অসভ্য বর্বর সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন আর দুয়ারে নয়, সরকারে ক্ষমতাসীন। শুক্রবার জ্যোতি বসু সমাজ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের ভবন উদ্বোধন করে সতর্ক করলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। তিনি বলেছেন, জ্যোতি বসু যাদের বর্বর বলেছিলেন তারা তখন দুয়ারে ছিল, এখন তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বকে রাষ্ট্রে বসাতে চাইছে তারা। বেঁচে থাকলে এখন জ্যোতি বসুই এই অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষা আজকে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এদিন জ্যোতি বসু নগরে (নিউটাউন) জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে রাজ্য নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও সমাজের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টরা, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির ও কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ এবং জ্যোতি বসুর অনুরাগীরাও অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও। প্রকাশ কারাত এবং সেলিম আশা প্রকাশ করেছেন, জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে সমাজচর্চা ও গবেষণা শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে রসদ জোগাবে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরি বন্যা সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও রেখেছেন তিনি। সভাপতিত্ব করেছেন জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি বিমান বসু। ঠিক এক বছর আগে বিগত ১৭ জানুয়ারি এই ভবনের শিলান্যাস করেছিলেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। এদিন বক্তারা প্রয়াত কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি ও কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অভাব অনুভব করার কথা বলেছেন সশ্রদ্ধ চিত্তে।
উদ্বোধনী ভাষণে প্রকাশ কারাত বলেছেন, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে জ্যোতি বসু প্রতীক হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব। বিলেত থেকে ফিরে তিনি রেলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন, তারপরে শুধু কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসারের জন্যই অবদান রাখেননি, আইনসভায় শ্রমজীবী আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারে এবং তারপরে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতিতে অবদান রেখে গিয়েছেন।
আজকের দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতি বসুর বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করে প্রকাশ কারাত বলেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে জ্যোতি বসু যাদের বর্বর বলেছিলেন, তারা এখন আর দুয়ারে নেই, সরকারে আসীন। তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াইতে, যুক্তিহীন অন্ধপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াইতে জ্যোতি বসু দিশারি।
জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রকাশিত প্রথম দু’টি মনোগ্রাফের এবং জ্যোতি বসুর স্মারক ডায়েরি এদিন আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন প্রকাশ কারাত। ‘ইকনমিক ডেপ্রিভেশন ইন রুরাল ওয়েস্ট বেঙ্গল: কনট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাজেকটরি’ এবং ‘লুমিং ক্রাইসিস অব লাইভস অ্যান্ড লাইভলিহুড: এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড আনএমপ্লয়মেন্ট ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামের দু’টি মনোগ্রাফ প্রকাশ করা হয়েছে জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে। ঈশিতা মুখার্জি, জয়দীপ সরকার ও সোহম ভট্টাচার্য মনোগ্রাফ দু’টি তুলে দিয়েছেন কারাতের হাতে। ঈশিতা মুখার্জি জানিয়েছেন, কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার যখন তথ্য ধামাচাপা দিচ্ছে, তখন বিপুল তথ্য সঙ্কলিত করে বই দু’টিতে দেখানো হয়েছে গ্রামবাংলার অর্থনীতি বহুস্তরে কীভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং রাজ্যে কর্মহীনতা ও কর্মসংস্থানের বেহাল অবস্থা মানুষের জীবনকে কীভাবে দুর্বিষহ করে তুলছে। এই প্রসঙ্গে কারাত বলেছেন, জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত এই কেন্দ্রের এমন গবেষণাধর্মী কাজ শ্রমজীবীদের আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
মহম্মদ সেলিম সভায় বলেছেন, প্রতিদিনের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করতে জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে সমাজ চর্চা কাজে লাগবে। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিশ্ববীক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা চর্চায় জোর দিতেন। আমাদের দেশে এবং প্রতিবেশী দেশেও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত হচ্ছে, এখন আমাদের আরও গভীরে গিয়ে এইরকম চর্চার প্রয়োজন আছে। আমাদের এখানকার কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান-সব বিষয়ে সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে ৩৪ বছর ধরে গবেষণায় জোর দেওয়া হয়েছিল। এখন শুধু সরকারি কিছু চকচকে বাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবই ভেঙে পড়েছে। আমরা শুধু বাইরের পরিকাঠামো নয়, জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে জ্ঞানচর্চাতেও উদ্যোগ নিয়েছি।
এদিন সভার শুরুতে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনার পরে রেজওয়ানা চৌধুরি বন্যা বলেছেন, শান্তিনিকেতনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষার সূত্রে আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নাড়ির সম্পর্ক। জ্যোতি বসুর সঙ্গে যখন সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল, তখন তিনি উৎসাহ নিয়ে আমার কাছে ঢাকার খবর জানতে চেয়েছিলেন, আমাকে ছোটোবেলার স্মৃতির কথাও বলেছিলেন। তাঁর নামাঙ্কিত সামাজিক শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি অভিন্ন এবং সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এই পরিচয় আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করুক।
বিমান বসু বলেছেন, জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব উত্থাপন করে সল্টলেকের নাম রেখেছিলেন বিধাননগর। ২০১০ সালের জ্যোতি বসুর প্রয়াণের পর নিউটাউনের নাম রাখা হয়েছিল জ্যোতি বসু নগর। কারণ আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পরামর্শ ক্রমে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই উপনগরী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পরে সেই নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই নিউটাউনের নাম জ্যোতি বসু নগরই করা হোক, এর জন্য জনমত চাই, আমরা ফের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই দাবি জানাবো।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদজ্ঞাপন করে জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের সম্পাদক রবীন দেব নির্মাণ কাজের জন্য প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, এবং সাহায্যকারী সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি একথাও বলেছেন, এই কেন্দ্রের পাশের মেট্রো স্টেশনের নাম জ্যোতি বসুর নামে করার জন্যও বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু অনুরোধ সহকারে চিঠি পাঠিয়েছেন।
এদিন অনুষ্ঠানের শুরুতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা এবং রিয়া, রাহুল ও দিগন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে অনাদি সাহু ও সুভাষ মুখার্জি জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের তহবিলে ২ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন বিমান বসুর হাতে, কর্মচারী আন্দোলনের নেতা দিলীপ দাশ ১ লক্ষ টাকা সাহায্য করেছেন। ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে সিপিআই(এম)’র দক্ষিণ দমদম এরিয়া কমিটি, ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। এছাড়াও অনেকে অর্থ সাহায্য করেছেন কেন্দ্রটির নির্মাণে সহযোগিতা করে। দুর্ঘটনায় প্রয়াত একমাত্র পুত্র অভিষেক মণ্ডলের বাবা বিদ্যুৎ মণ্ডল ও মা জয়শ্রী মণ্ডল আগেই জ্যোতি বসু কেন্দ্রের জন্য ১০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন, তাঁরাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
Comments :0