি।

দন্ত শূন্যতা —
আর্থিকভাবে কমজোরি মানুষেরা দাঁত না থাকার সমস্যায় বেশি ভোগেন স্বচ্ছল মানুষের তুলনায়। এর থেকে বোঝা যায় সুস্থ মুখমণ্ডলের সাথে পুষ্টিকর খাবার, দাঁত ও মাড়ির যত্ন নেওয়া, সুচিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ এবং পরিবেশবান্ধব বাসস্থানে থাকার সম্পর্ক। প্রবীণ নাগরিকদের অন্তত ২০টি দাঁত থাকলে (মোট ৩২টির মধ্যে) বলা যায় কাজ চালাবার জন্য চলনসই। দাঁত না থাকার কারণ মূলত দুই প্রকার—
: দন্তক্ষয় রোগ বা দাঁতে গর্ত হওয়া। যা পিছনের দিকের বড় দাঁতগুলিতে বেশি হয়। আর্থিকভা‍‌বে স্বচ্ছল মানুষের এই রোগ বেশি হয়। পশ্চিমী দেশে দাঁত উৎপাটনের প্রধান কারণ এই ‘Dental Caries’। শুরুতেই ফিলিং করে এবং দেরি হলে R.C.T করে এই ক্ষয় রোগ থেকে দাঁত বাঁচানো যায়।

: মাড়ির রোগ, মুখের যত্নের অভাবে এই রোগ হয়। মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে, মাড়ি ফুলে যায়, মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং অবশেষে দাঁত নড়তে শুরু করে। প্রথম দিকে এই রোগের জন্য বিশেষ ব্যথা হয় না, তাই সময় মতো চিকিৎসা শুরু হয় না। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু হলে (Sealing) দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে যায়। আমাদের মতো দেশে দাঁত তোলার প্রধান কারণ এই মাড়ির রোগ যা দন্তমল (Tartar) জমার কারণে হয়।

এছাড়াও ভুল জি‍‌নিস দিয়ে ভুলভাবে দাঁত মাজার কারণে দাঁতের মাড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে প্রবল ব্যথা-যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে দাঁত তুলতে হয়। দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেক দাঁত ভেঙে যায় এবং মুখের টিউমার (Tumor) জনিত কারণে অনেক সময় দাঁত ফেলে দিতে হয়। ‘Tic dolorex’ বা ‘Trigeminal neuralgia’ এমন এক তীব্র যন্ত্রণাময় নার্ভের অসুখ যার কারণে প্রায় এক এক করে মুখের একদিকের সম্পূর্ণ সুস্থ দাঁতও তুলে দিতে হয়। এছাড়া কখনও বা চিকিৎসা বিভ্রাটের কারণেও দাঁত তুলে দিতে হয়।
শূন্যস্থান পূরণের জন্য, মুখের সৌন্দর্য এবং কাজকে অটুট রাখার জন্য নকল দাঁত ব্যবহার করতে হয়।



নকল দাঁত মূলত দু’প্রকার —
. খোলা যায়
. খোলা যায় না
বর্তমানে আরেক ধরনের দাঁত বসানো হচ্ছে হাড়ের মধ্যে ধাতব পোস্ট বসিয়ে (Implant)। এই পদ্ধতি যথেষ্ট প্রাচীন এবং সফল বিকল্প হিসাবে এখনও প্রতিভাত হয়নি। মুখের গঠন ও কাজকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে, বয়স্ক মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রেখে এবং অবশিষ্ট দাঁতকে ক্ষতি না করে পরিকল্পনা করা দরকার কোন মানুষের জন্য কোন ধরনের নকল দাঁত প্রতিস্থাপন করতে হবে।
বয়স্ক মানুষের মাংসপেশি এবং অস্থিতন্ত্র কমজোরি হওয়ার কারণে সব থেকে উপযোগী নকল দাঁত তৈরি হয় যথাক্রমে— —
. Acrylic : সহজলভ্য, সবচাইতে কম খরচ
. Gold : সবচেয়ে দামী, সব থেকে ভালো
. Steel : সহজলভ্য, কমখরচ
. Ceramic : সহজলভ্য, বেশি খরচ
দাঁত একবার তৈরি হয়ে গেলে আর নতুন করে ভালো করা যায় না, ওষুধ দিয়ে বা ক্যালসিয়াম খাইয়ে। তাই, প্রবীণ বয়সে দাঁতের সমস্যা এড়াতে শৈশব থেকেই দাঁতের যত্ন নিতে হবে। যে কোন ব্রাশ, যার মাথাটি প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা এবং দাঁড়াগুলি নাইলন ফাইবার দিয়ে তৈরি, টুথপেস্ট সহযোগে সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই মিনিট ধরে দাঁত মাজা দরকার।


দাঁতের স্বাভাবিক রং সামান্য হলুদের ছোঁওয়া লাগা সাদা। তাই দাঁত সাদা করবার জন্য বিশেষ কোনও পেস্টের উপযোগিতা নেই। আজকাল প্রচুর মানুষ দাঁতের কনকনানি ও ব্যথায় কষ্ট পান লাল রং-এর পেস্ট অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য। একই কারণে, ছাই, গুড়াকু কিংবা গুঁড়ো পাউডার ব্যবহার না করাই ভালো। ‍‌শিশুদের দাঁতের স্বাভাবিক রং দুধের মতো সাদা (Milk tooth)। বড়দের মতো হলদে ভাব নেই।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের বেশিরভাগই নানান শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত। যারা দীর্ঘদিন ধরে রক্ত তরল রাখার ওষুধ খান, দাঁত তোলার কমপক্ষে পাঁচদিন আগে সেই ওষুধ বন্ধ রাখতে বলা হয়। বয়স্ক মানুষ কি কি অসুখে চিকিৎসাধীন। কি কি ওষুধ খান, কোন ওষুধ বন্ধ রাখা যাবে না সেকথা বিবেচনায় রাখতে হয়। এই সমস্ত কারণে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে যুক্ত করা দরকার প্রবীণ মানুষের মুখমণ্ডলের বিশেষ রোগ ও তার নির্ণয় এবং চিকিৎসার পদ্ধতি। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডেন্টাল কাউন্সিলের সম্মিলিত উদ্যোগ একান্ত প্রার্থনীয় এই বিশেষ সমস্যার গভীরে ঢুকে লক্ষ লক্ষ প্রবীণ মানুষের দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষার কথা বিবেচনায় রাখতে। এইসব মানুষের বিশেষ চাহিদার কথা মাথায় রেখে, জনস্বাস্থ্য উন্নতির স্বার্থে বিশেষ ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষনের ধারাবাহিক আয়োজন করা দরকার সরকারি উদ্যোগে। এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় প্রয়োজন মতো ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের সভ্যদের এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে সজাগ, সচেতন এবং সাহায্য করার গুরুত্বপূর্ণ কাজে।

 

Comments :0

Login to leave a comment