Jyoti Bose Center

মানুষ জাগছেন, সাহস জোগাতে হবে বামপন্থীদের জ্যোতি বসু কেন্দ্রের সভায় নেতৃবৃন্দ

রাজ্য

Jyoti Bose Center

আমরা আওয়াজ তুলেছিলাম, ‘গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও।’ মানুষ জাগছেন। এখন কোনও কবচ, তুকতাকেই কাজ হবে না। আমরা ভাঙা বুকে পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ব। আর সেই গড়ার লক্ষ্যে মানুষের ঐক্যকে দৃঢ় রাখতে হবে। মানুষের কাছে আমাদের নিয়ে যেতে হবে বিকল্পের কথা। মঙ্গলবার এক আলোচনাসভায় এই আহ্বান জানিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব।
আলোচনাসভার শিরোনাম ছিল ‘পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা — জ্যোতি বসুর ভাবনা, আজকের দুরবস্থা ও ভবিষ্যতের রূপরেখা।’ আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোসাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ। জ্যোতি বসু নগরে (নিউটাউন) যেখানে এই সেন্টার গড়ে তোলার কাজ চলছে, আলোচনাসভা সেখানেই হয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সূর্য মিশ্র এবং সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ছিলেন আলোচক। সভা পরিচালনা করেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। আলোচনাসভার আগে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সৌমেন বসু।

বিমান বসু এদিন সভার আগে সভাস্থলের কাছে গ্রামীণ এলাকায় যান। কথা বলেন গ্রামবাসীদের সঙ্গে। তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বলেন,‘‘আমি কথা বলছিলাম মানুষের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, রাস্তা, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সময়কালে জেলাপরিষদ। আমি সেই সময়কার সভাধিপতি অপর্ণা গুপ্তকে জানালাম আমার অভিজ্ঞতা। গুপ্ত জানালেন, জেলা পরিষদ নয়, গ্রাম সংসদের আলোচনার পর যে কাজের পরিকল্পনা হয়েছিল, তাই হয়েছিল। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর জ্যোতি বসু এই কথাই বলেছিলেন— আমরা রাইটার্স থেকে সরকার চালাব না। ১৯৮৪-র ৩১ মে পঞ্চায়েত, পৌরসভায় ১৮ বছরের ভোটাধিকারও জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন সরকার এবং বামফ্রন্টের মানুষের আরও অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গির ফল।’’


সূর্য মিশ্র বিস্তৃতভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনায় জ্যোতি বসুর ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘‘জ্যোতি বসু বিরোধী দলনেতা ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন— শুধু এভাবে বিচার করলে হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১-এও তাঁর নেতৃত্বে আমাদের সরকার হতে পারত। করতে দেওয়া হয়নি। ১৯৭২-এ ব্যাপক ভোট লুট, রিগিং করে হারানো হয়েছিল। সেই ভোটের পর আমাদের বিধায়করা একদিনও বিধানসভায় যাননি। বয়কট করা হয়েছিল। অর্থাৎ সেই সময়েও বিধানসভায় আমাদের কোনও প্রতিনিধি সে অর্থে ছিল না। কিন্তু তারপরও ১৯৭৭-এ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সরকার গড়ে উঠেছিল।’’ বামফ্রন্ট সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের তথ্য উল্লেখ করে মিশ্র বলেন,‘‘কী করতে হবে বুঝতে হলে জ্যোতি বসুর কাছে ফিরতে হবে। আমাদের বিকল্প নিয়ে পৌঁছোতে হবে মানুষের কাছে। আমাদের সাফল্যের বিষয়গুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তখনকার মতো করে সব একরকম হবে না। কিন্তু আমাদের বিকল্পের কথার ভিত্তিতেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সরকার আমাদের নেই। কীভাবে পঞ্চায়েত, পৌরসভা চালাতে পারি এই পরিস্থিতিতে? তাহেরপুরের উদাহরণকে তুলে ধরতে হবে। সরকার, পঞ্চায়েত, পৌরসভায় না থাকা সত্ত্বেও অতিমারীর সময় কীভাবে কাজ করেছি, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। পথ খুঁজতে হবে। মানুষের উপর আস্থা রাখতে হবে।’’


মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘কেন্দ্রের টিম এসেছে এখন। অথচ ২৭টি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের প্রকল্প পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০১৪ থেকে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার পরিচালনা করছে। তারা ওই ২৭টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কীভাবে হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে পারতেন। বারবার চিঠি লিখেছি আমরা। ওরা কখনও মনে করেনি তৃণমূল সরকারকে ঘাঁটাতে হবে। ওদেরই ফ্র্যাঞ্চেইজি। মাঝে মাঝে ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া হয়।’’
সেলিম আরও বলেন,‘‘আন্দোলনকে অভিনন্দন। লাল ঝান্ডা নিয়ে গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও যখন বললাম, চোর ধরো জেল ভরো যখন বললাম, আজ তখন মানুষের দুর্দশার কিছু কথা বাইরে আসছে। কী লুঠতরাজ, দুর্নীতি হয়েছে তা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন মানুষ পতাকা হাতে বেরিয়েছেন, তাতেই অনেকের ভয়। এখনও মশাল হাতে নিয়ে গ্রামের মানুষ বেরিয়ে আসেননি। মানুষ জাগছেন। আগে দেখেছি ‘দিদিকে বলো।’ এক ফোনে অমুককে। এখন বলছে রক্ষা কবচ। সুরক্ষা কবচ। আমি বারবার বলি আসলে দেহত্রাণ। দেহকে বাঁচানোর জন্য। মাথা বাঁচানোর জন্য শিরস্ত্রাণ। শরীরকে বাঁচানোর জন্য কবচ। ওর দর্শন হচ্ছে আমি আঘাত করব। কিন্তু তোমার আঘাত আমাকে ছোঁবে না।


এটাই কবচ। এটুকু তো হলো গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও আন্দোলনে। সামনে অনেক বড় ফাঁড়া। তাই তৃণমূলের লোকদের বলেছেন কবচ ধারণ করো। পঞ্চায়েত যেভাবে লুট করে, মা বোনেদের মেরেছে, দখল করেছে বুথ, তারপর পঞ্চায়েতকে কুক্ষিগত করেছে, আজ কোনও কবচ, তুকতাক, কাজ দেবে না। রক্ষা কবচ নিয়ে যাচ্ছে ওরা। মানুষ তাড়া করছে। মানুষ ভরসা চায়। সাহস চায়। সেই ভরসা, সাহস জোগানোর দায়িত্ব বামপন্থীদের নিতে হয়। আমরা সেই দায়িত্ব নেব। আমরা আক্রান্ত হয়েছি। রক্তাক্ত হয়েছি। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। কাকদ্বীপে দীপঙ্কর নতুন তদন্ত ছিনিয়ে এনেছে। যতক্ষণ ভয় পায়, ভয় কাজ করে। একবার যখন মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, ভয় জয় করে, তখন যাঁরা ভয় দেখিয়েছিল তারাই পালাবার পথ খোঁজে।’’
মহম্মদ সেলিম বলেন,‘‘মোদী অথবা মমতা বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে চায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই দক্ষিণপন্থার কাজ। এটাই স্বৈরতন্ত্র ডেকে আনে। এই পথেই তো ফ্যাসিবাদ। হয় দিল্লিতে। নয় নাগপুরে। নয় কালীঘাটে। ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে।


বামপন্থা মানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। মানুষের হাতে আরও ক্ষমতা। মানুষের অংশীদারী। প্রতিষ্ঠানে মানুষের কণ্ঠস্বর থাকবে না। ওরা চেয়েছিল। যাতে বামপন্থীদের কোনও প্রতিনিধি না থাকে। ওরা চায় গ্রামসভায় ক্ষমতা নয়। আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কোনও ভূমিকা নেই। শুধু পঞ্চায়েত, পৌরসভায় নয়, আমাদের কথা গ্রামসভায় আলোচনা। দক্ষিণপন্থা চায় পছন্দের আমলাদের দিয়ে কাজ করানো হবে। ফল আমরা দেখছি — আমরা দেখছি ১ শতাংশ মানুষের হাতে ৪৩ শতাংশ সম্পদ। উন্নয়ন হবে প্রয়োজন ভিত্তিক। যা আমলারা নন, বুঝবেন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ।’’ 
সেলিম আহ্বান জানান, ‘‘অপার সম্ভাবনা নিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। এমন অন্তত ২০টি বিষয় আমরা চিহ্নিত করতে পারি। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন বাংলার মেধা বাংলা গড়ার কাজে লাগানো হবে। ভাঙা বুকে পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ব। তারজন্য মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে। মানুষের ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে।’’

এদিনের আলোচনাসভার মঞ্চে সিপিআই(এম) নেতা রেখা গোস্বামী, পলাশ দাশ, মৃণাল চক্রবর্তী, সুখেন্দু পাণিগ্রাহী, অপর্ণা গুপ্ত প্রমুখ ছিলেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment