সরকারপক্ষ বিষয়টিকে প্রশমিত করার নানা কৌশল নিলেও মণিপুর প্রশ্নে বিরোধীরা অনড়। কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবি থেকে সরছেন না, মঙ্গলবার ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁরা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মুখ খোলানোর জন্য সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা করছে ২৬ বিরোধী দলের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ বলেও জানা গিয়েছে। বুধবার সকালে সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস দাখিল হতে পারে বলে সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। আবার মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনায় প্রস্তুত বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা যথাক্রমে অধীর চৌধুরি ও মল্লিকার্জুন খাড়গকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এতে ‘বরফ গলার’ সম্ভাবনা যে নেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ থেকেই। এরই মাঝে সংসদের উভয় কক্ষে মণিপুর নিয়ে সুসংহত বিবৃতি দেওয়ার আরজি জানিয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মল্লিকার্জুন খাড়গে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। আবার এরই পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সংসদ চত্বরে গান্ধী মূর্তির সামনে ধরনা-অবস্থানও চলছে বিরোধীদের।
সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর প্রথম দিন থেকেই মণিপুরকে ঘিরে সরকার এবং বিরোধী পক্ষের অবস্থানে অচল হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী অধিবেশন শুরুর দিন সংসদ চত্বরে মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নয়, শুধুমাত্র দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো এবং দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে ‘ব্যথিত’, ‘ক্ষুব্ধ’, ‘দেশবাসী লজ্জিত’ গোছের শব্দবন্ধ ব্যবহার করে দায় এড়ান। তারপর থেকে তিনি আগের আড়াই মাস ধরে যেভাবে নীরব ছিলেন, তেমন মৌনতাই অবলম্বন করেছেন। কিন্তু বিরোধীরা প্রথম থেকেই মণিপুর নিয়ে মোদীর বক্তব্যের দাবিতে সরব হয়েছেন এবং এখনও সেই অবস্থান নিয়েই রয়েছেন।
তাই প্রধানমন্ত্রী যাতে সংসদে মুখ খুলতে বাধ্য হন সেজন্য এদিন সকালে বিরোধী দলগুলির সমন্বয় বৈঠকে অনাস্থা প্রস্তাব আনা নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়। বিরোধী দলের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র যুক্তি হলো, অনস্থা প্রস্তাব আনা হলে সরকারের প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ খুলতেই হবে মণিপুর নিয়ে। আবার তিনি নিশ্চুপ থাকলে বিরোধীরা বলতে পারবেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিছু লুকাতেই গোটা বিষয়টিকে এড়ানোর চেষ্টা করছেন। ‘ইন্ডিয়া’ সূত্রেই জানা গিয়েছে, অনাস্থা প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। এরই সঙ্গে ৫০ জন সাংসদের স্বাক্ষর প্রয়োজন। অনাস্থা প্রস্তাব পাঠ করার সময় লোকসভায় এঁদের উপস্থিতি জরুরি। ১৯৮ ধারায় এই অনস্থা প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা নিয়েছেন বিরোধীরা। তবে গোটা বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বুধবার সকালে খাড়গের ঘরে বিরোধীদের রুটিন বৈঠকের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানা গিয়েছে। আর চূড়ান্ত হলে ওইদিন সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে সংসদ দপ্তরে জমা করা হতে পারে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস।
বিরোধী নেতৃত্বের বক্তব্য, মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ খুলতেই হবে। এজন্য সব ধরনের পন্থা নেওয়ার কৌশল নিয়েছেন তাঁরা। আর প্রধানমন্ত্রী সংসদের বাইরে মুখ খুললেও মণিপুরের সঙ্গে বিরোধী দল শাসিত রাজস্থান, ছত্তিশগড় কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কথা উল্লেখ করে গোটা বিষয়টিকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের। অথচ তিনি সুচারুভাবে উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড অথবা গুজরাটে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের কথা বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছেন।
সংসদের দু’কক্ষের বিরোধী দলনেতাদের অমিত শাহের চিঠি দেওয়ার বিষয়টিকে মণিপুরকে ঘিরে উত্তাপকে প্রশমিত করার চেষ্টা বলে মনে করছেন বিরোধীরা। তিনি দু’নেতাকে চিঠি দিয়ে সেই একই কথা শুনিয়েছেন যে, ‘সরকার মণিপুর নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত। তাঁরা যতক্ষণ আলোচনা চান, ততক্ষণই করা যাবে। সরকার আলোচনা করতে ভয় পাচ্ছে না। কারণ সরকারের কিছু লুকানোর নেই।’ এরই সঙ্গে সংসদ নির্বিবাদে চলার জন্য তিনি বিরোধীদের সহযোগিতা চেয়েছেন। অবশ্য চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এমনিতে সরকারপক্ষ মণিপুর নিয়ে শাহকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, ওখানকার পরিস্থিতি যেহেতু আইন শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত তাই বিবৃতি দেওয়া উচিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরই। তবে বিরোধীরা সরকারের এই ‘ছেঁদো’ যুক্তিতে শাহের বক্তব্য শুনতে রাজি নন, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। শাহের প্রস্তাব খারিজ করার কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ আগেই বলেছিলেন, ‘‘খবরের শিরোনামে থাকতেই এখন উনি এ সব কথা বলছেন।’’
একই সঙ্গে সংসদ চত্ত্বরে বিরোধীরা রাতভর অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। ২৬ দলের সাংসদরা রিলে করে অংশ নিচ্ছেন এই অবস্থানে। কেউ সংসদের ভেতরে মণিপুর নিয়ে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন সরকারপক্ষকে, আবার কেউ বাইরে ধরনায় তীব্র শ্লেষাত্মক স্লোগানে আক্রমণ করছেন মোদী-শাহকে। তাঁদের একটাই শর্ত, সংসদে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি না দেওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান চালিয়ে যাবেন গান্ধী মূর্তির সামনে।
আবার প্রধানমন্ত্রীকে লেখা কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে খাড়গে তাঁর চিঠিতে অভিযোগ করেছেন যে, ৮৩ দিন ধরে একটি রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চললেও প্রধানমন্ত্রী অদ্ভুতভাবে নীরব। ওঁর উচিত এবিষয়ে দেশবাসীকে সত্যটা জানাতে সংসদের উভয় কক্ষে সুসংহত বিবৃতি দেওয়া। খাড়গে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী নিজের অহংকার ত্যাগ করে মণিপুর নিয়ে বলা জরুরি। দেশবাসীর আস্থা অর্জনে এটাই ছিল সেরা সময়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ওকানকার পরিস্থিতি সমাল দিতে ব্যর্থ। ফলে এখন প্রধানমন্ত্রীকেই বলতে হবে ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কেন্দ্র কী কী উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে খাড়গে শুধু চিঠিই দেননি প্রধানমন্ত্রীকে, এদিন রাজ্যসভায় মণিপুর নিয়ে সভার দলনেতা পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তখন সভায় উপস্থিত বিরোধী সদস্যরা সমস্বরে ‘মণিপুর’, ‘মণিপুর’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘৫০-র বেশি বিরোধী সদস্য ২৬৭ ধারায় মণিপুর নিয়ে নোটিস দাখিল করেছেন। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না।’’ তখন গোয়েল জানান, অমিত শাহ বিবৃতি দিতে প্রস্তুত। তিনি সত্যটা জানাবেন। এরপর খাড়গে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘‘গোটা দেশ যখন মণিপুর নিয়ে ওঁর মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইছে তখন তিনি সভায় আসছেন না কেন? বাইরে ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে নানা কটাক্ষ করছেন আর সংসদে মণিপুর নিয়ে বলা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয়টিকে কোনও গুরুত্বই দিতে চাইছেন না।’’
No confidence motion
মোদীর মুখ খোলাতে অনাস্থা প্রস্তাব আনার তোড়জোড় বিরোধীদের
×
Comments :0