চন্দন দে
না, সেদিন কিন্তু কেউ জানতে চায়নি, বছর দশের ফারহিনের ধর্ম কী ছিল? বড়া পাও কিনতে বেরিয়ে বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল ওর শরীরটা, রমজান মাসের ভরসন্ধ্যায় সন্ত্রাসবাদীরা নিশ্চয়ই মুসলিম নিবিড় মহল্লায় আরডিএক্স ভরা মোটরসাইকেল ‘হিন্দু বেছে’ মারতে রেখে যায়নি! গত বৃহস্পতিবার রায় বেরোনোর পর অবশ্য একাংশ গলা ফাটাচ্ছে, আদালত তো বলেই দিল হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদ বলে কিছু নেই।
মোটেই নয়, আদালত মোটেই একথা বলেনি। হ্যাঁ, আদালত বলেছে, ‘নিঃসন্দেহে, সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম নেই, কারণ পৃথিবীর কোনও ধর্মই হিংসার শিক্ষা দেয় না।’ ঠিকই তো, পহেলগাম হোক বা পুলওয়ামা কিংবা হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ, সমঝোতা এক্সপ্রেস হোক বা মালেগাঁওতে দু’-দু’বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেওয়া তো কোনও ধর্মের কাজ হতে পারে না। ওগুলো সবই সন্ত্রাসবাদীদের কাজ। কিন্তু বোমা ফাটলেই দাড়ি আর নমাজি টুপি খোঁজো— এই ধারণাটা যে গেঁথে দেওয়া গেছে এদেশের মনে। সন্ত্রাসবাদের ধর্ম নেই, সন্ত্রাসবাদীর তো আছে!
তাই মালেগাঁওর বিস্ফোরণের পর ধরপাকড় শুরু হয় মুসলিম যুবকদের। পরবর্তী সময়ে তদন্তের মোড় ঘুরে যায়— যখন হেমন্ত কারকারের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত, স্বামী অসীমানন্দ, দয়ানন্দ পান্ডে সহ একাধিক ব্যক্তির নাম সামনে আসে।
একটা নয়, মালেগাঁওতে দুটো বিস্ফোরণ
যে ২০০৮-র বিস্ফোরণ মামলায় প্রজ্ঞাদের ‘বেকসুর খালাস’ পাওয়া নিয়ে এত হাওয়া গরম হচ্ছে তা ছাড়াও মালেগাঁও আরও একটি বিস্ফোরণ হয়েছে, ২০০৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। শব-এ-বারাতের রাতে মসজিদের বাইরে রাখা সাইকেল বোমা ফেটে সেবার ৩৭জনের মৃত্যু হয়েছিল। জখম শতাধিক। ২০০৮-র থেকে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি ছিল। সেবারও দ্রুত ধরপাকড়ে শতাধিক মুসলিম যুবককে তোলা হয়। সিবিআই, এনআইএ’র তদন্তে এই বিস্ফোরণে প্রজ্ঞা-পুরোহিতদের অভিনব ভারতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। তথ্য প্রমাণ দুর্বল করে এই মামলাও ভোঁতা করে দেওয়া হয়েছে। তবে নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। টেকনিক্যালি এখনও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত বিজেপি’র প্রাক্তন সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর বা সেনা কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত।
গভীর ষড়যন্ত্র, কিন্তু প্রমাণ তো চাই
অভিযোগ থাকলেই তো হবে না, প্রমাণ দিতে হবে। সেদিন রায়েও ‘গভীর ষড়যন্ত্রের’ কথা বলেছে আদালত। ১০৩৬ পাতার রায়ে বিচারপতি এ কে লাহোটি বলেছেন, ‘আমি সম্পূর্ণভাবে অবগত, এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি না দেওয়ার ফলে সমাজের সর্বস্তরে এবং বিশেষ করে নিহতদের পরিবারগুলির উপর গভীর যন্ত্রণা, হতাশা ও মানসিক আঘাত নেমে এলো। তবে, শুধুমাত্র নৈতিক বিশ্বাস বা সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আদালত তো কোনও অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না— আইন তা অনুমোদন করে না।’ লাহোটিয়া রায়ে স্পষ্টই বলেছেন, ভূমিকা যথেষ্টই সন্দেহজনক, কিন্তু সরকার অভিযোগগুলি জোরালো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ‘বেকসুর খালাস’ হয়ে গিয়েছে প্রজ্ঞা ঠাকুর, শ্রীকান্ত পুরোহিতরা। ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদী দিল্লির গদিতে বসার পর একে একে এমন সকলেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছে।
মালেগাঁও এবং জবানবন্দি গায়েব
মালেগাঁও এত কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই বিস্ফোরণকাণ্ড শুধু সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত তদন্তের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেয়নি, বরং ভারতের রাজনৈতিক এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এটাই ছিল প্রথম বড় ঘটনা যেখানে হিন্দুত্ববাদী কট্টরপন্থাকে সন্ত্রাসবাদ হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্তরে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আর এই সেই বিচারপর্ব, যেখানে মূল নথির খোঁজ নেই, হারিয়ে গিয়েছে সাক্ষীদের আসল জবানবন্দিও। ১৬৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দেওয়া সাক্ষীদের আসল জবানবন্দি পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারপক্ষ। সেইসঙ্গে, প্রমাণ হিসাবে বিকল্প বা সেকেন্ডারি কপি জমা দেওয়ার প্রচেষ্টাতেও গাফিলতি ছিল।
এটিএস তদন্ত চলাকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৩ জন সাক্ষীর ১৬৮ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি গায়েব হয়ে যায়। এরা সকলেই প্রায় জানিয়েছিল, কোন গোপন বৈঠকে কাদের কাদের শলায় ঠিক হয়েছিল মালেগাঁও, মক্কা মসজিদ বা সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণের ছক। পরে মোট ৩৯ জন সাক্ষী বিপক্ষে ঘুরে যান। কিন্তু ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে আদালতের নথি থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ দলিল নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। কিছু ফোটোকপি পাওয়া গেলেও আদালত আর সেগুলিকে প্রমাণ হিসাবে মেনে নিতে চায়নি।
প্রশাসনের ‘নরম মনোভাব’ ও মামলা দুর্বল
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পর থেকে এই মামলার গতিপ্রকৃতিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তদন্ত, প্রমাণ উপস্থাপন, সাক্ষীদের জবানবন্দি— সব কিছুতেই ধীরে ধীরে একপ্রকার শিথিলতা ও পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে থাকে। ভয়ানক চাপ ছিল তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ’র উপরে।
সেদিন রায়ের পরে আর হতাশা চেপে রাখতে পারেননি এই মামলায় দীর্ঘ সময়ের সরকারি আইনজীবী ছিলেন রোহিনী সালিয়ান। ‘‘এমনটা যে হবে জানাই ছিল। যদি প্রকৃত প্রমাণ না দেওয়া হয়, তাহলে কী রায় আশা করা যায়? আদালতে চূড়ান্ত প্রমাণ আইনজীবী হিসাবে আমি উপস্থিত করিনি। আমাকে ২০১৭ সালে এই মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে আমি অজস্র প্রমাণ উপস্থিত করেছিলাম এবং সুপ্রিম কোর্ট সেগুলি গ্রহণ করেছিল। সেই প্রমাণগুলি কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল?’’ প্রশ্ন তুলেছেন রোহিনী সালিয়ান।
প্রশ্ন আগেও তুলেছেন এনআইএ’র আইনজীবী রোহিনী। জানিয়েছিলেন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বাঁচাতে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে তাঁর উপর। ‘ওপরমহলের নির্দেশ’ বলে এনআইএ তাঁর উপর চাপ তৈরি করছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এক এন আই এ আধিকারিক ওই আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত হিন্দু নেতাদের প্রতি তিনি যেন নরম মনোভাব দেখান।’ হুমকিতে কাজ না হাওয়ায় ২০১৬-এ রোহিনীকেই এই মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর সে বছরই জামিনই শুধু নয়, গোমূত্র খেয়ে ক্যানসার সারিয়ে ফেলা ‘অসুস্থ’ প্রজ্ঞা আদালতে হাজিরা থেকেও অব্যাহতিও পেয়ে যান। একে একে সবাই জামিনও পেয়ে যায়। এবিভিপি করে প্রবচন দিয়ে বেড়ানো প্রজ্ঞা অবশ্য ততদিনে ভোপাল থেকে সংসদে চলে গিয়েছেন।
চাপ রেখে যাওয়া হয়েছে শেষ দিন পর্যন্ত। শুনানি শেষের পরই বদলি করে দেওয়া হয়েছে বিশেষ আদালতের বিচারপতিকে। এমনকি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক মালেগাঁওয়ের রায়ের আগের দিন সংসদে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছুঁড়েছেন, ‘কোনও হিন্দু সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না।’ কাকে বার্তা পাঠালেন ‘ক্রোনোলজিস্ট’ অমিত শাহ! এদেশে তো কেউই চায় না বিচারপতি এ কে লাহোটিরও পরিণতি বিচারপতি লোয়ার মতো হোক।
ষড়যন্ত্রের গভীরতা এবং কুশীলব
১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাত জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছিল। এবিভিপি’র একসময়ের নেতা প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার আধিকারিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত, সমীর কুলকার্নি, রমেশ উপাধ্যায়, অজয় রাহিরকার, সুধাকর দ্বিবেদী ও সুধাকর চতুর্বেদী। সকলেই অভিনব ভারতের সঙ্গে জড়িয়েছিল।
চার হাজার পৃষ্ঠার চার্জশিটে বলা হয়েছিল, মালেগাঁওতে ঠাকুর, পুরোহিত এবং স্বামী দয়ানন্দ পান্ডে ছিলেন মূল চক্রান্তকারী। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, মালেগাঁও সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র ২০০৮ সালের ২৫-২৭ জানুয়ারি, পুরোহিত, উপাধ্যায়, কুলকার্নি, চতুর্বেদী এবং অমৃতানন্দ দেব তীর্থ ওরফে দয়ানন্দ পাণ্ডে ফরিদাবাদের কাছে এক জায়গায় বসে ঠিক করেছিল। ২০০৮ সালের ১১-১২ এপ্রিল, এরা ভোপালে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে। বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য মুসলিম নিবিড় মালেগাঁও বেছে নেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ৩ আগস্ট, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরের এক ধর্মশালায় এক বৈঠকে, আরডিএক্স সংগ্রহের দায়িত্ব পুরোহিতকে দেওয়া হয়। প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের ছিল বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য লোক সরবরাহের দায়িত্ব। নেন। সেবছরের ১১ জুন, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর রামচন্দ্র কালসাঙ্গরা ও সন্দীপ ঢাঙ্গেকে অমৃতানন্দ দেব তীর্থে ওরফে দয়ানন্দ পাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মালেগাঁওতে বোমা রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই দুজনকে। জুলাই মাসের শুরুতে,প্রজ্ঞা পাণ্ডেকে বলেন পুরোহিতকে নির্দেশ দিতে যাতে তিনি পুনেতে কালসাঙ্গরা ও ডাঙ্গেকে “বিস্ফোরক পৌঁছে দেয়”।
এরপর পুরোহিত আইইডি এক্সপার্ট রাকেশ ধাওয়াদেকে বলেন পুনেতে গিয়ে কালসাঙ্গরা ও ডাঙ্গেকে বিস্ফোরক সরবরাহ করতে। সেখানে তাদের ৯ ও ১০ আগস্ট দেখা হয়েছিল। এসব কথা পাণ্ডে সহ অনেক অভিযুক্তই কবুল করেছে।
পান্ডের পরামর্শেই পুরোহিত সেনাবাহিনী থেকে ৬০ কেজি আরডিএক্স চুরি করেন, যার কিছুটা ব্যবহৃত হয়েছে মালেগাঁওয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে। অভিনব ভারতকে অর্থ জোগানো, বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও করেছিলেন পুরোহিত। বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের। বিস্ফোরণের পরে মধ্য প্রদেশের পাঁচমারিতে সেনা প্রশিক্ষণ কলেজে ছিলেন পুরোহিত। তাঁর সঙ্গে পান্ডের কথোপকথন পুলিশের নজরে আসে। সেইমতো তদন্তে এগিয়ে তারা মালেগাঁওয়ে পুরোহিতের যোগাযোগ টের পায়। পুরোহিতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অসীমানন্দ আর ইন্দ্রেশ কুমার
সাভারকরের তৈরি ‘অভিনব ভারত’ নতুন করে তৈরি ওই শ্রীকান্ত পুরোহিতের হাতেই। তদন্তে মহারাষ্ট্র এটিএস ও পরে এনআইএ সকলের বিরুদ্ধেই মালেগাঁও ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার প্রমাণ পেশ করেছিল। চার্জশিটে জানানো হয়েছিল, মালেগাঁও বিস্ফোরণের ছক সাজাতে গোপন ষড়যন্ত্রে সমঝোতা বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্ত অসীমানন্দ ছিল। প্রজ্ঞা ঠাকুরের সঙ্গে সেই বৈঠকে সেনাকর্তা কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিতও হাজির ছিল। ২০০৭ সালের দিকে হরিদ্বার ও ইন্দোরে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন অভিনব ভারতের সদস্যরা এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। এসব বৈঠকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধমূলক জিহাদ’-এর রূপরেখা তৈরি হয়, যার অংশ হিসাবে মালেগাঁও, হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ, আজমের শরিফ, ও সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণের পরিকল্পনা হয়েছিল।
বিচারপর্বে তিস হাজারি আদালতে দাঁড়িয়ে ওই অীমানন্দ ওরফে নবকুমার ওরফে যতীন সরকারের জবানবন্দিই চমকে দিয়েছিল গোটা দেশকে। ২০১৪-র পর যদিও সেই জবানবন্দি গায়েব হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্বীকারোক্তিতে কী জানিয়েছিল পাঁচ-পাঁচটি সন্ত্রাসবাদী হামলায় ১১৯ জন মানুষ মারার মূল অভিযুক্ত? একসময়ে যার আশ্রমে ঘন ঘন যাতায়াত ছিল গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা আজকের প্রধানমন্ত্রীর। এহেন অসীমানন্দ আদালতে দাঁড়িয়েই কবুল করে নেন, দেশজুড়ে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থানে বিস্ফোরণে তার ও তার দলবল জড়িত। আদালতে দাঁড়িয়েই উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুখ জাহির করেছিল, এগুলি সবই ঘটানো হয়েছিল ‘মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী’ কার্যকলাপের প্রতিশোধ নিতে। ২০১০ আদালতে দেওয়া তার কবুলনামা থেকেই দেশ জেনেছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদী জালের কথা। ১৯৭৮-এ কামারপুকুরের যে নবকুমার সরকারের হাতে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির জঙ্গলে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের সূচনা, গুজরাটের ‘ঘর ওয়াপসি’ চালানো সেই সঙ্ঘী নাম বদলে অসীমানন্দ। সমঝোতা এক্সপ্রেসের ১ নম্বর অভিযুক্ত, হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণে ৩ নম্বর এবং আজমেঢ় দরগায় বিস্ফোরণ কাণ্ডে ৬ নম্বর অভিযুক্ত। মালেগাঁও বিস্ফোরণে নাম উঠলেও চার্জশিটে তার নাম ঢোকেনি।
তারপর আদালত বদলেছে, তদন্তকারী সংস্থা বদলেছে, কেন্দ্রেও বদলেছে সরকার। পাঁচকুলার বিশেষ আদালত সমঝোতা বিস্ফোরণের ঘটনায় বেকসুর খালাস করে দিয়েছে সেই অসীমানন্দকেই। ঠিক যেমন ২০১৭’র মার্চে আজমেঢ় দরগায় বিস্ফোরণ, আর তার এক বছর পর ২০১৮’র এপ্রিলে হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণের দায় থেকে মুক্ত হয়েছিল একসময়ে ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতি বারো মাস অন্তর এক একটা নাশকতার মামলায় ছাড়া পেয়েছে ৬৭ বছর বয়সি এই সঙ্ঘী সন্ত্রাসবাদী। ২০০৭ সালে দেশের নানা প্রান্তে এই বিস্ফোরণগুলি ঘটানোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল অসীমানন্দ। জানায়, অক্ষরধাম হামলার পরই নাকি একের পর এক বিস্ফোরণের ছক কষেছিল অসীমানন্দ ও তার দলবল। তাই বিস্ফোরণ সমঝোতা এক্সপ্রেস, হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ থেকে আজমেঢ় দরগায়। আম্বালা জেলে গোপাল গডসের সেলে কাটানো অসীমানন্দ গর্বের সঙ্গে ইন্টারভিউতে বলতে পারে, ‘লোগো মেঁ হিন্দুত্ব কা ভাব আয়েগা’- এসব ঘটনা মানুষের মধ্যে হিন্দুত্বের ভাবধারা জাগিয়ে তুলবে। গান্ধীর খুনি নাথুরামের ভাই গোপাল গডসেকে ওই খুনের ষড়যন্ত্রের সাজা কাটাতে হয়েছিল আম্বালার ওই সেলে।
২০০৭ সালে ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অসীমানন্দের নিজের বয়ান অনুযায়ী গুজরাটের ডাঙে শাবরি ধাম আশ্রমে বসেই ইন্দ্রেশ কুমাররা তাদের ‘বোমার বদলে বোমা’র তত্ত্ব রূপায়ণের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন। ২০০৫-এর জুলাইয়ে সেই গোপন শলায় একা ইন্দ্রেশ কুমার নয়, সঙ্গে মোহন ভাগবতও ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন অসীমানন্দ। গুজরাটে তৎকালীন নরেন্দ্র মোদীর সরকারের অর্থ আনুকুল্যে এই আশ্রমেই ২০০৬-এর ফেব্রুয়ারিতে এই সুবির গ্রামেই বসেছিল শাবরি কুম্ভ। অসীমানন্দর স্পষ্ট জবানবন্দি ছিল, ‘ইন্দ্রেশ কুমার আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতেন।’
ষড়যন্ত্র বৈঠকগুলিতে আরএসএস শীর্ষ নেতা ইন্দ্রেশ কুমারের হাজির থাকার তথ্য অন্য অভিযুক্তরাও ফাঁস করেছিল। এরকম সব বৈঠকের অডিও-ভিডিও রেকর্ড করতো। আরেক অভিযুক্ত সুধাকর দ্বিবেদী ওরফে স্বঘোষিত ধর্মগুরু দয়ানন্দ পান্ডে। তার ল্যাপটপ আর ডিজিটাল ডায়েরি থেকে এই নেটওয়ার্কে ইন্দ্রেশ কুমারের যোগ পাওয়া যায়। সঙ্গে বেশ কিছু জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে জয়পুরে ও ২০০৮ সালে ফরিদাবাদে গোপন দুই বৈঠক হয়েছিল, যেখানে ইন্দ্রেশ কুমার উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন প্রজ্ঞা, পুরোহিত, দয়ানন্দরা।
অসীমানন্দের দাবি অনুযায়ী, ২০০৫-এর জুলাইয়ে আরএসএস-এর সুরাট কনক্লেভের ঠিক পরেই সঙ্ঘের তাবড় বেশ কিছু বড় নেতা ডাঙে এসেছিলেন তাঁর কাছে। ইন্দোরের সঙ্ঘ প্রচারক সুনীল যোশীর সঙ্গে সেদিন মোহন ভাগবত ও ইন্দ্রেশ কুমার ছিলেন। সেখানেই সঙ্ঘের মাথারা মুসলিমদের টার্গেট করে বিস্ফোরণে গ্রিন সিগন্যাল দেন। বলেছিলেন, ‘আপনার চালিয়ে যান। এনিয়ে সুনীলের সঙ্গে কাজ করুন।’ অভিনব ভারতের সব নাশকতায় সুনীল যোশীর নাম এসেছে। ২০০৭-এর শেষদিকে অবশ্য মধ্য প্রদেশের দেওয়াসে খুন হয়ে যান সুনীল।
কোন অদৃশ্য হাত?
একাধিক স্বীকারোক্তিতে ইন্দ্রেশ কুমারের নাম থাকলেও কখনোই তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়নি। এমনকি ডেকে ঠিকঠাক জেরাও করা হয়নি। বরং ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’ শব্দবন্ধকে বিজেপি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ তকমা দিয়ে দেয়। মোদী-শাহরা একে ‘হিন্দু ধর্মকে কলঙ্কিত করার ষড়যন্ত্র’ বলে চালাতে চান। তাই এক নীতিগত, আদর্শগত সুরক্ষায় ঘেরা থাকে অভিযুক্তরা। হারিয়ে যায় জবানবন্দি। এনআইএ আর সরকারী আইনজীবীদের উপর থাকে ‘ওপরওয়ালার চাপ’।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র আওড়ানো ‘প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাসী’ মোদী যেমন গোধরার ‘প্রতিশোধ নিতে’ গুজরাট গণহত্যার সময় পুলিশকর্তাদের নির্দেশ দেন, “হিন্দুদের রাগ মেটাতে দিন। মুসলমানদের ‘পাঠ পড়াতে’ দিন। আগামী তিন দিন পুলিশ যেন হস্তক্ষেপ না করে।” প্রাক্তন আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটের হলফনামায় তো এমনটাই উল্লেখ ছিল।
‘মিলিটারি ডিউটি’ ও সঙ্ঘ প্রধানকে গ্রেপ্তারের ছক
আদালতের গত বৃহস্পতিবারের রায়ে দুটি দিক লক্ষণীয়। ফরিদাবাদের ষড়যন্ত্র বৈঠকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কর্তা কর্নেল পুরোহিত ‘মিলিটারি ডিউটি’ পালন করতে গিয়েছিলেন, এই তত্ত্ব একেবারেই খারিজ করে দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে সঙ্ঘপ্রধান গ্রেপ্তারের ছক হচ্ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে তাও উড়িয়ে দিয়েছে। মহারাষ্ট্র এটিএস’র এক প্রাক্তন অফিসার দাবি করেন যে, তাঁকে নাকি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৎকে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছিল, যাতে ‘গৈরিক সন্ত্রাসবাদের’ তত্ত্ব তুলে ধরা হয়।
গত বৃহস্পতিবার অবশ্য এনআইএ আদালত ১০৩৬ পৃষ্ঠার রায়ে এই দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হিসাবে খারিজ করে দিয়েছে। বিচারপতি এ কে লাহোটি বলেন, এমবিপিটিসি ৩১৩ ধারায় (ফৌজদারি দণ্ডবিধি) এর বিবৃতি মামলা সম্পাদনে স্বীকৃত হতে পারে না, কারণ সেই শুনানি আদালতে এর পর্যালোচনা হয়নি, ওই আধিকারিকের সাক্ষ্যও নেওয়া হয়নি।
কালসাঙরা আর ডাঙ্গে কোথায়?
মুম্বাই পুলিশের এসিপি মোহন কুলকার্নি অব্যাহতভাবে জোর দিয়েছেন, কাউকে মোহন ভাগবৎকে গ্রেপ্তার করার জন্য পাঠানো হয়নি; বরং এটিএস’র ওই অফিসরাকে শুধুমাত্র পলাতক অভিযুক্ত রামজী কালসাঙরে ও সন্দীপ ডাঙ্গের খোঁজেই পাঠানো হয়েছিল। সে কাজ করে উঠতে পারেনি এটিএস’র ওই আধিকারিক। এই মামলার ওই দুজনকে খুঁজে না পাওয়াই একটা বড় রহস্য।
উল্লেখ্য, সিবিআই এবং এনআইএ’র ‘ঘোষিত ফেরার’ কালসাঙরা এবং ডাঙ্গেকে গ্রেপ্তার অথবা তাদের সম্পর্কে যে কোনও তথ্য দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই ১০লক্ষ টাকা করে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। মালেগাঁও বিস্ফোরণের দুই ‘ফুট সোলজার’-এর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসও জারি করা রয়েছে।
এইসব মামলায় ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ২০১৪-র পর ইচ্ছাকৃতভাবে এটিএস’র কাজকে খাটো করা হয়েছে। হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তকারী তথা ২৬/১১ মুম্বাই হামলায় নিহত হেমন্ত কারকারকে বিজেপি নেতারা মৃত্যুর পরেও অপমান করতে থাকেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মোদী যখন সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত প্রজ্ঞাকে প্রার্থী করেছিলেন সেই ভোটের প্রচারে প্রজ্ঞার ছিল সেই বিস্ফোরক মন্তব্য, ‘ওকে বলেছিলাম, তোমার নাশ হবে। ও মরেই গিয়েছে আমার অভিশাপে।’ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত মোদীর ‘মন কি বাত’ শোনা যায়নি তখন।
‘গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ কি আইনের উর্ধ্বে?’
মালেগাঁও মামলাগুলি ভারতীয় গণতন্ত্রের সামনে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে— ‘গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ কি আইনের উর্ধ্বে?’ একটা আদর্শভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যখন সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে এবং সেসব অভিযোগ তদন্তে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না পায়, তখন বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা কি প্রশ্নের মুখে পড়ে না? শুধু অপরাধ নয়, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিও এক সামাজিক ক্ষতের জন্ম দেয়।
গোটা ব্যবস্থার নীতিগত পচন
প্রশ্ন একটাই— একে কী বিচারব্যবস্থার ধীরগতি বলব, না ইচ্ছাকৃতভাবে বিচারকে অস্বীকার করার কৌশল?
যখন কোনও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত বা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পর্যন্ত হয় না, তখন তা বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
এ শুধুই বিচারের নামে প্রহসন নয়, গোটা ব্যবস্থাটারই নীতিগত পচন। বাজপেয়ীর সময়ে যা শুরু করেও পারেনি। তারপর লাগাতার লেগে থেকে প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার গোটা রাশটাই সঙ্ঘের হাতে চলে গেছে। মোদী এসে সেই বৃত্তটাকে সম্পূর্ণ করছেন। শুধু কি মগজে? গোটা ব্যবস্থাটার মধ্যেই ঢুকে পড়ছে আরএসএস। নিয়ন্ত্রণ করছে। পরিণতি দেখাই যাচ্ছে।
দায়মুক্তির সংস্কৃতি: মতাদর্শের মোড়কে সন্ত্রাস
ইন্দ্রেশ কুমারের মতো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সন্ত্রাস সংশ্লিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে মালেগাঁও মামলা রয়ে যাবে এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত হিসাবে— যেখানে সন্ত্রাসবাদ, যদি তা গেরুয়া ছায়ায় ঢাকা থাকে, তাহলে তাকে রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষা করা, চাপা দেওয়া এমনকি পুরস্কৃত করাও সম্ভব। একটি প্রকৃত গণতন্ত্রে তো আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। সংখ্যাগুরু মতাদর্শ বা শাসক দল— কোনও অবস্থাতেই তারা পরীক্ষা ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
Comments :0