ভ্রমণ — মুক্তধারা
কেদারকন্ঠ ট্রেক:এক মেঘবরফের আশিয়ানার গল্প
অভীক চ্যাটার্জী
গত সংখ্যার পর
পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হলো কেদারকন্ঠ বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। এই দিনটি পুরো ট্রেকে সব চেয়ে সহজ দিন। কিন্তু, বরফ আর বরফগলা জলের কাদা মিশে এই রাস্তাকে করে তোলে ভয়ংকর বিপদসঙ্কুল। কিন্তু বাঙালী সমতলের জাত, বরফ দেখলে তার মনে পুলক জাগে, পেটে প্রজাপতি উড়তে শুরু করে। বরফের রাজ্যে স্বাগত জানায় আমাদের কেদারকন্ঠ।সেই কাদা বরফ পেরিয়ে যখন আমরা বেস ক্যাম্পে পৌঁছলাম, দুপুর গড়িয়ে গেছে। আমরা কিছু খাবার খেয়ে যখন তাবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম, আমার সামনে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে শৃঙ্গ কেদারকন্ঠ । বরফের আতিশয্যে ভরপুর আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে তাকে দেখার আর তাকে জানার জন্যে। আমরা দুজন একটু বিশ্রাম করতে তাবুতে ঢুকলাম। রাত দুটো নাগাত আমরা বেরোবো শৃঙ্গজয়ের উদ্দেশ্যে। আজ তো পূর্ণিমা!
রাত তখন ২টো বাজে, আমি প্রথম উঠলাম এবং তাবুর বাইরে যখন এলাম, আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার সামনে সেই চেনা কেদারকণ্ঠের একি অচেনা রূপ! সাদা বরফে খেলা করছে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। আর সে চাঁদের আলোয় যেন কেউ দুধ ঢেলে দিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। সার্থক কেদারকন্ঠ। সার্থক তোমার রূপ লাবণ্য। আমাদের সামিট যাত্রা শুরু হলো রাত ৩টে নাগাত। আমরা সেই বরফের রাজ্য ঠেলে এগিয়ে চললাম। সাথে পূর্ণিমার চাঁদ আর রাশি রাশি বরফে খেলে বেড়ানো চাঁদের আলো। রাস্তা দুর্গম। মাথার হেডল্যাম্পের আলোয় পথ দেখে চলতে হয়।খাড়া চড়াই রাস্তা রুধে দাঁড়ায়। আমরা এগিয়ে যাই ধীর পায়ে। শেষ ১ কিমি বড়ই কঠিন। পাহাড়ের খাঁজে পা রেখে রেখে চলতে হয়। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পথ শেষ হয় না। একসময় পথ শেষ হয়। সূর্য ওঠে। আমরা তখন কেদারকন্ঠ শৃঙ্গচূড়ায়। চূড়া থেকে দেখা সূর্যোদয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। চারদিকে বরফে ঢাকা হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গ – স্বপ্নে দেখা এক ছবি যেন বাস্তব হয়ে উঠেছিল। হর কি দুন, স্বর্গরোহিণী, ব্ল্যাক পিক আর আরও অনেক শৃঙ্গ চোখের সামনে! মন ভরে যায় অপার সৌন্দর্যে।
ফিরে আসার পথে আবার সেই পাইন বন, বরফে ঢাকা পথ, আর মনে রয়ে গেল অসংখ্য স্মৃতি। কেদারকন্ঠ শুধু একটা ট্রেক নয়, এটা ছিল নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার, প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার, আর জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
সমাপ্ত
Comments :0