নির্বাচনী রাজনীতি তথা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দেশে মার্কসবাদী তথা বামপন্থীদের শক্তি-সামর্থ্য নিতান্তই সামান্য। সাধারণ নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির নিরিখেও বেশিরভাগ দল থেকে মার্কসবাদী দলগুলি বহু যোজন পেছনে। বিপরীতে বর্তমান শাসক দল বিজেপি শক্তিতে, ভোট প্রাপ্তিতে এবং প্রভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল। এতদ্সত্ত্বেও মতাদর্শগতভাবে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তা এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের অনুসারীরা মার্কসবাদী তথা বামপন্থীদেরই প্রধান শত্রু বলে বিবেচনা করে। বিজেপি’র অভিভাবক আরএসএস-র পক্ষ থেকে বার বার এই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। নাগপুরে সঙ্ঘ পরিবারের সদর দপ্তর থেকে সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত গত বছরের মতো এবারও বিজয়া দশমী উপলক্ষে তাঁর বিশেষ ভাষণে মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁদের মতাদর্শগত লড়াইয়ের কথা পুনরুচ্চারণ করেছেন।
বিজেপি এবং মার্কসবাদীরা ছাড়া দেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু আরএসএস তাদের কাউকেই তাদের মতাদর্শগত শত্রু মনে করে না। তাই সেসব দলের বিরুদ্ধে ভোট রাজনীতির ও ক্ষমতা দখলের লড়াই চালালেও মতাদর্শগত লড়াইয়ের প্রয়োজন হয় না। কিছু কিছু বিষয়ে নীতিগত পার্থক্য থাকলেও বামপন্থীরা ছাড়া বাকি সব দলই বুর্জোয়া আদর্শে বিশ্বাসী। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থাকে বজায় রেখেই তারা সমাজে, অর্থনীতিতে, শিক্ষায় প্রসাধনী পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করে। বিজেপি-ও তাই। তবে বিজেপি সাধারণ কোনও বুর্জোয়া দল নয়। এই দল উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাঠামোয় বিশ্বাসী। মনুবাদী বর্ণাশ্রমকে আশ্রয় করে সমাজে বৈষম্য ও বিভাজনকে মান্যতা দেয়। নারীর সমানাধিকার অস্বীকার করে। হিন্দুত্ববাদী হিসাবে মুসলিম সহ অন্য সব ধর্মকে ঘৃণা করে, বিদ্বেষ ছড়ায়। ফ্যাসিস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পুরোপুরি একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি। তাদের লক্ষ্য শুধু হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় আচার সর্বস্বতা ও যুক্তিহীন কুসংস্করাচ্ছন্নতার জালে বন্দি করে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের চাষ করাও লক্ষ্য। যুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর ইতিহাসকে বাতিল করে মনগড়া হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় সমাজকে পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। অর্থাৎ আরএসএস’র পরিকল্পনায় ও ব্যবস্থাপনায় বিজেপি চায় সমাজে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণাটাকেই পালটে দিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনতে চায়। হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিষ্ঠা দিতে চায়।
মার্কসবাদীরাও সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা ও কাঠামোকে ভেঙে শোষণ-শাসন বর্জিত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরএসএস যা চায় মার্কসবাদীরা চায় ঠিক তার উল্টো। আপাতত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সুরক্ষা যেমন জরুরি তেমন ধর্ম-জাতপাত বর্ণভিত্তিক সব বিভাজনেরও নিরসন জরুরি। মার্কসবাদীরা চায় সব হাতে কাজ, সকলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সকলের বাসস্থান। সর্বোপরি আয় ও সম্পদ বৈষম্যের নির্মূলীকরণ। এই মতাদর্শগত জায়গাতেই আরএসএস’র সঙ্গে মার্কসবাদীদের চরম বৈপরীত্য। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসবাদীদের ধারণা জনমানসে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে আরএসএস মার্কসবাদীদের ভয় পায়। তাই মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মার্কসবাদীদেরই তাদের প্রধান মতাদর্শগত শত্রু মনে করে।
Fear of left ideology
বাম মতাদর্শে প্রবল ভয়
×
Comments :0