চন্দন দাস
সবরমতী নদী যেন সীমান্ত ছিল।
নদীর একদিকে বস্তি। ছোট ছোট, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট বাড়ি। নদীর ওপারে, সেতু পেরোনর পর অন্য জীবন। হাইরাইজ। সিনেমা হল। ঝকঝকে রাস্তা। আলো।
নদীর দু পাড়ে দুই সভ্যতা!
আমেদাবাদ স্টেশনে নেমেছিলাম ভোরে। অটোয় রওনা। পথে প্রায় দুমড়ে থাকা জনজীবন। পথে পড়েছিল একটি বাজার এলাকা। সব দোকান বন্ধ। অধিকাংশ দোকান আর কখনও খুলবে কিনা, সেই প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের শরীর। পোড়া দেওয়াল। ভাঙাচোরা। সামনে ডাঁই করা পোড়া জিনিসপত্র। লোকজন প্রায় নেই।
গুজরাটের সরকারি মদতে দাঙ্গার একটি শিক্ষা ছিল সবরমতীর সংখ্যালঘু নিবিড় সেই অঞ্চলের ছবি। দাঙ্গাকারীরা বাজার 'টার্গেট' করে। জানে মারার পাশাপাশি দাঙ্গার আর একটি লক্ষ্য থাকে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। লুট, দখল সে সব কারনেই। গুজরাটে সংখ্যালঘুদের এলাকায় যেমন আক্রমণ হয়েছিল, তেমনই আক্রান্ত হয়েছিল তাঁদের দোকানগুলিতে।
এপ্রিল মাস ছিল। গোড়ার দিক। সারা দেশে তীব্র ধিক্কার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারত চাপে। সেই সময়, দাঙ্গার প্রায় দেড় মাস পরে কয়েক লক্ষ সংখ্যালঘু ঘরছাড়া। নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসন তখন চাপে পড়ে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছিল। মনে আছে, ১০ই এপ্রিল পুলিশ দাঙ্গা, লুটের অভিযোগে ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ছিলেন!
অন্তঃসত্ত্বা মহিলা কেন ধৃত? জানা গেল, তিনি পরিবারের আরো কয়েকজনের সঙ্গে পারিবারিক গাড়িতে চড়ে বাজারে গেছিলেন - - - লুট করতে। সংখ্যালঘুদের দোকান লুট এবং তারপর জ্বালানো চলছিল। মহিলা গেছিলেন দোকান থেকে লুট করে আনতে। সপরিবারে।
দাঙ্গায় মহিলাদের এমন ভূমিকা আরো দেখেছি। এক বৃদ্ধ দম্পতি ভেবেছিলেন তাঁদের গায়ে কেউ হাত দেবে না। দীর্ঘদিন তাঁরা অন্য ধর্মের প্রতিবেশীদের সঙ্গে থেকেছেন। সম্পর্ক ভালো। কিন্তু দাঙ্গা অন্য শিক্ষা দিল। তাঁদের পাশের বাড়ির লোক বলে যায়, এলাকা ছাড়তে হবে। এখানে তাঁদের জায়গা নেই। সেই দম্পতি যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন প্রাণ বাঁচাতে, তখন পাড়ার এক মহিলা নিজের দোতলার বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন, 'পাকড়ো উনকো। জান সে মার দো। ভাগ রহা হ্যায়।'
আমেদাবাদের শাহ আলম দরগার রিলিফ ক্যাম্পে নিজেদের এই 'অবিশ্বাস্য' অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন সেই বৃদ্ধ দম্পতি।
সেই ক্যাম্প চালাচ্ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা, কর্মীরা। আর ছিলেন কয়েকজন শান্তিপ্রিয় নাগরিক। সেখানে দেখা হয়েছিল জাভেদ হুসেনের সঙ্গে।
বছর ১৪-র জাভেদ শ্রমিক ছিল। সকালে মা নুরজা বেগম খেতে দিতেন। তা খেয়ে জাভেদ দিনমজুরির খোঁজে বেরোত। বাড়িতে অভাব। জাভেদ পড়াশোনার পাট চোকাতে বাধ্য হয়। ২৮শে ফেব্রুয়ারি যে তাঁর জীবনটাই বদলে যাবে কিশোর ভাবেনি। সেদিন সকালে সে তখন বাড়িতে। আচমকা এলাকায় হামলা। ত্রিশূল, লোহার ডানডা হাতে প্রায় দেড়শো জন বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে হামলা চালাচ্ছিল। কী করবে বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের দু কামরার আবাসে হামলা হল। দুষ্কৃতীরা তাঁর দিদিকে ধরে ফেলে। বাঁচাতে ছুটে যান ইসমাইল হুসেন। তিনি ছিলেন জাভেদের বাবা। তাঁকে মেরে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। বাবাকে জ্বলতে দেখে ছুটতে ছুটতে শুরু করেন জাভেদ। পরে জাভেদ জানতে পারে দিদিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তাঁর মাসির স্বামী সুরউদ্দিনের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল হামলাকারীরা।
কিন্তু নুরজা বেগম, জাভেদের মা, তাঁর কী হলো?
রিলিফ ক্যাম্পে বসে জাভেদ হুসেন, "আমাদের সব গেছে। বাবাকে মরতে দেখলাম। কিন্তু আমার মা'র কথাই বেশি মনে পড়ছে। আজানের সময় মা' র মুখটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মা আমাকে খুব ভালোবাসত।"
এতগুলি বছর পরে মনে নেই জাভেদের চোখে কতটা জল ছিল। কিন্তু দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এক কিশোর, এক স্কুলছুট দিনমজুরের এই কথাগুলি ভোলা কঠিন।
২০০২-র আমেদাবাদ দেখিয়েছিল বিভাজন কেমন হয়। তার প্রভাব কেমন? শক্তি কতটা।
যে হোটেলে ছিলাম, তার
এক কর্মী ছিল বাবলু প্রজাপতি। তখন বছর চল্লিশের ছিল। তখন লুঙ্গি পড়তাম। সে-ই আমাকে জানিয়ে দেয় লুঙ্গি পড়া নিষিদ্ধ। আমাকে বলেছিল, "ইয়ে কিউ পেহেনতে হ্যায়। ইয়ে তো উন লোগোকা ড্রেস হ্যায়।" পশ্চিমবঙ্গে অনেক হিন্দুও দিব্যি লুঙ্গি পড়েন এবং অনেকদিন ধরে পড়েন, তাকে বোঝাতে পারিনি। সেই বাবলুর ঘরে আটজন সদস্য ছিল। হোটেলে তার সামান্য বেতনে সংসার চলে না। এক নাবালক ছেলে কাজে ঢুকেছিল। তবু বাবলু প্রজাপতি আমাকে বলেছিল, "খুব বাড় বেড়েছিল ওদের। একদম ঠান্ডা করে দিয়েছে। অনেক বছর ওরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।"
বাবলু দাঙ্গা করেনি। লুটও না। রোজ হোটেলে এসেছে। তার মাথায় ছিল সংসার চালানোর দুশ্চিন্তা।
কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির আকাঙ্খা ছাপিয়ে তাকে গ্রাস করেছিল 'উচিত শিক্ষা'।
(গণশক্তির এই সাংবাদিক ২০০২'র গণহত্যার কিছু পরেই গিয়েছিলেন গুজরাটে। জানিয়েছেন সেদিনের অভিজ্ঞতা।)
Comments :0