MD Salim

সোচ্চার কণ্ঠ ধামাচাপা দিতেই বিভাজনের জিগির গণশক্তি’র প্রতিষ্ঠা দিবসে সেলিম

রাজ্য কলকাতা

মোদী যেভাবে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতি করেছিলেন, মমতা ব্যানার্জিও পশ্চিমবঙ্গে সেভাবেই বাংলাদেশ-বিদ্বেষ জাগিয়ে রাজনীতির ফয়দা তোলার চেষ্টা করছেন। শুক্রবার গণশক্তি’র প্রতিষ্ঠাদিবসের অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানে ‘ঢুকে মারার’ হুমকি দিয়ে মোদী নির্বাচন পার করেছিলেন। এখন পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তৃণমূল আর বিজেপি উভয়েই চট্টগ্রামের পোস্টার বানাচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভীতি জাগাচ্ছে, এখানকার মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটাচ্ছে। ওদের আসল উদ্দেশ্য, এই সুযোগে আর জি করের ন্যায়বিচার, চাকরি চুরির সমাধান, মানুষের রুটিরুজির দাবিতে সোচ্চারিত কণ্ঠকে চাপা দেওয়া। 

এদিন কলকাতায় প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে গণশক্তি পত্রিকার ৫৯তম প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে মহম্মদ সেলিম এবং সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র ভাষণ দিয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার বিপদ এবং মানুষকে বিভাজনের অপকৌশল মোকাবিলার চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে গণশক্তি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসুও এই লড়াইয়ের হাতিয়ার গণশক্তি’কে শক্তিশালী করতে শুভানুধ্যায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। গণশক্তির সম্পাদক শমীক লাহিড়ী শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে বিকল্প ভাষ্য তুলে ধরায় পত্রিকার অবিচল থাকার প্রত্যয়ী ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ। গণশক্তির বহু পাঠক ও গণআন্দোলনের কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

সভায় সূর্য মিশ্র দুনিয়াজুড়ে নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থানের উল্লেখ করে বলেছেন, একশো বছর আগের পরিস্থিতির মতো এখন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ স্তিমিত, সাম্রাজ্যবাদ এখন একজোট। কারণ, পুঁজির এখন জাতীয় চরিত্র নেই, পুঁজি এখন আন্তর্জাতিক। এর হাত ধরে যে দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটেছে তাকেই আমরা নয়া ফ্যাসিবাদ বলছি, এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো সত্যকে চাপা দিতে বারে বারে মিথ্যা বলা, মিথ্যা প্রচারে মানুষকে ধর্ম জাতি ভাষা লিঙ্গ ইত্যাদিতে বিভাজন ঘটানো। আমরা কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতাবাদী, সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করেই পথ চলাটাই আমাদের দায়িত্ব। ফ্যাসিবাদী হিটলার-মুসোলিনির মোকাবিলায় রুজভেল্ট এবং চার্চিলের সঙ্গে স্তালিন যদি এক টেবিলে বসতে পারেন, তাহলে আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলায় বাকিদের সবাইকে একজোট করতে চেষ্টা করবো না কেন! আমরা কোনও ধর্মের বিরোধী নই, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ধর্মের কোনও সংযোগ নেই, সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মিত। রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সূর্য মিশ্র অসহায় দেশবাসীর ‘মূঢ় ম্লান মূক মুখে’ ভাষা জোগানোর জন্য সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। 

মহম্মদ সেলিম বলেন, নানা বাঁক ও মোড়ে নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেও গণশক্তি পত্রিকা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ভাষা জোগানোর কাজই করে চলেছে। ৫৯ বছর ধরে গণশক্তির পাতাগুলি আসলে গণআন্দোলনের মহাফেজখানা। বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমগুলি যখন শাসক ও শোষকের মদতে তাদের শ্রেণিস্বার্থে প্রচার চালাচ্ছে, তখন প্রকৃত তথ্য প্রচারের মাধ্যমে গণআন্দোলনকে শাণিত করতে ভূমিকা পালন করে চলেছে গণশক্তি। পৃথিবীর সর্বত্র কমিউনিস্টরা আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে পত্রিকাকে ব্যবহার করেছে, আমরাও আধুনিক প্রযুক্তিতে শক্তিশালী করে গণশক্তি সহ পার্টির সব পত্রিকা ও মাধ্যমকে ব্যবহার করবো। গণশক্তি ছাপার পরে বিক্রি হয়, বাণিজ্যিক মিডিয়ার বৃহদংশের মতো ছাপার আগেই শাসকের হাতে বিক্রি হয়ে যায় না। 

সেলিম বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন সব লুট হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি লুট হয়ে যাচ্ছে, আর মিডিয়ার সাহায্যে ‘বিদেশি ভীতি’ জাগিয়ে মানুষকে অসহায় করে রাখা হচ্ছে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে দূরে সরিয়েছিলেন। সেই বাংলাদেশে এখন জামাত ধর্মের নামে গণতন্ত্রকে ধংস করছে, আর সেটা দেখিয়ে এখানে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়িয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্র হলে এখানে হিন্দুত্ববাদীদের সুবিধাই হবে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই দুই পক্ষ হাত মিলিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি করছে। এইভাবেই মোদী ‘পাকিস্তান’ দেখিয়ে ভোটে জিতেছিলেন, এইভাবেই পাকিস্তানের শাসকরা ‘কাশ্মীর’ দেখিয়ে ভোটে জিতেছিলেন। পাকিস্তান, কাশ্মীর যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে, কিন্তু শ্রমিক কৃষকদের বেকারদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। 

তিনি বলেন, আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এখন তৃণমূল-বিজেপি চট্টগ্রাম দেখাচ্ছে। মালদহে নিজের দলের নেতারা সুপারি কিলার দিয়ে নিজের দলের নেতাকে খুন করাচ্ছে, আর মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক বৈঠকে বসে প্রশাসনের কাজের মূল্যায়ন না করে সীমান্ত দেখাচ্ছেন, তাঁর ভাইপোও বাংলাদেশ নিয়ে গলাবাজি করছেন। বিজেপি’র মতো তাঁরাও অনুপ্রবেশের কথা বলছে। ‘সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তারা দেশ দখল করে নেবে’ ইত্যাদি ভীতি জাগানোর রাজনীতি করছে বিজেপি আর তৃণমূল। শুধু বাংলাদেশ বিদ্বেষ নয়, দেশের ভিতরে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা জাগিয়েও মানুষের মধ্যে বিরোধ লাগানো হচ্ছে। আপামর জনসাধারণ একজোট হয়ে আর জি করের ন্যায়বিচারের দাবিতে পথ নেমেছিলেন, শিক্ষকের চাকরি যাঁদের প্রাপ্য তাঁরা একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছেন। এখন বিদেশি ভীতি ও প্রাদেশিকতা জাগিয়ে সব দাবি চাপা দিয়ে দিতে চাইছে দুই শাসকদল। 

মতাদর্শগত সংগ্রামকে আরও জোরদার ও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে বিমান বসু বলেন, শুরুর দিন থেকেই মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলেছে গণশক্তি। ১৯৬৭ সালের গণশক্তির পাতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বসু বলেন, যখন সিপিআই(এম)’র ওপর আক্রমণ চলছে, পার্টির ও গণশক্তি কর্মীদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে, তখনও মানুষের কাছে গণশক্তি পৌঁছে দিতে সাহসের সঙ্গে ভূমিকা পালন করেছেন কর্মীরা। ৫৯ বছর ধরে বহু মানুষ গণশক্তির পাশে আছেন, তাঁরা সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্যও করছেন। এখন যারা গণশক্তিকে অর্থ সাহায্য করতে চান তাঁরা যদি নিয়মিত ধারাবাহিক সাহায্যের জন্য পরিকল্পনা করেন তাহলে তা আরও বেশি সহায়ক হতে পারে।

সভায় শমীক লাহিড়ী বলেছেন, সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, কিন্তু বারে বারে তার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এখন বৃহৎ পুঁজির মালিকরাই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব করে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাই মেহনতি মানুষের কথা মিডিয়া থেকে মুছে যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গণশক্তি মতাদর্শে অবিচল থেকে বিকল্প ভাষ্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মানুষের কথা তুলে ধরছে। বহু মানুষের সাহায্য ও দান ছাড়া এটা সম্ভব হতো না, আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। 

এদিন অনুষ্ঠানের শুরুতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। 

Comments :0

Login to leave a comment